আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
চতূর্বিংশ পরিচ্ছেদ
অবশেষে তৃতীয় দিনের ভোরে ট্রেন পৌঁছয় দেবভূমি হরিদ্বার।
বিশাল ইষ্টিশান, লোকে লোকারণ্য। পূণ্যার্থী-অভিযাত্রী সব মিলে মিশে একাকার।ট্রেন থেকে নেমে সমস্ত জিনিসপত্র মিলিয়ে দেখতে দেখতে দাদা কুলীদের সঙ্গে দরদস্তুর করছিলেন,তাঁরা দুই অসমবয়সী নারী ঘোমটার আড়ালে সেই প্রথম অবাক দৃষ্টিতে বহির্বিশ্বের রূপ-রস-গন্ধ আহরণ করতে লাগলেন।বিরজা তো আজন্মই একটু অন্যধরনের,পিসিমার মতো পোড় খাওয়া সংসারী নারীর চোখেও এক অন্য আলো দেখতে পেলেন বিরজা।
শেষে কুলী ঠিক হলো, সবার সামনে ইষ্টিশানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাওয়াও হলো,বাইরে বেরিয়ে ছ্যাকরা গাড়িতে ওঠাও হোলো;সবই জীবনে সেই প্রথমবার। তারপরে,লটবহর সাজিয়ে যাত্রা শুরু করলেন কন্খলের উদ্দেশ্যে, সেখানেই দাদার গুরু মহারাজের আশ্রম। যেতে যেতে দু চোখ ভরে দেখছিলেন পাশে পাশে চলা উচ্ছল গঙ্গা, তার কোলে গাছগাছালি ছাওয়া দূরের পাহাড়, হিমেল হাওয়া,হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ধূপ-ধূনো-ফুলের পূজা গন্ধ। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল পথের পাশের দোকানের টগবগ করে ফোটা রাবড়ীর গন্ধ… আহা! সে কি অপূর্ব অনুভূতি!
সঙ্গে চলা অন্য যাত্রীদের সঙ্গে দাদার মামুলি আলাপও মাঝে মধ্যে কানে আসছিল।
ক্রমে পথশেষে আশ্রম। সেখানে তখন চলছিলো প্রভাতী আরতি। হা-ক্লান্ত শরীরে প্রণাম সেরে গেলেন মন্দিরের পেছনের আতিথ্শালায়। বড়ো লম্বা দোচালা ঘর, মাটিতেই শোওয়ার ব্যবস্থা। বাইরে চানঘর। বিরজার জানা ছিল চান ঘরের কথা, ওর কলকাতার শউরবাড়িতে তা ছিল, পিসিমা জানতেন না ওভাবে কেউ স্নান-বাহ্য করে বলে। তিনি প্রথমে আপত্তি করলেও উপায়হীন হয়েই যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, পরে অভ্যস্তও।পিসিমাকে গুছিয়ে জামাকাপড় ধুয়ে নিজে স্নান করে আসতে না আসতেই এক হিন্দুস্হানী বৌ দুটি বালতি করে ভাত ও ডাল নিয়ে এলো।
তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন আরও একটি বাঙালি পরিবার।বাবা-মা,ভাই এবং মেয়ে-জামাই। জামাই দিল্লীতে কাজ করে।বৌকে নিয়ে ফেরার সময় শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে। এমন সব গল্প করছিলেন পিসিমার সঙ্গে সেই মা। মেয়েটি বসেছিল দূরে।
বিরজা ভাবছিলেন,যাহোক,একটা সঙ্গী তো পাওয়া গেল… ওনাদের বাবা ও জামাই ছেলেদের দিকে আছেন, নিশ্চয়ই দাদার সঙ্গে দেখা হবে…
বিগত তিনদিনের অন্ন বিরহিত দিন যাপনের পরে গরম ভাতের গভীর সুগন্ধে প্রাণমন যেন ভরে উঠলো বিরজার। সামান্য ঘী ছড়ানো সমস্ত সবজি মেশানো ডাল এবং আতপ চালের ভাত, এই ছিল আয়োজন। তবু স্নানান্তে সে অন্নভোগ যে জীবনস্পৃহা কতখানি উজ্জীবিত করে, সেদিন আবার বুঝলেন বিরজা।
মনে আছে, খাওয়া সেরে চোখে নেমে এসেছিল দারুণ ঘুম। বিকেলবেলা পাশের মহিলাদের ডাকে যখন সে ঘুম ভাঙে, বাইরে তখন সন্ধ্যা হয় হয়। তড়িঘড়ি গা-কাপড় ধুয়ে পিসিমাকে নিয়ে মন্দিরে পৌঁছতেই দাদা এগিয়ে এলেন,
-’শরীর ঠিক আছে তো মা!’
