জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৮/ বিজন সাহা

উসপেনস্কি সাবর ও প্রেচিসতেনস্কি টাওয়ার, আস্ত্রাখান ক্রেমলিন

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৮  

বিজন সাহা  

আস্ত্রাখান 

তুষারের অফিস থেকে চা খেয়ে আমরা বেরুলাম ক্রেমলিনের উদ্দেশ্যে। খুব বেশি দূরে নয়। পথে ও নিয়ে গেল নিজের আরেকটি মার্কেটে। সেখানেই পরিচয় হল এক ছেলের সাথে। কতই বা বয়েস – ৩০ – ৩২? জানলাম ওর বাবুশকা মানে দিদিমাকে কাজাখস্তানে নির্বাসিত করা হয়েছিল, ওর মায়ের জন্ম ওখানেই। বললাম 

আমরা ওনাদের সাথে দেখা করে কথা বলতে চাই। এর আয়োজন করা কি সম্ভব?
দেখুন, ওনারা শহরের এখন  বাইরে। তাছাড়া বাবুশকা এ নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে চান না। আমি জিজ্ঞেস করে দেখব, যদি রাজী হন জানাব।
ঠিক আছে। আমরা আরও কয়েক দিন এখানে আছি। তুমি জিজ্ঞেস করে আমাদের অবশ্যই জানিও। 

ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেলাম ক্রেমলিনের দিকে। পথে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনাদের স্মৃতিস্তম্ভ। এখানকার বাড়িঘর অনেকটা সাঙ্কত পিতেরবুরগের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেকটা সেই ফ্যাশনেই তৈরি। কিছুটা দূরে দেখা গেল ক্রেমলিন। ধবধবে সাদা। মস্কো আর নিঝনি নভগোরাদের ক্রেমলিন বাদে আমার দেখা আর সমস্ত জায়গার ক্রেমলিনের রংই সাদা দেখেছি। আমরা ক্রেমলিনে ঢুকলাম প্রেচিস্তেনস্কি তোরণ দিয়ে। ক্রেমলিনে ঢুকেই চোখে পড়ল বিশাল গির্জা – উস্পেনস্কি সাবর। একটু দূরে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে। মনে হয় কোন উপলক্ষ্যে কনসার্টের জন্য। বেশ জায়গা নিয়ে তৈরি এই ক্রেমলিনের ভেতর রয়েছে সুন্দর সুন্দর গাছ আর ফুলের বাগান। সব দেখে মনে হল আবাসিক ঘর বা প্রাসাদগুলো প্রায় দেয়াল ঘেঁষে। তাদেরই একটা ত্রোইৎস্কি সাবর। সত্যি বলতে কী এখানেও তাড়াহুড়োর কারণে খুব বেশি সময় কাটাতে পারিনি। হাঁটা পায়ে কিছু ছবি তুলে চললাম শহর দেখতে। আসলে আমি যখন বিভিন্ন এক্সারশনে যাই, যখন পথেই কাটে ৭-৮ ঘণ্টা আর দেখার জন্য থাকে ৫-৬ ঘণ্টা, তখনও এর চেয়ে অনেক বেশি দেখার সুযোগ করে নেই। তবে প্রায়ই যেটা হয় আমি যখন এদিন সেদিক ঘুরে ছবি তুলি, অন্যদের অপেক্ষা করতে হয়। এসব গ্রুপে সাধারণ আমিই একমাত্র পুরুষ প্লাস বিদেশী। তাই কেউ কিছু বলে না। গুলিয়া সাথে থাকলে অবশ্য তাড়া করে। 

ত্রোইস্কি সাবর, আস্ত্রাখান ক্রেমলিন

আস্ত্রাখান! ভোলগা তীরের শেষ শহর। বিভিন্ন সময়েই এই নাম শুনেছি। তবে রাশিয়ার জনপ্রিয় সিনেমা «ইভান ভাসিলিয়েভিচ পেশা বদলালেন» নামে এক কমেডিতে এই নামটি শুনেছি বলে এখনও মনে আছে। টাইম মেশিনে সোভিয়েত বাস্তবতায় ফিরে আসা ইভান গ্রজনি পুলিশের জেরায় বলেন কাজান জয় করেছি, আস্ত্রাখান জয় করেছি। অবশ্য পুলিশের প্রশ্ন ছিল ভিন্ন, রুশ ভাষার মারপ্যাচে সেটা এক হাসির ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। 

🍂

ধারণা করা হয় যে আস্ত্রাখান নামক এই জনপদের উৎপত্তি ত্রয়োদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে শহরের গোড়াপত্তন ঘটে সেই সময়ে যখন গোল্ডেন হোর্ডের এলিট শ্রেণী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আর মুসলমান সমাজের ধর্মীয় নেতারা খানদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধা পেতে শুরু করে। গিলম দে রুবরুক ১২৫৪ সালে এই এলাকা ভ্রমণ করেন লিখেছেন যে ইতিলি নদীর দক্ষিণ তীরে একটি জনপদ আছে যা বাতু খানের ছেলে সারতাকের শীত প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে খানের আদেশে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়। ১৩৩৩ সালে আরব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা উজবেক খানের সাথে এই এলাকা ভ্রমণ করেন এবং সেখানে হাজি-তারখান নামে এক শহরের উল্লেখ করেন। মধ্য যুগের মানচিত্রে হাজি-তারখান ভোলগার পশিম তীরে অবস্থিত এবং বর্তমান আস্ত্রাখানের চেয়ে কিছুটা উজানে অবস্থিত। সেই পুরানো শহরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে শারেনি বুগর নামক এক ছোট্ট শহরে পাওয়া গেছে। বানিজ্য পথের সংযোগস্থলে অবস্থিত বিধায় হাজি-তারখান দ্রুত গোল্ডেন হোর্ডের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। এটা ছিল পূর্ব – পশ্চিমে বিস্তৃত বানিজ্য পথের গুরুত্বপূর্ণ ট্র্যানজিট। এই পথে এশিয়া থেকে সিল্ক, মশলা সহ বিভিন্ন সামগ্রী ভেনিস ও জেনোয়ায় যেত। আস্ত্রাখান ছিল পোড়া ইটের  তৈরি। খননকার্যে পাওয়া নমুনা থেকে ধারণা করা যায় যে এখানে মৃৎশিল্প ও ধাতব শিল্প বেশ উন্নত ছিল। ১৩৯৫ সালের শীতে এখানে তৈমুর লঙের সেনা সমাবেশ ঘটে। শোনা যায় সে সময় নগরবাসীরা ভোলগার বুকে বরফের দেয়ালে তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেও নগর কর্তারা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। তৈমুর লঙ শহর লুটতরাজের জন্য সেনাদের হাতে ছেড়ে দেয় এবং লুট শেষে শহর পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ১৪৫৯ সালে আস্ত্রাখান সুলতানাত প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে এই শহর পুনর্নির্মাণ করে একে রাজ্যের রাজধানী করা হয়। ১৪৬৯ সালে আফানাসি নিকিতিন আস্ত্রাখান ভ্রমণ করেন। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে আস্ত্রাখান তুরস্ক, ক্রিমিয়া ও নোগাই রাজ্যের সুলতানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাদের মধ্যে বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৫৩৩ সালে প্রাসাদে রুশপন্থী দল গড়ে ওঠে যাদের সহযোগিতায় মস্কোর জারের সাথে আস্ত্রাখানের বানিজ্য ও রাজনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৫৩৭ থেকে ১৫৫২ সাল পর্যন্ত এখানে চার বার ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে। ১৫৫২ সালে আস্ত্রাখানে ক্ষমতার আসে রুশ বিরোধী রাজা ইয়ামগুরচি। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ইভান গ্রজনি ইউরি প্রনস্কির নেতৃত্বে ৩০ হাজার তীরন্দাজ বাহিনী পাঠান। এই বাহিনী ১৫৫৪ সালে আস্ত্রাখান দখল করে মস্কোপন্থী দেরভিশ-আলীকে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু নতুন সুলতান ক্রিমিয়ার সুলতানের সাথে আঁতাত করে আস্ত্রাখানের রুশপন্থীদের হত্যা করে রুশ বাহিনীর উপর হামলা করে। ১৫৫৬ সালে ইভান গ্রজনি নতুন করে সেনা পাঠান। এরপর আস্ত্রাখান সুলতানাত বিলুপ্ত করা হয় এবং আস্ত্রাখানকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজ্যের সব নাগরিক রুশ জারের বশ্যতা স্বীকার করে। আস্ত্রাখানের প্রথম রুশ সেনা শাসক ছিলেন ইভান চেরেমিসিনভ। ১৫৫৮ সালে শুরু হয় শহর নির্মাণের কাজ। ১৫৫৯ সালে ভোলগার উঁচু তীরে দুর্গ শোভা পেতে থাকে যার চারিদিকে ছিল কাঠের দেয়াল আর খাত। ১৫৮২ সালে কাঠের জায়গা দখল করে ৮ টি টাওয়ার সহ পাথরের দেয়াল যা হয় পরবর্তীতে আস্ত্রাখান ক্রেমলিনের ভিত্তি। 

