জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /৩৮তম পর্বতৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে        
৩৮তম পর্ব
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব     
          
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      


প্রভাস তীর্থ এমনই এক তীর্থ যেখানে স্নান করার পরে পূর্ব জীবনের সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সেই জন্যই যাদবদের নিয়ে কৃষ্ণ বলরাম এতখানি পথ অতিক্রম করে এখানে এসেছেন। কৃষ্ণ বলরাম প্রভাস তীর্থে অবগাহন করার সময় যাদবদের মঙ্গল প্রার্থনা করলেন। উর্ধ্বাকাশে তাকিয়ে তাঁরা বললেন "হে জগত পিতা, ঋষিদের অভিশাপ থেকে সমগ্র যাদব সমাজ যেন মুক্ত হয়।" ধ্যান, পূজা-পাঠ, প্রার্থনা শেষ করার পরে সিক্ত বসনে তাঁরা তীরে এসে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু তীরে এসে তাঁরা কি দেখলেন! সমস্ত যাদবগণ মদ্যপান করে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। কৃষ্ণ বলরাম এই দৃশ্য দেখে ত্বরিতগতিতে সাত্যকি, কৃতবর্মার দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন "তোমরা শীঘ্র মহাস্নানের আয়োজন করো।" সেই সময় কৃতবর্মা বলে উঠলেন "মহাস্নানের আর কি প্রয়োজন? তোমরা তো স্নান করেছো, সেই পূণ্য আমরাও পাব। তার থেকে বরং এখন আমরা এই মদিরাতে অবগাহন করে আনন্দ লাভ করি"। এরপরে মদিরা পান করার জন্য সাত্যকি ও কৃতবর্মা উভয়ে একে অপরকে দোষারোপ করে কোমর বন্ধনী থেকে অসি নিষ্কাশন করে একে অপরের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে লাগলেন। সাত্যকি কৃতবর্মাকে হত্যা করার পরে সমবেত যাদবগন হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে বলল "এসো আমরা সাত্যকিকে হত্যা করে কৃতবর্মার বধের প্রায়শ্চিত্ত করি। সাত্যকি চিরকাল কৃষ্ণ বলরামের পদলেহী"। যাদবদের নিজেদের মধ্যে এই যুদ্ধ দেখে অগ্রজ বলরামকে আকর্ষণ করে কৃষ্ণ বললেন "চলুন আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কোন লাভ নেই। যাদবরা আজ মহাকালের করালগ্রস্ত হয়েছে।" তাঁরা দেখতে পেলেন নিজেদের মধ্যে যখন যুদ্ধ করে অসংখ্য যাদব সেই প্রভাসের তটভূমিতে মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন অবশিষ্টেরা সমুদ্রের জলে ভেসে আসা নলখাগড়াগুলিকে উৎপাটন করে নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করল এবং সকলেই সেই প্রভাসের তীরে মৃত্যু শয্যায় চিরশান্তি লাভ করল। 
🍂

যাদবদের এই করুণ পরিনতি দেখে কৃষ্ণ বলরামকে বললেন "অগ্রজ, আপনি এখানে কিছু সময় অপেক্ষা করুন, আমাকে একবার দ্বারকায় যেতে হবে। সেখানে শিশু, নারী ও বৃদ্ধেরা অরক্ষিত অবস্থায় আছেন। তাদের নিরাপত্তার ব্যাবস্থা করে আমি পুনরায় এখানে ফিরে আসব"। এই কথা বলে তিনি তাঁর রথের সারথি দারুককে বললেন "তুমি আমাকে এখনই দ্বারকায় নিয়ে চলো। সেখানে যে সমস্ত শিশু নারী ও বৃদ্ধরা আছেন তাদের নিরাপদ স্থানে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে"। দ্বারকায় কৃষ্ণ পৌঁছানো মাত্র সমস্ত ঘটনাবলী মহারাজ উগ্রসেন, পিতা বসুদেব, অক্রুর প্রমুখকে বর্ণনা করার পরে বললেন "আপনাদের জন্য আর একটি দুঃসংবাদ আছে। দ্বারকা শীঘ্রমধ্যে সমুদ্রের জলে নিমগ্ন হয়ে যাবে।" এই কথাগুলি বলে তিনি দারুককে বললেন "তুমি শীঘ্রমধ্যে অনিরুদ্ধ পুত্র বজ্রসেনকে নিয়ে দ্বারকা থেকে হস্তিনাপুরে যাবে। হস্তিনাপুরে গিয়ে তৃতীয় পান্ডব অর্জুনকে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে বলবে সে যেন অচিরেই এসে এই অসহায় মানুষগুলিকে উদ্ধার করে হস্তিনাপুরে নিয়ে যায়।" মহারাজ উগ্রসেনকে বললেন "যতক্ষণ পর্যন্ত তৃতীয় পাণ্ডব এখানে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনারা দ্বারকা নগরীর প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে রাখবেন। আমার বিশ্বাস এই বার্তা পেয়ে অর্জুন অতি দ্রুত এখানে চলে আসবে এবং আপনাদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে"।  শ্রীকৃষ্ণ শেষবারের মতো প্রিয় দ্বারকা পুরীর দিকে তাকিয়ে ভাবলেন মহাকালের নিয়মে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। একদিন কালের যাত্রা পথে তাঁকে দ্বারাবতী তৈরী করতে হয়েছিল, আজ আবার তিনি মহাকালের অমোঘ নিয়মে দ্বারাবতী ত্যাগ করে চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছেন।                   