-’হ্যাঁ বাবা। এখানে এসেই তো আমার শরীরের সব ব্যথা উধাও হয়ে গেছে। কাল সকালে গঙ্গাস্নানে যাব তো?’
-’আজ থেকে তুমি গঙ্গাস্থানই করছো তো মা। এখানের সব জলই গঙ্গাজল।
এখন চলো, গুরুজীর সঙ্গে আলাপ করে আমরা ঘাটে যাই, সন্ধ্যারতি দেখে আসি, কাল সকালেই তো আমরা আবার বেরিয়ে পড়বো গো।’
এই সব মামুলি কথাবার্তা বলতে বলতেই গুরু মহারাজের কাছে গেলেন সকলে।
প্রশান্ত দর্শন এক সৌম্য মানুষ,জটা-গেরুয়ার বাহুল্য নেই, আন্তরিক ব্যবহারে কাছে টেনে নিলেন প্রিয় শিষ্যের মা এবং বোনকে।বোধগম্য ভাঙ্গা হিন্দিতে কুশল বিনিময় এবং খানিক আলাপচারিতা চলেছিল। পরে দাদার কাছে শুনেছিলেন, তিনিই নাকি তাঁদের তীর্থযাত্রার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন অন্য এক শিষ্য পরিবারের সঙ্গে, যেন মা-বোনকে নিয়ে দাদা অপরিচিত পথে বিব্রত না হন।
🍂
সেদিন অবাক হয়েছিলেন,পরে অবশ্য আরও অনেক ঘটনায় প্রমাণ পেয়েছেন বিরজা, স্বার্থহীন শুভকামনাই মানুষকে মুক্ত করে, পূর্ণ করে।
যাহোক, গুরু মহারাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আশ্রমের ফটক পেরিয়ে আরও কয়েকজন আশ্রমিকের সঙ্গে অন্ধকার হিমেল হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে অতঃপর তাঁরা পৌঁছলেন নদীতীরে, অসংখ্য দীপের মালা নদীবক্ষে কেমন যেন এক স্বপ্নময় পরিবেশ রচনা করেছে, আরও এগিয়ে ‘হর-কী-পৌড়ি’ ঘাটের আলোক বন্দনায় যার পরিতৃপ্তি।
আহা! কি অপূর্ব! কী অপূর্ব সে দৃশ্য! পাথর বাঁধানো ঘাট জুড়ে অগণিত সাধু সন্তের হাতে প্রদীপ, তাঁরা সবাই সুললিত মন্ত্রোচ্চারণে বন্দনা করছেন সুরধুনী দেবী গঙ্গাকে;আশেপাশের পূণ্যার্থীদের হাতেও কলা খোলের ‘ভাসাই’, ফুল এবং দীপ সাজিয়ে তাও ভাসানো হচ্ছিল প্রিয়জনের মঙ্গল কামনায়।
তাঁরাও দীপ জ্বালালেন, দীপ ভাসালেন। মনে মনে মঙ্গল প্রার্থনাও করলেন,তবু সেই তারা ভরা রাতের আকাশের তলায় উন্মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে কি যেন এক নিরাসক্তি গ্রাস করলো সবাইকে আশ্রমে ফেরার পথে।
পরের সকালে শুরু হয়েছিল সত্যিকারের যাত্রা, স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনায় ঘুম হয়নি রাতে। একখানা গাড়ি বোঝাই করে মালপত্র তুলে তাঁরা প্রায় দশজন এগোলেন বারকোট বলে এক পাহাড়ি গাঁয়ের পথে, যেতে যেতে পথের দুদিকেই অজস্র ঝর্ণা-ঝোরা,মুসৌরি পাহাড়ের কেম্পটি ঝর্ণা, ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম পড়লো। দুচোখ ভরে দেখা, শুধু দেখা…এতো ঐশ্বর্য ছড়ানো থাকে প্রকৃতির কোলে!
