মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১০
মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (স্বাধীনতা সংগ্রামী, ঘাটাল)
ভাস্করব্রত পতি
ঘটনার সময়কাল ১৯৩০ সালের ৬ ই জুন। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের চেঁচুয়াহাটে পলাশপাই খালের পাশে সেদিন যে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ, আজও প্রতি বছর এখানকার মানুষ শ্রদ্ধায় স্মরণ করে দিনটি। সেদিন পুলিশের গুলিতে ১৪ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয় এখানে। এখানকার মানুষ আজও ভোলেনি সেদিনের ঘটনা।
এই ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া সত্যাগ্রহীদের দ্বারা ব্রিটিশের দুই দারোগা হত্যার ঘটনা। যে ঘটনায় জড়িত ছিলেন দাসপুরের তরুণ বিপ্লবী মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। পরবর্তীতে তিনি এলাকার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থানার কলোড়া গ্রামে ১৯১০ সালে জন্মগ্রহণ করেন মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার দরুন দশম শ্রেণীর বেশি আর পড়া হয়নি তাঁর। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহের সময় চেঁচুয়াহাটে দারোগা হত্যা মামলার মূল আসামি ছিলেন তিনিই।
১৯৩০ সালে গান্ধীজির লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের আহ্বানে সারা মেদিনীপুর জেলার মতো দাসপুরের শ্যামগঞ্জেও লবণ উৎপাদন শুরু করেন এখানকার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সেসময় এখানকার তেমুয়ানি ঘাট, নন্দনপুর, চক কিশোর, সোনাখালি, শ্যামগঞ্জ এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তীব্রভাবে। নেতৃত্বে ছিলেন পুষ্প চ্যাটার্জী, কিশোরী মাল, জীবনকৃষ্ণ মাইতি, জানকীরঞ্জন রাজ পণ্ডিত, মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, কানন গোস্বামী, বিনোদ সামন্ত প্রমুখ সত্যাগ্রহীরা। সেসময় তাঁদের তৈরি লবন বিক্রি করা সহ বিদেশী দ্রব্যের বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার করার কাজে চেঁচুয়াহাটকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা।
গবেষক দুর্গাপদ ঘাঁটি লিখেছেন, "মৃগেন্দ্রনাথ চেঁচুয়াহাট সংলগ্ন বাসিন্দা হওয়ায় চেঁচুয়াহাট ও তার সংলগ্ন এলাকা ছিল তাঁর নখদর্পণে। তাই তাঁর উপর দায়িত্ব ছিল এই এলাকায় ব্রিটিশ পুলিশের গতিবিধি ও স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে খবর আদান প্রদানের কাজ। যেহেতু প্রাচীন চেঁচুয়াহাট ছিল দাসপুর থানার সংস্কৃতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের প্রাণকেন্দ্র সেইহেতু দাসপুর থানার অন্যান্য অঞ্চলের থেকে এই চেঁচুয়াহাটের উপর নজরদারী ছিল বেশি। এলাকায় কয়েকজন বিত্তশালী ব্যক্তি অধিক মুনাফা লাভের জন্য দেশের স্বার্থ না ভেবে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চেঁচুয়ার হাটকে বিদেশি দ্রব্য বিক্রয়ের উন্মুক্ত প্রান্তর করেছিলেন। তাই এই চেঁচুয়াহাটই স্বদেশীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়েছিল। মৃগেন্দ্রনাথ ছিলেন চেঁচুয়াহাটের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী মুখ। তিনি চেঁচুয়াহাটকে পাখির চোখ করে ২৪ ঘণ্টা নজর রাখতেন। এখানকার সকল খবরাখবর স্বদেশীদের গোপনে প্রদান করতেন।"
ঘটনায় প্রকাশ, ৩ জুন তারিখে চেঁচুয়াহাটে লবন উৎপাদনকারীরা পিকেটিং করার সময় থানার বড় দারোগা ভোলানাথ ঘোষ সেখানে আসেন। পিকেটিং বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। তখন দারোগা কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে ঐ লবন সত্যাগ্রহীদের উপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করেন। অনেকে অচৈতন্য হয়ে পড়েন। তাঁদের গায়ে মল মূত্র ত্যাগের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও সেদিন ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দাসপুরের চেঁচুয়াহাটে পিকেটিংয়ের সময় এখানকার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী মুখ বিপ্লবী মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দারোগা ভোলানাথ ঘোষের কথা কাটাকাটি হয়। উন্মত্ত এবং উত্তেজিত জনতা তখন ঐ অত্যাচারী বড় দারোগা ভোলানাথ ঘোষ ও ছোট দারোগা অনিরুদ্ধ সামন্তকে সেখানেই হত্যা করে। রাতের অন্ধকারে ডোমনার ঘাটে পুড়িয়ে ফেলা হয় ভোলা দারোগার দেহ। আর ছোট দারোগাকে বোওয়ালিয়ার মাঠে চিৎমল্লিকা পুকুরের জলে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেয় উন্মত্ত জনতা। পুলিশ মৃত দুজনের কারোরই দেহাংশ খুঁজে পায়নি পরবর্তীতে। অত্যাচারী দারোগার প্রতি মানুষের সমবেত ঘৃণা এই হত্যাকাণ্ডের মূলে ছিল।