কৃষ্ণ প্রভাসে এসে দেখলেন কোথায় সেই সমস্ত মৃতদেহের পাহাড়, কোথায় বা তাঁর অগ্রজ বলরাম। তিনি বুঝতে পারলেন মহাসমুদ্রের উন্মত্ত জলরাশি প্রভাসের তটভূমিকে গ্রাস করেছে। অনেক অন্বেষণ করে কৃষ্ণ খুঁজে পেলেন অগ্রজ বলরামের নিথর, নিস্পন্দ দেহ। তিনি দেখলেন বলরামের আনন থেকে এক বিরাট সর্পরাজ শেষনাগ সমুদ্রের দিকে গমণ করছে। তিনি বুঝতে পারলেন অগ্রজ বলরাম যোগ ধ্যানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে কৃষ্ণ বলরাম ছিলেন একই প্রাণ। আজ বলরামের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরে পৃথিবীকে বড় শূন্য বলে মনে হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের। 

মৃত্যু কোথায়, কেউ আমরা তা জানি না। কোথায় মৃত্যু প্রহর গুনছে শ্রীকৃষ্ণের জন্য প্রভাসে না অন্য কোথাও? কৃষ্ণ প্রভাসের সমুদ্র থেকে কিছুটা দূরে শান্ত, ক্লান্ত হয়ে এক বৃক্ষতলে উপবেশন করলেন। চোখ বন্ধ করে তিনি ভাবতে লাগলেন হস্তিনাপুর থেকে অর্জুনের কপিধ্বজ রথ এগিয়ে যাচ্ছে দ্বারকার দিকে। দেবদত্ত শঙ্খধ্বনিতে আকাশ বাতাস কম্পিত হচ্ছে। দ্বারকাবাসীদের নিয়ে অর্জুন হস্তিনাপুরে ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু কৃষ্ণবিহীন ভাগ্যের পরিহাসে দ্বারকার নারীদের সম্ভ্রম লুন্ঠিত হয়েছিল দস্যুদের দ্বারা। মহাকালের নিয়মে অর্জুনের আজ আর সেই শক্তি নেই যে দ্বারকাবাসীদের তিনি রক্ষা করবেন। 

এমন সময়ে এক ব্যাধের শর এসে তাঁর পদপ্রান্তে বিদ্ধ করল। সমস্ত শরীরে তখন এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠেছে। মহাকালের নিয়মে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে তিনি তার নিজস্ব আবাস গোলোকধামে ফিরে যাবেন। সূর্য ক্রমশ পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ল এবং একসময় রক্তিম লজ্জায় অবনত হয়ে সাগরের জলে মুখ লুকিয়ে ফেলল। কৃষ্ণ দেখলেন তাঁর সামনে এক ভীত শবর দাঁড়িয়ে আছে। সেই শবর বলল "আমার লক্ষ্যভ্রষ্ট তীর আপনাকে আঘাত করেছে, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।" কৃষ্ণের মুখে তখন বরাভয়ের হাসি। তিনি বললেন "নিষাদ, তোমার তো কোনো অন্যায় হয়নি। কি নাম তোমার?" সেই নিষাদ বলল "প্রভু আমার নাম জরা।" কৃষ্ণ বললেন "তুমি নির্ভয়ে ফিরে যাও। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি"। জরা শবর মস্তক অবনত করে ফিরে চলে গেল। শ্রীকৃষ্ণের চোখের পরে সমস্ত রাজ্যের ঘুম যেন চলে এলো। সেই ঘুমের মধ্যে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন মহাসমুদ্রের উন্মত্ত জলরাশি সমগ্র দ্বারাবতী নগরীকে গ্রাস করেছে।

দুর্যোধন জননী গান্ধারীর অভিশাপের ফলস্বরূপ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাত্র ৩৬ বছর পরে দ্বারকানগরীতে শ্রীকৃষ্ণের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সহ যাদবগন পরস্পর কলহ লিপ্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। যাদবরা সবংশে নিহত হওয়ার পরে বলরাম যোগ বলে দেহত্যাগ করেছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ স্ব-ইচ্ছায় জরা শবরের বানাঘাতে মর্তলীলা সম্পন্ন করেছিলেন। এরপরে যাদব রমণীগণ দস্যুদের দ্বারা অপহৃতা ও নিগৃহীতা হয়েছিলেন। তৃতীয় পান্ডব অর্জুন কোনভাবেই তাঁদের রক্ষা করতে পারেননি। কারণ শ্রীকৃষ্ণের অদর্শনে তাঁর সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়েছিল। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে দ্বারকানগরী সমুদ্রের তলায় নিমজ্জিত হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যদেহ ত্যাগের পরে তাঁর পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী অর্জুন সুভদ্রাকে নিয়ে দ্বারকা নগরীতে পৌঁছে যান। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের অদর্শনে সুভদ্রা মৃত্যুবরণ করেন। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ বলরাম এবং সুভদ্রার দেহ প্রভাস তীর্থে নিয়ে যেয়ে সৎকার করতে গেলে তাঁদের দেহ সম্পূর্ণরূপে দগ্ধ হয়নি। সেই অবস্থায় তাঁদের অপরিদগ্ধ নাভিস্থল এবং চিতাভস্ম প্রভাস তীর্থের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা জানি এরপরে এই অপরিদগ্ধ নাভিস্থল ও চিতাভস্ম সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ভারতভূমির পূর্বদিকে নীলাচল পাহাড়ের তীরে এসে পৌঁছায়। দ্বাপর যুগের জরা শবর কলিযুগে বিশ্বাবসু শবররূপে জন্মগ্রহন করে শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে শ্রীক্ষেত্রে আজীবন নীলমাধব রূপে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেছিল। সংক্ষেপে এই হল শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকালীলা।(পরবর্তী অংশ ৩৯তম পর্বে..)

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments