বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ২৪
কলা
ভাস্করব্রত পতি
কলাগাছের মধ্যে নাকি লক্ষ্মী বাস করে। এই বিষয়ে একটি সুন্দর কাহিনীর সন্ধান মেলে। কোনও এক স্থানে একটি বাচ্চা মেয়ে প্রতিদিন একটি কলাগাছে জল ঢালতো। একদিন সেই কলাগাছটি বলে উঠলো, 'তুমি আমার সঙ্গে খেলতে চাও?' কিন্তু মেয়েটি এতে খুব ভয় পেয়ে বাড়ি চলে গেল এবং মাকে সব জানালো। তর মাা বললেন যে কলাগাছে লক্ষ্মী বাস করে। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং কলাগাছটি যা যা বলবে, তা শুনে চলা উচিত।
পরদিন আবার যখন মেয়েটি কলাগাছে জল ঢালতে গেল, তখন তাঁর সাথে দেখা হল লক্ষ্মীদেবীর। তাঁরা দু'জনে খেলাধুলা করল মন খুলে। এরপর লক্ষ্মীদেবী তাঁকে সাথে নিয়ে কলাগাছের মধ্য দিয়ে পৌঁছে গেল একটা রাজপ্রাসাদে। সেখানে মেয়েটির খুব আপ্যায়ন করা হল। সোনার থালায় রাজভোগ খেতে দেওয়া হল। বাড়ি ফিরে মাকে সব কথা খুলে বলায় তাঁর মা তাঁকে নিজের বাড়িতে লক্ষ্মীদেবীকে আমন্ত্রণ জানানোর উপদেশ দিল। এদিকে মেয়ে ভাবলো, 'তা কী করে সম্ভব! লক্ষ্মী কত ধনী, রাজপ্রাসাদ, সোনার থালায় রাজভোগ খায়। আমরা গরিব গুর্বো, নড়বড়ে বাড়ি। তাঁকে নেমন্তন্ন করা কি সাজে?' মা বললেন, 'তবুও তাঁকে নিমন্ত্রণ করা উচিত'।
পরের দিন মেয়েটি যখন লক্ষ্মীদেবীকে সঙ্গে করে যেই মুহূর্তে বাড়িতে পা রাখলো, তৎক্ষণাৎ তাঁদের কুঁড়েঘর বদলে গিয়ে হয়ে গেল সুন্দর অট্টালিকায়। বাড়ির সব খাবার দাবার হয়ে গেল ঠিক রাজবাড়ির মতো! সবকিছুই সোনার। মেয়েটি লক্ষ্মীদেবীকে তাঁদের সঙ্গে থেকে যেতে অনুরোধ করলো। তখন লক্ষ্মীদেবী বললেন, 'আমার আশীর্বাদ তোমাদের সঙ্গে থাকছে। তোমরা কঠোর পরিশ্রম করে যাও এবং নিয়মিত কলাগাছে জল দিয়ে যাও। এতে তোমাদের কোনো দুঃখ থাকবে না'। এতে মেয়েটি প্রতিদিন নিয়ম করে কলাগাছে জল দিতে থাকলো। আর তাঁদের কোনো দুঃখ থাকলোনা।
পাকা কলার কাঁদি
দুর্গা আরাধনায় এই কলাগাছই হয়ে ওঠে 'কলা বৌ'। যা মহাসপ্তমীতে প্রবেশ করে দেবীর পূজা স্থানে।
“গণেশদাদা পেটটি নাদা / গায়ে মেখেছ সিঁদুর / কলাগাছকে বিয়ে করেছ / বাহন তোমার ইঁদুর”।
