তুষারের সাথে আস্ত্রাখান ক্রেমলিনে
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৭
বিজন সাহা
তুষার
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আস্ত্রাখান। আস্ত্রাখানের নাম শোনা যায় গ্রীষ্মে যখন এখানকার বিখ্যাত তরমুজ রাশিয়ায় বিভিন্ন শহরে দোকানে দোকানে স্থান পায়। আমাদের দেশে যেমন কাঁঠাল, এদেশে লোকজন তেমনি বিশাল বিশাল তরমুজ কিনে বাড়ি নিয়ে যায়। এছাড়া আস্ত্রাখানের মাছ, পদ্ম এসবও খুবই নামকরা। এখনও মনে পড়ে ছাত্রজীবনে আমার চেয়ে ১০ বছরের সিনিয়র গনেশ দার কাছে বেড়াতে আসতেন আস্ত্রাখানের প্রনত বড়ুয়া দা। গনেশ দা তখন গণিতে পিএইচডি করতেন। বড়ুয়া দা সাথে করে নিয়ে আসতেন তিন লিটারের বয়ম ভর্তি ব্ল্যাক ক্যাভিয়ার। আমি আর আমার রুমমেট শ্রীকুমার গনেশ দার সাথে সকালে দৌড়ুতে যেতাম আর সেখান থেকে ফিরে গনেশ দার ঘরে বাটার আর ক্যাভিয়ার দিয়ে রুটি খেতাম। কয়েক বছর পরে আমার বন্ধু ও ইয়ারমেট তুষার বিমলের ওখানে বেড়াতে এলে মাছ নিয়ে আসত। আর ও যখন মস্কো চলে আসে পিএইচডি করতে, ওর গুবকিনের রুমে বিমলের সাথে যেতাম আস্ত্রাখানের মাছ খেতে। এখন প্রনত দা ক্যানাডায়, তুষার আস্ত্রাখান আর দুবাইয়ে আপডাউন করে দিন কাটায়। তাই এমনকি মস্কো থেকে বেরুনোর অনেক আগেই তুষারকে বলে রেখেছিলাম সম্ভাব্য যাত্রার কথা। অনেক দিন পরে ছাত্রজীবনের বন্ধুদের সাথে দেখা হলে, কথা হলে বেশ ভালই লাগে। তাই আস্ত্রাখান যাবার একটা অতিরিক্ত কারণ ছিল তুষার।
আমাদের প্ল্যান ছিল আস্ত্রাখানে বেশ কয়েকদিন থাকার। তাই দুপুরে লাঞ্চ করে রওনা হলাম আস্ত্রাখানের পথে। পথে পড়ল হার্ড বোর্ডের তৈরি পুলিশের গাড়ি। আমরা খেয়াল করিনি। দেমিদ দেখালো। দূর থেকে মনে হয় পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো। ড্রাইভাররা তাই এখানে গাড়ির গতি কমিয়ে দেয় আর কাছে এসে যখন নিজেদের ভুল বুঝে তখন ঠকানোর জন্য পুলিশের উদ্দেশ্যে দু চারটে যুতসই গালি খরচ করতে ভুলে না। আমি ইতিমধ্যে তুষারকে জানালাম আমাদের আসার কথা। ও বলল, ওর বাসায় রিকনস্ট্রাকশন চলছে। তাই বাসায় ওঠাতে পারছে না। আমাদের জন্য শহরের সবচেয়ে ভালো হোটেলগুলোর একটি বুক করে রেখেছে। তুষার বিত্তশালী মানুষ। অনেক দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পরে হঠাৎ এক রাতে ফোন করল।
কী খবর? ভালো আছিস তো?
খারাপ থাকার সামর্থ্য নেই রে। তাছাড়া খারাপ থাকলে শত্রুরা খুশি হয়। বয়েই গেছে ওদের বিনে পয়সায় বিনোদন জোগাতে।
যাক গে, মস্কো থেকে এক আত্মীয় ফোন করেছিল। বলল দূতাবাসে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর উপর তোর আলোচনায় রাষ্ট্রদূত নাকি খুব রেগে গেছেন। তবে তুই ঠিক বলেছিস।
যাক, আশা করিনি যে খবর এত দ্রুত ছড়িয়ে যাবে। তুই কি রাস্তায়?