জেলাশাসক পেডির নির্দেশে পরের দিন ৪ ঠা জুন দলবল নিয়ে চেঁচুয়াহাটে হাজির হয় এডিএম আবদুল করিম এবং দারোগা ইয়ার মহম্মদ। বিশাল পুলিশ বাহিনী পৌঁছায়। তাঁরা জনগণের উপর পৈশাচিক অত্যাচার করতে শুরু করে। শুরু হয় ধরপাকড়। এই পুলিশী অত্যাচারের প্রতিবাদে ৬ জুন চেঁচুয়াহাট এলাকায় বিশাল জনতা জড়ো হয়। সেদিনটি ছিল দশহরা। পুলিশী অত্যাচার বন্ধের দাবিতে মানুষজন পুলিশের কাছে আবেদন জানালেও কোনও সুরাহা হয়নি। বিকেলে বিভিন্ন দিক থেকে প্রচুর মানুষের মিছিল শুরু হয়। আর এতেই ভয় পেয়ে নৃশংসভাবে গুলি চালায় পুলিশ। মৃত্যু হয় ১৪ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীর। আহত হয়েছিলেন ১৪৫ জন।
চেঁচুয়াহাটের শহীদ স্মারক
সেদিন পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় চন্দ্রকান্ত মান্না (তেমুয়ানি), শশীভূষণ মাইতি (সয়লা), কালিপদ শাসমল (জালালপুর), ভৃগুরাম পাল (মোহনমাইতিচক), দেবেন্দ্রনাথ ধাড়া (জোতভগবান), সতীশচন্দ্র মিদ্যা (খাড় রাধাকৃষ্ণপুর), রামচন্দ্র পাড়ই (জ্যোতঘনশ্যাম), নিতাই পড়্যা (পাঁচবেড়িয়া), অবিনাশ দিণ্ডা (বাঁশখানি), সত্য বেরা (বাঁশখানি), পূর্ণচন্দ্র সিংহ (খাড়), মোহনচন্দ্র মাইতি, অশ্বিনী দোলই (চক বোয়ালিয়া) এবং কালি দিণ্ডা (গোবিন্দপুর) নামে ১৪ জন সত্যাগ্রহীর।
চেঁচুয়াহাটের এই গণবিদ্রোহের জন্য দেশের দ্বিতীয় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এই ঘটনায় মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৩০ এর ২৫ শে সেপ্টেম্বর স্পেশাল ট্রাইবুন্যালের বিচারে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। পরে হাইকোর্টের বিচারে দ্বীপান্তরের বদলে ৭ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। এছাড়াও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় কানন গোস্বামী, মৃগেন্দ্রনাথ বাগ, শীতল ভট্টাচার্য, যোগেন্দ্র হাজরা, ভূতনাথ মান্না, বিনোদ বেরা, শীতল ভট্টাচার্যদের। সাত বছরের জেল হয় জীবন পতি, কালিপদ সামন্ত, কালাচাঁদ ঘাঁটি, যুগল মাল এবং ব্রজ ভুঁইয়ার। সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগের পর জেল থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করেন এবং নিজের বাড়িতে অন্তরীণ অবস্থায় স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ঘাটাল আসায় আবারও গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড ভোগ করেন।
১৯৩৮ এর আগে কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য হন। তবে ১৯৬৪ তে তিনি সি পি আই (এম) দলের সদস্যরূপে যোগ দেন। ১৯৫২ এর প্রথম নির্বাচনে দাসপুর কেন্দ্র থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ১৯৬২ এর নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি। তবে ১৯৬৯ এ অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে সি. পি. আই. (এম.) দলের প্রার্থী রূপে বিধায়ক হয়েছিলেন। সেসময় পশ্চিমবঙ্গের কারাসমূহের পরিদর্শক কমিটির সদস্য হন। চিন ভারত সীমান্তে যুদ্ধের সময় নিরাপত্তা রক্ষার আইনে ফের একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৭২ এর ১৪ ই জুলাই মেয়ের বাড়ি অমরপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘাটাল হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর।
গবেষক কেশব মেট্যার আক্ষেপ, "সরকারিভাবে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ এখনও তৈরি হল না। এখনও জাতীয় ইতিহাসে স্থান পায়নি দাসপুরের এই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। এমনকি চেঁচুয়াহাটের গণ জাগরণের পিছনে ছিল শ্যামগঞ্জের লবণ উৎপাদন এর ঢেউ। সেই শ্যামগঞ্জে নেই কোনো স্মৃতিস্মারক!"
🍂
0 Comments