পশ্চিমবাংলার হিন্দুদের প্রতি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেই কলা এবং কলার ছড়া দরকার। বিশেষ করে বরণডালাতে। পুজোর ঘটস্থাপন এবং আশীর্বাদের কুলোয় কলার ছড়া লাগবেই। পুজোর প্রসাদপ্রসাদ নিবেদন করা হয় কলাপাতায়। প্রসাদে অন্যান্য ফলের সঙ্গে কলার ব্যবহার রয়েছে। বিহারীদের ছট পূজায় অন্যতম উপকরণ এই কলা। আবার কলাগাছকে দেবী পার্বতীর অবতার হিসেবে ভাবা হয়। পূর্ব ভারতে বিয়ের বাসরের এক কোনায় একটি কলাগাছ রাখা হয়। পশ্চিমবাংলায় কলাগাছের তৈরি ছাদনাতলায় হিন্দুদের বিবাহের আয়োজন করা হয়। গৃহপ্রবেশ বা গৃহে আয়োজিত যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বাড়ির চার কোনে চারটি কলাগাছ রাখা হয়। পশ্চিমঘাট এলাকায় কলাগাছ নন্দাদেবী হিসেবে কল্পিত। এজন্য নন্দাদেবীর ছবি কলাগাছে আঁকা হয় এবং কার্তিকমাসে নদীতে কলার খোলের নৌকো ভাসানো হয়। আদম এবং ইভের লজ্জা নিবারণের প্রথম আচ্ছাদন ছিল কলাগাছের পাতা। এই কলাপাতায় ভাত খাওয়ার মজা এবং আনন্দটাই আলাদা। দোলের সময় চাঁচরি বানিয়ে জ্বালতে শুকনো কলাপাতার জুড়ি মেলা ভার। কলার মোচা এবং কলা থোড় বাঙালির হেঁশেলে অতি জনপ্রিয় রান্নার উপাদান। হাতিরা খুব কলাগাছ খেতে খুব পছন্দ করে। বাঁদর, হনুমানদের কাছে অতি প্রিয় ফল হল -- কলা।
'এই হনুমান কলা খাবি?
জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি?'
উদ্ভিদবিজ্ঞানী মালান জানিয়েছেন, ভারত ও চিন কলার উৎপত্তিস্থল। তবে উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিলের মতে, পাকিস্তান, ভারত ও মালয়তে কলার আসল জন্মস্থান। উদ্ভিদবিজ্ঞানী Rumphnis এর কথায়, পূর্বভারতে গঙ্গানদীর দু পাড়ে প্রথম উৎপাদন হতে শুরু করে কলাগাছ। পরবর্তীতে এখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে আরব, পারস্য, মিশর, সিরিয়ায়। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের 'কলাগাছ' বলে ব্যঙ্গ করা হয়। কলার বিজ্ঞানসন্মত নাম MUSA SAPIENTUM। এটি Musaceae পরিবারভুক্ত।
হিন্দিতে কলাকে বলে কেলা, কেরা। গুজরাটিতে কেনা, সংস্কৃতে কদলী, ইংরাজীতে BANANA, তামিলে কাঠেট, রম্ভ, হুগালী, অসমীয়াতে মেয়জ, ফার্সীতে মাঙ্গ, মহারাষ্ট্রে কেলি, তেলুগুতে অরিতি, চন্দ্রাকেলী, মালয়লামে কেঠ, বালি দ্বীপ এলাকায় বিষ্ণু, ওড়িয়াতে বেস্তল, সিংহলে কহিকাং এবং জাপানী ভাষায় গড়ং বলা হয় কলাকে। এছাড়া আমরা কলাকে অন্য যেসব নামে জানি যেগুলি হল রামরম্ভা, অনুপাম, মর্ত্যমান, অপরিমর্ত্য, মদলী, মদনা, মনুয়া, মালভোগ, রঙ্গবীর, পোকা রঙ্গবীর, দয়ে কলা, ডোগরেকলা, সয়াকলা, সফরীকলা, চিনিচাঁপা, অংশুমৎফলা, কদল, বারবুষা, চর্মস্বতী, বারণবল্লভা, পোচক, রোচক, মোচক, গুচ্ছফলা, হস্তিবিধানী, গুচ্ছদন্তিকা, বনলক্ষ্মী, ভালুকলা, নিঃসারা, বালকপ্রিয়, রাজেষ্টা, সকৃৎফলা, সুকুমার, সুফলা ইত্যাদি।