না। চার তলা থেকে নীচে নামছি। তোকে বলা হয়নি, এখানে নতুন এক বাড়ি করেছি।
ভালো।
যাহোক, এম্বাসিতে সেই প্রবন্ধ পাঠ আর তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুষারের সাথে আবার যোগাযোগ। এরপরে অবশ্য হাই হ্যালো হয়, তবে এবার সামনাসামনি দেখার সুযোগ ছাড়ি কেন? তবে যেহেতু আমাদের দরকার ছিল স্বল্প বাজেটের বাসস্থান, তাই তুষারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমরা ইতিমধ্যে বাসা ঠিক করেছি। কাল সকালে তোর সাথে দেখা করব। না, মিথ্যে বলিনি। আমি দেমিদিকে বাসা দেখার জন্য বলেছিলাম, ও বাসা ঠিক করে ফেলেছে। তাই আমরা ধীরে সুস্থে চললাম আস্ত্রাখানের পথে। পথে প্রায়ই চোখে পড়ল তরমুজের খামার। কোথাও বা কেউ কেউ রাস্তার ধারে তরমুজ বিক্রি করছে। এখানে মাঠ আমাদের দেশের মতই – গাছপালা বিহীন, শুধুই চাষের জমি। আমাদের দেশে আজকাল অবশ্য চাষের জমিও নেই, শুধু বাড়ি আর বাড়ি। যদি রাশিয়ার উত্তর অঞ্চল অরণ্যে ঢাকা, আমাদের দেশ ঢাকা জন অরণ্যে। রাস্তায় এক জায়গায় দেখলাম বাতাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য বেশ কিছু প্রপেলার বসানো। ইতিমধ্যে দিন ছোট হতে শুরু করেছে। তাছাড়া এই এলাকা মস্কো থেকে অনেক দক্ষিণে, তাই দিন এমনিতেই ছোট। আস্ত্রাখানের পথে রাত নয়টার দিকে ছোট্ট একটা যাত্রাবিরতি নিলাম খোলা মাঠে। শুধু মাঠ আর মাঠ আর তার উপর সামিয়ানার মত খোলা আকাশ যেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে অসংখ্য তারা। মনে পড়ল বাড়ির কথা। অন্ধকার রাতে বাড়িতেও এরকম তারা ভরা আকাশ দেখা যায়। দু’ একটা ছবি নেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভালো কিছু পাওয়া গেল না। যখন আস্ত্রাখান এসে বাসায় গা এলিয়ে দিলাম বেশ রাত হয়ে গেছে। পাশেই দোকান থেকে শসা, টোম্যাটো এসব কেনা হল। দেমিদ নিরামিষ ভোজী, তাই আমাদেরও এরকম ভাবেই খেতে হয়। দিনের বেলায় ও খায় ভেজ পিৎসা, আমরা অন্য কিছু।
আর বলিস না, সারাদিন এভাবেই আমার কাটে দৌড়াদৌড়ি করে। তুই খুব ভালো করেছিস। আমিও দেশে স্ট্যান্ড করে এখানে এসেছিলাম। বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমারও সেরকম ইচ্ছাই ছিল। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। আমার তো তোকে ঈর্ষা করতে ইচ্ছে করে।
দেখ আমাকে ঈর্ষা করে লাভ নেই। এটা সেই নদীর এপার ওপারের গল্পের মত। তবে তোদের সমস্যা যে আমার চেয়ে বড় সেটা জানি।
সেটা আবার তোকে কে বলল?
সামসু ভাই। অনেক দিন পরে ওনার সাথে দেখা মস্কোর ভেদেএনখা মার্কেটে।
কী বিজন কেমন আছ?
এই চলে যাচ্ছে। জানেন তো এখানে বিজ্ঞানীদের অবস্থা।
হ্যাঁ জানি, বড়জোর রুটি কেনার পয়সা থাকে না। কিন্তু আমার তো বিশাল সমস্যা।
সে কি?
আর বলো না। ছেলেমেয়েকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছি। এখন ছেলে চাকরি নিয়েছে ইউগো জাপাদনায়া এলাকায়। বাসা থেকে একটু দূরে। বায়না ধরেছে আমি যেন অফিসের পাশাপাশি তার জন্য আরেকটা ফ্ল্যাট কিনি। এ তো মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন।
সেটা ঠিক। আমার কি, বড় জোর একবেলা না খেলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। আপনার তো অমীমাংসিত সমস্যা।
তাই বলি কি আমি যে তোদের সমস্যা সম্পর্কে একেবারেই জানি না তা নয়। সুতরাং আমাকে ঈর্ষা করার আগে রুটি কেনার পয়সা কোথাও জমা করে রাখিস।
তুষার, দিলীপ দুজনেই আমার গল্প শুনে হো হো করে হেসে উঠলো। দেমিদ বেচারি এখন আরও বেশি রকম সংখ্যালঘু হয়ে গেল। তুষারের অফিসের কাছে আসতেই একদল ছেলের সাথে দেখা। মনে হয় কলেজের ছাত্র। ছবি তুলতে চাইল আমাদের সাথে। ছবি তুলে গেলাম তুষারের অফিসে। চা বিস্কুট চলে এলো। তুষারকে আমাদের প্ল্যান জানালাম। সব শুনে ও জানালো আজকের প্ল্যান। এখন চা বিস্কূট খেয়ে যাব ক্রেমলিনে। সেটা ওর অফিস থেকে হাঁটা পায়ের রাস্তা। এরপর নদীর ধারে কোথাও একসাথে লাঞ্চ করে ওখানে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা। এরপর ও যাবে মিটিং-এ। দিলীপ যে জার্মানদের সাথে দেখা করতে চায় আমি ওকে সে কথা জানালাম।
শোন, আমার এক ভাড়াটে মনে হয় জার্মান। তাহলে চল, ক্রেমলিনের পথে ওর সাথে দেখা করি। তুই কথা বল।
আমরা সেটাই করলাম। ঠিক হল ঐ ছেলে ওর বাবুশকার সাথে কথা বলে জানাবে তিনি রাজী কিনা আমাদের সময় দিতে। আমি ওকে আমার নম্বর দিয়ে এলাম। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম ক্রেমলিনের দিকে। এসব এলাকায় গাড়ি পারকিং করা সমস্যা বিধায় আমরা হেঁটেই চললাম।
0 Comments