জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে/ ৩৭তম পর্ব/তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে        
৩৭তম পর্ব
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব               
 
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      

একদিন শ্রীকৃষ্ণ পদচারণা করতে করতে দ্বারকার সমুদ্র তীরে চলে এলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে দ্বারকার বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ ঋষভ মুণির সাক্ষাৎ ঘটলো। কৃষ্ণকে দেখে ঋষভ বললেন "কৃষ্ণ, আমি দীর্ঘদিন তোমার অনুসন্ধানে মগ্ন ছিলাম। আমি জানি তুমি এখন ঋষির অভিশাপ ব্যর্থ করার কাজে ব্যস্ত। আমি সেই জন্য তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে সত্য ঘটনা তোমার কাছে ব্যক্ত করা প্রয়োজন"। কৃষ্ণ বললেন "আমি আপনার মুখাবয়ব দেখেই বুঝতে পেরেছি আপনি খুব চিন্তিত হয়ে আছেন। বলুন আপনি আমায় কি বলতে চান?" ঋষভ বললেন আমি জ্যোতিষ গণনার দ্বারা এক অদ্ভুত ফলাফল দর্শন করেছি। যদি আমার গণনা ভ্রান্ত হয় তাহলে আমি হব সবথেকে সুখীতম ব্যক্তি। ঋষভের উদ্বিগ্নতা লক্ষ করে কৃষ্ণ ঋষভকে অনুসরণ করে তাঁর কার্যালয়ে প্রবেশ করলেন। সেখানে যাবার পরে কৃষ্ণের হাতে ঋষভ এক ভূর্জপত্র তুলে দিয়ে বললেন "তুমি একবার এই লেখাগুলির উপর দৃষ্টিপাত কর"। কৃষ্ণ ভূর্জপত্রে তাঁর মনসংযোগ নিবদ্ধ করে দেখলেন গণনার সমস্ত ভবিষ্যৎবাণীগুলি অভ্রান্ত বলে তাঁর মনে হল। ভূর্জপত্রের সমস্ত গণনা পরিলক্ষিত করে কৃষ্ণ ঋষভকে বললেন "জ্যোতিষর্ণব, আপনি বলুন কেমন করে এই নিমজ্জমান জাতিকে রক্ষা করা যাবে।" ঋষভ বললেন "একদা তুমি যেভাবে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে মত্ত যাদববাসীদের মথুরা থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলে সেই ভাবে তুমি কি কোন নতুন ভূখণ্ডের সন্ধান করতে পারবে না। কারণ কয়েকদিনের মধ্যেই এই দ্বারকানগরী সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। তোমার আর বলরামের নেতৃত্বে আমরা মথুরা ত্যাগ করে সুদূর এই রৈবতক পর্বতপ্রান্তে ছুটে এসেছিলাম। তুমি তিল তিল করে গড়ে তুলে ছিলে এক উন্নত দ্বারকানগরীকে, আজ তোমাকে আবার সেই চেষ্টা করতে হবে এই নগরী ত্যাগ করে নতুন ভূখণ্ডে যাওয়ার জন্য।" মৃদু হেসে শ্রীকৃষ্ণ বললেন "মহর্ষি, কালের আবর্তনে আমার মধ্যে আর সেই যৌবন শক্তি অবশিষ্ট নেই। আমার মনে এক নিষ্পৃহতার জন্ম নিয়েছে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে কালের যাত্রাপথে আমিও বোধহয় আর বেশিদিন এই পৃথিবীতে থাকবো না"। শ্রীকৃষ্ণের এই কথা শুনে ঋষভ বললেন "তোমাকে ঘরে ঘরে মানুষ ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করে থাকে। তুমি এতখানি অসহায় হয়ে গেলে এই দ্বারকা নগরীর জনজীবন সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যাবে। আজ অবধি জীবনে কোন যুদ্ধে তুমি পরাজয়ের তিক্ততা গ্রহণ করনি। জীবনের এই শেষ যুদ্ধেও তুমি জয় লাভ করবে-এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস"। ঋষভের কথাগুলি শুনে কৃষ্ণ চিন্তিত মনে ফিরে এলেন।                            

কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন সকাল বেলা হঠাৎ এক বজ্রগর্ভ মেঘ দ্বারকার আকাশে উড়ে এলো। প্রচন্ড বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করল। মহাসমুদ্রের উন্মত্ত উর্মিমালা দ্বারকার প্রবেশ প্রাচীরের উপরে ক্রমাগতঃ আঘাত হানতে লাগলো। অভিজ্ঞ কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন এই হল সর্বনাশের সূচনা। তখনই হঠাৎ প্রবল শব্দে এক বজ্রপাত হলো। সেই বজ্রের নীলাভ উজ্জ্বল আলোয় চারিদিক ঝলসে উঠল এবং সেই উজ্জ্বল বিদ্যুৎ আলোকে হঠাৎ কৃষ্ণের সামনে এক ভূমিখন্ড উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন এই হল সেই ভূমিখণ্ড যেখানে যাদবদের নতুন বাসস্থান তৈরি করতে হবে। সমস্ত যাদবদের সংগঠিত করে সেই ভূমিখণ্ডের দিকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? 