চেন্নাইতে মেলে পেবেলি, পাছা, মেবেল্লি, রসখলি, গণ্ডি, যেনে পানিয়ামনে পিদিমোথে, সেরব, যমেই, পে, বেঙ্গলা ইত্যাদি কলা। আমাদের রাজ্যে মেলে চাঁপা, মর্ত্যমান, সিঙ্গাপুরি, কাকুলী, বিচিকলা, কাঁচকলা ইত্যাদি। আসামে মেলে কনকধোল, বরমানি, ভীমকলা, ভোট মনুহর, পুরা, দাখজোয়া, জাহাজি, মালভোগ, ছেনিচম্পা, আঠিয়া, জেপা আঠিয়া ইত্যাদি। মুম্বাইতে মেলে করঞ্জেলি, বেসকেলি, নরসিঙ্গি, বজেলি, রসরই, মুখেলি, ওম্বডি, লোখণ্ডি, সোনকেলি ইত্যাদি কলা। সম্পূর্ণ বীজমুক্ত কলার প্রজাতি হল -- সবরিকলা, অমৃতসাগর, অগ্নিশ্বর, দুধসর, দুধসাগর। অল্প বীজযুক্ত কলা হল -- চাঁপা, চিনিচাঁপা, কবরী, চন্দন কবরী, জাবকাঠাল। বীজযুক্ত কলা হল -- বতুর আইটা, গোমা, সাংগী আইটা। আর আনাজী কলা হল -- ভেড়ার ভোগ, চোয়াল পউশ, বর ভাগনে, বেহুলা, মন্দিরা, বিয়ের বাতি।
ভারতের বৃহত্তম কলা উৎপাদনকারী রাজ্য হল অন্ধ্রপ্রদেশ। এখানে উৎপাদন হয় দেশের মধ্যে ১৬.২৭ শতাংশ কলা। দ্বিতীয় স্থানে গুজরাট (১৪%) এবং তৃতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র (১৩%) রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের স্থান নবম (৩.৯০%) । এখানে বছরে ১২০০ টন কলা উৎপাদিত হয়। ভারতে চাষ করা সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় প্রজাতির কলা হল ক্যাভেন্ডিশ, নেন্দ্রান, বসরাই, রোবুষ্টা, পুভান, নয়ি পুভান, গ্র্যাণ্ড নাইন, লাল কলা, কারপুরাভাল্লি ইত্যাদি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেসব ভালো প্রজাতির কলার চাষ হয় ---
পশ্চিমবঙ্গ -- ডোয়ার্ফ ক্যাভেন্ডিশ, কাঁথালি, চাঁপা, সিঙ্গাপুরী, জায়ান্ট গভর্নর, মর্টম্যান।
গুজরাট -- বামন ক্যাভেন্ডিশ, G-9, হরিচল, অবস্থান, বসরাই, রোবাস্তা, গান্দেবী নির্বাচন, শ্রীমত, হরিচল (লোখান্দি)
অন্ধ্র প্রদেশ -- বামন ক্যাভেন্ডিশ, কার্পুরা পুভান, ইয়েনাগু বোঁথা, চক্রকেলি, রোবাস্তা, রাসথালি, অমৃতপান্ত, চক্রকেলি, মন্থন, থেল্লা।
ওড়িশা -- বামন ক্যাভেন্ডিশ, রোবাস্তা, চম্পা, ডিপটকাপুরা (রাস্তালী)।
মহারাষ্ট্র -- বামন ক্যাভেন্ডিশ, লাল ভেলচ, লাল ভেলচি, গ্র্যান্ড নাইন, শ্রীমন্তী, বসরাই, লাল কলা, রোবাস্তা, সফেদ ভেলচি, রাজেলি নেন্দ্রান।
কর্ণাটক -- বামন ক্যাভেন্ডিশ, এলাক্কি বেল, রোবাস্তা, রাস্থালি, পুভান, মন্থন।