তবে শুধু চোখের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে তো দেহের ক্ষুধা মেটে না, অগত্যা দাঁড়াতেই হয়েছিল বারকোটে। কিছু খাবার, সবজি-ডাল-আচার… চারিদিকে অচেনা মানুষ, অচেনা পরিবেশ, ঘোমটা খোলা চোখের সামনে কুমারী প্রকৃতি…
অনেক কিছু না-পাওয়া জীবনে এইটুকু দান, দুহাত ভরে উপচে পড়েছিল যেন অনন্ত আশীর্বাদের মতো,এমনটাই মনে হয়েছিল তাঁর।
আসলে, ইদানীং কেন কে জানে, প্রতিদিনের জীবন থেকে ছুটি চাইছিল মন, কেমন যেন বৈরাগ্য বিবশ দশা গ্রাস করছিল তাকে এবং সেই মুক্তি সন্ধানই দাদার কাছে হঠাৎ প্রস্তাব পেশ… এবং তার অতর্কিত অনুমোদন। কি আশ্চর্য জীবন!
ভাবতে ভাবতেই ধ্যান ভঙ্গ হয়েছিল এক তরল কন্ঠস্বরে,
-’কি ভাবো সবসময় বলো দেখি ভাই? তুমি কি খুব গভীরপারা মেয়ে?’
পাহাড়ের থেকে চোখ সরিয়ে তাকিয়েছিলেন মেয়েটির দিকে, তাঁরই সমবয়সী। সত্যিই কাল থেকে একসঙ্গে আছেন, আলাপ করা হয়নি তো!
-’নাম কি তোমার?’
-’অরুন্ধতী। ডাকে সবাই অরু বলে।তোমার নাম কি?’
-’আমি বিরজা সুন্দরী। ডাকে সবাই তারা বলেই।’
-’ওমা! আমাদের দুজনের নামেই তো তারা! সই পাতাবে আমার সঙ্গে?’
মনে মনে হাসলেন বিরজা। তাঁর সঙ্গে সই পাতাবে, এ মেয়ে বলে কি!
তারপরেই দেখলেন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দাদা, পাশে মেয়েটির স্বামী। দাদা বললেন,
-’পাহাড়ে এসেছ, সই পাতালে পাহাড়ের নামে পাতাও!’
মিটিমিটি হাসি তার স্বামীর মুখেও।
কোনদিনই তেমন লাজুক নন, তবুও পরপুরুষ তো;খানিক লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে বললেন,
-’সে ভাই পরে দেখা যাবে। এখন আগে তো গোমুখ গুহা দেখি!’
-’বেশ। তবে তাই হোক। তবে আমি কিন্তু তোমায় ছাড়ছি না’
বলেই জড়িয়ে ধরলে মেয়ে, সে আলিঙ্গনে ভালোবাসা ছিল, সখ্য কামনা ছিলো, ঔদার্য ছিল।পাহাড়ে এলে কি মানুষ পাহাড়ের মতোই বিরাট হয়ে যায়!
ভাবতে ভাবতেই খাওয়া সেরে গাড়িতে বসলেন, গাড়ি এগোলো ফুলছট্টির পথে। . .. (ক্রমশঃ)
0 Comments