🍂

কৃষ্ণ দেখলেন দ্বারকাবাসীরা ঝড় জল উপেক্ষা করে তাঁর আবাসের সামনে এসে আর্তনাদ করতে শুরু করেছে। তারা বলতে লাগলো "হে কৃষ্ণ, আপনি আমাদের এই মহাপ্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা করুন। আপনি আমাদের রক্ষাকর্তা। আপনাকে আমরা যাদবদের উদ্ধার কর্তা হিসেবে জানি।" সমবেত জনগণের এই আর্তনাদ অনুধাবন করে কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যাদবদের মধ্যে তার প্রতি এখনো এতখানি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা, আনুগত্য অবশিষ্ট আছে। তিনি চিন্তা করলেন এখনই এই দ্বারকাবাসীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেই সমবেত জনতার মধ্যে কয়েকদিন পূর্বের উচ্ছৃঙ্খল যুবকেরা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন "আমরা আমাদের আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থী। আপনি আমাদের সমস্ত অন্যায়কে নিজ গুনে ক্ষমা করুন"। কৃষ্ণ যাদবদের সেই কাতর স্বরে উদ্গত কণ্ঠস্বরের উত্তরে বললেন "যাদব সমাজকে আজ এক মহা অবক্ষয় গ্রাস করেছে। ঋষির অভিশাপ থেকে যদি আপনারা মুক্তি পেতে চান তাহলে আপনাদের পবিত্র জীবনে ফিরে যেতে হবে। আপনারা কি তা পারবেন?" সকলে সমস্বরে বলল "আপনার যেকোন নির্দেশ আমরা অক্ষর অক্ষরে পালন করতে প্রস্তুত।" সেই ভীত সন্ত্রস্ত জনগণের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ বললেন "আমি একটি নতুন ভূমিখণ্ডের সন্ধান পেয়েছি। দ্বারকা থেকে কিছু দূরে প্রভাসে আমাদের যেতে হবে। আপনারা মানসিকভাবে তৈরি হন সেই প্রভাস যাত্রার জন্য। নারী, শিশু আর বৃদ্ধরা দ্বারকায় থেকে যাবে। সমস্ত পুরুষেরা আগামীকাল প্রভাতে প্রভাসে গমন করে সেখানের পবিত্র জলে অবগাহন করে পাপ মুক্ত হবে। তারপরে ঋষিদের অভিশাপ থেকে মুক্ত এক নতুন জীবন পথের সন্ধান দেবো আপনাদের।" সমবেত জনগণ কৃষ্ণের এই বাণী শুনে আশান্বিত হয়ে বলল "আমরা প্রস্তুত, আপনি আমাদের উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারেন"। কৃষ্ণ বললেন "আপনার নির্ভয়ে নিজে নিজে গৃহে গমন করুন। এই ভয়ঙ্কর প্রলয় কিছুক্ষণের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যাবে। আপনারা শুধু প্রভাস যাত্রার জন্য প্রস্তুতি শুরু করুন"। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমিত হয়ে আকাশে সূর্যের উজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছে। যাদববাসীরা বুঝতে পারলেন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন একমাত্র অলৌকিক শক্তির অধিকারী শ্রীকৃষ্ণ। 

পরের দিনে নারী শিশু ও বৃদ্ধদের বাদ দিয়ে সমস্ত দ্বারকাবাসী কৃষ্ণ ও বলরামের অনুগমন করলেন। কিন্তু বিধির নির্বন্ধ কে খন্ডন করবে? পথিমধ্যে দেখা গেল দ্বারকাবাসীরা যে সমস্ত ঘোড়ার পিঠে তাদের মালপত্র নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন তার থেকে মদিরার পাত্র বের করে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে শ্রীকৃষ্ণ বলরামকে বললেন "অগ্রজ, দ্বারকায় সমস্ত সুরার বিপণিগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও এত সুরার পাত্র কোথা থেকে এলো?" চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে উঠলেন। তিনি আবার একবার বুঝতে পারলেন মানুষের যখন নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয় তখন তার থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি দেখলেন অস্ত্রপৃষ্ঠে সাত্যকি এবং কৃতবর্মা তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। সাত্যকি এসে বললেন “আপনি শান্ত হোন, মদিরা যাদব জীবনে এবং সেনাবাহিনীতে নতুন কিছু নন। আমরা দ্বারকা নগরী অতিক্রম করে চলে এসেছি এই পথে যদি মদিরা পান করে সকলেই তাহলে দোষের কি আছে?" কৃষ্ণ বললেন “না মদিরা পান করে তারা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতে শুরু করবে যা কোনমতেই কাম্য নয়।“ কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন আর কঠোরতা আরোপ করে লাভ নেই। কোনভাবে আগামীকাল প্রভাসের পুণ্য সলিলে যদি এই দ্বারকাবাসীদের অবগাহন করানো যায় তাহলে তারা হয়তো বা মুক্ত হতে পারবে। তাদের মধ্যে এক নতুন মানুষের জন্ম হবে। রাত্রিতে প্রভাসের অদূরে নিশিযাপনের ব্যবস্থা করা হলো। কৃষ্ণ স্বয়ং তৃণশয্যায় শয়ন করলেন। কি যেন এক অজানা আশঙ্কায় তার মন ভারাক্রান্ত ছিল। রাত্রির মধ্যযামে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন আকাশে অসংখ্য প্রজ্জ্বলিত নক্ষত্র। সেই উজ্জ্বল আকাশের দিকে একদৃষ্ট তাকিয়ে তাঁর মনে হল যাদবদের জীবনে কি এইরকম উজ্জ্বল দিন ফিরে আসবে? পরদিন প্রত্যূষে পুনরায় যাত্রা শুরু হল। তাঁরা প্রভাস তীর্থে এসে উপস্থিত হলেন। 
                                            পরবর্তী অংশ ৩৮তম পর্বে..............

Post a Comment

0 Comments