আসাম -- বামন ক্যাভেন্ডিশ (জাহাজি), কাঁচকোল, চিনি চম্পা, ভীমকোল, জাটিকোল, ভারত সোম, মালভোগ, বোরজাহাজি (রোবস্তা), হোন্ডা, মানজাহাজি, চিনিয়া (মনোহর), ডিগজোওয়া, কুলপাইত।
বিহার -- বামন ক্যাভেন্ডিশ, গৌড়িয়া, চিনিয়া, মুঠিয়া, আলপন, চিনি চম্পা, মালভিগ, কোঠিয়া।
কেরালা -- পালায়নকোদন (পুভান), নেন্দ্রান (প্লান্টেন), রাস্থালি, মন্থন, লাল কলা, রোবাস্তা।
তামিলনাড়ু -- নেন্দ্রান, সাক্কাই, পেয়ান, মাট্টি, রোবস্তা, লাল কলা, পুভান, রাস্থালি, বিরুপাক্ষী, মন্থন, কারপুরাভাল্লি।
ঝাড়খণ্ড -- সিঙ্গাপুরী, বসরাই।
ইকুয়েডর হল বিশ্বের বৃহত্তম কলা রপ্তানিকারক দেশ। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স এবং কোস্টারিকাও কলা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিগণিত। তবে বিশ্বের সেরা কলা উৎপাদনকারী দেশ হল চিন।
মহাভারতে একটি সুন্দর কাহিনী রয়েছে কলাকে কেন্দ্র করে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিদুরের বাড়িতে গেলেন। সেইসময় বিদুর বাড়িতে ছিলেন না। বিদুরের পত্নী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে বিমোহিত হয়ে হাতের কাছে থাকা কলা খেতে দিলেন। কিন্তু তিনি বিহ্বলচিত্তে কলা ছাড়িয়ে কলার খোসাটাকেই শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করলেন ততোধিক শ্রদ্ধায়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ এতে রেগে গেলেন না। বরং কলার খোসা তৃপ্তি সহকারে খেলেন। আসলে বিদুরপত্নীর আতিথেয়তায় তিনি লক্ষ্য করেছিলেন পরম ভক্তিভাব। ফলে তিনি কলার খোসাটাকেই আনন্দে খেয়ে ফেলেন। মহাভারত অনুসারে কুবেরের বাড়ি পুষ্করিণীর তীরে অবস্থিত কলাবনে।
খনার বচনেও কলাগাছের উপস্থিতি পাই -- 'কলা লাগিয়ে না কাট পাত / তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’। এছাড়াও এখানে আছে -- 'ডাক ছেড়ে বলে রাবণ / কলা রোবে আষাঢ় শ্রাবণ’ এবং ‘তিন শত ঝাড় কলা রুয়ে / থাক গৃহী ঘরে শুয়ে'। কাউকে ঠকানো হলে তখন বলা হয় 'কলা দেখানো'। আর কিছু না দিলে বলা হয় 'অষ্টরম্ভা'। কলার মধ্যে মূলত Serotonin, Tryptophan, or-epinephrine, 3,4-dihydroxy phenylalanine এবং Catecholanine থাকে। কলা খেলে তাৎক্ষণিক শক্তি মেলে। কলাতে আয়রন থাকে। কাঁচকলা এবং মোচার তরকারি ডায়াবেটিস রোগীদের মহৌষধ। পেটের রোগীদের জন্য কাঁচকলা দিয়ে সেদ্ধ ঝোল উপকারী। এছাড়া কোলনের রোগ, পেপটিক আলসার, নেফ্রাইটিস, গাউট, হাইপারটেনশন ইত্যাদি রোগকে প্রশমিত করে।
🍂
0 Comments