প্রাশাসনিক ভবন, আস্ত্রাখান ক্রেমলিন

ভোলগা বানিজ্য পথের গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে প্রকাশ পেলেও ধীরে ধীরে আস্ত্রাখান ক্রিমিয়ার খানদের সাথে যুদ্ধের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। তখন সেখানে ছোট বড় মিলে ৫০০ জাহাজ ছিল। আস্ত্রাখান মস্কোর জারদের জন্য শুধু সীমান্তবর্তী সামরিক ঘাঁটিই ছিল না, এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের তোরণও ছিল। ১৫৬৯ সালে তুরস্ক ও ক্রিমিয়া একযোগে দশ দিন ধরে আস্ত্রাখান অবরোধ করেও জয় করতে পারেনি। ১৬১১ সালে অরাজকতার সময় নকল দ্মিত্রি পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিলে আস্ত্রাখানের চোর উপাধি পায়। ১৬৭০ সালে বিদ্রোহী কসাকরা শহর অবরোধ করলে শহরবাসী স্তেপান রাজিনের দলে যোগ দেয়। ১৭৬৭ থেকে ১৬৭১ সাল পর্যন্ত চলমান এই অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে স্তেপান রাজিন রুশ সেনাপতিকে হত্যা করে। এক বছর পরে রুশ সেনাবাহিনী আস্ত্রাখান অবরোধ করলে আড়াই মাস প্রতিরোধের পর নগরবাসী আত্মসমর্পণ করে। ১৬৯২ সালে এখানে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। শহরের ১৬ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ১০ হাজার মৃত্যুবরণ করে। অষ্টদশ শতকে এই এলাকায় দ্রুত রুশ কলোনি গড়ে ওঠে। ১৭১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আস্ত্রাখান কাউন্টি। এরপর বিভিন্ন সময় আস্ত্রাখান কাউন্টির আয়তন বদলাতে শুরু করে যার মূল কারণ ছিল অনবরত রাশিয়ার সীমান্ত পরিবর্তন। ১৭৪০ – ৪৫ সালে তাতিশেভের নেতৃত্বে আস্ত্রাখান ক্রেমলিন ও শহরের চারপাশের দুর্গগুলোকে শক্তিশালী করা হয়। ১৬৯৯ সালে এখানে ভজনেসেনস্কি পুরুষ মনাস্তির নির্মিত হয় যা পরবর্তীতে ব্লাগোভেসানস্কি গির্জায় রূপান্তরিত হয়। ১৭৩৮ সাথে এখানে মহিলাদের মনাস্তির কাজ করতে শুরু করে। ১৮৯৭ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী এখানে ১১২৮৮০ জন লোক বাস করত যাদের মধ্যে রুশ ভাষাভাষী ৮৬৫৬৩, তাতার ১৫৩৫৫, আর্মেনিয়ান ৪০৩৮, হিব্রু ২১১৫ ও জার্মান ১৫৭৩ জন। এ থেকে সেই সময় এই এলাকার জনগোষ্ঠীর একটা ধারণা পাওয়া যায়। অক্টোবর বিপ্লবের পর এখানে দুই সপ্তাহ ধরে সংঘর্ষ চলে, ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে আস্ত্রাখানে সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১৯২০ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত আস্ত্রাখান কালমিকি প্রদেশের রাজধানী ছিল। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৪ সালে পর্যন্ত আস্ত্রাখান নিঝনি-ভোলঝস্ক অঞ্চলের, ১৯৩৪ সাল থেকে স্তালিনগ্রাদ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪২ সালে জার্মান বাহিনী আস্ত্রাখানের ১০০ – ১৫০ কিলমিটারের মধ্যে চলে আসে। ১৯৪৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর আধুনিক আস্ত্রাখান অঞ্চল গঠন করা হয়। ১৯৫০ – ১৯৬০ এর দশকে আস্ত্রাখান পুনর্নির্মাণ করা হয়। নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় আস্ত্রাখান ক্রেমলিন। ২০০৮ সালে আস্ত্রাখান ৪৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহরবাসীদের বীরত্ব অমর করে রাখার জন্য ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর আস্ত্রাখানকে শ্রম বীরদের শহর উপাধি দেয়া হয়।             

আস্ত্রাখানের ভিডিও  
https://www.youtube.com/watch?v=uBvwSs41r98&t=14s

ছবিতে আস্ত্রাখান 
http://bijansaha.ru/album.php?tag=264

🍂


Post a Comment

0 Comments