জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৫/ বিজন সাহা

সারেপতার ক্যাথলিক চার্চ

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৫ 

বিজন সাহা 

সারেপতা-অন-ভোলগা 

ভোলগাগ্রাদ গিয়েই আমি জেমসকে মেসেজ পাঠালাম। কিছুক্ষণ পরে উত্তর এলো যে ও মস্কোয় কাজে ব্যস্ত। তাই দেখা করতে পারছে না। তখন জানতে চাইলাম স্থানীয় জার্মানদের সম্পর্কে। তেমন কিছু বলতে না পারলেও জানালো যে ভোলগাগ্রাদে সারেপতা নামে একটি এলাকা আছে। সেখানে গিয়ে খুঁজে দেখতে পারি। যদিও সেটা ছিল কিছু আভাস মাত্র, তবে অনেক সময় এসব খবরও অন্ধের যষ্ঠির মত কাজ করে। আমরা ঠিক করলাম সকালে মামায়েভ কুরগান ঘুরে ওদিকে যাব। 

মামায়েভ কুরগান ঘুরে যখন সারেপতা এসে পৌঁছুলাম তখন দুপুর একটা পেরিয়ে গেছে। এদিক সেদিক জিজ্ঞেস করে আমরা এলাম এক চার্চের কাছে। এটা প্রটেস্ট্যান্টদের চার্চ। সেটা ছিল রবিবার। স্বাভাবিক ভাবেই চার্চে তখন লোকজন থাকে। তবে গিয়ে জানলাম প্রার্থনা শেষ হয়ে গেছে আর সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। তারপরেও দুই এক জনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। এদের চার্চগুলো রুশ চার্চের মত ততটা জাঁকজমক পূর্ণ নয়। কোথায় যেন বলেছিলাম রুশ চার্চ আমাকে হিন্দু মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। মন্দিরে যদি মূর্তি থাকে, তবে রুশ চার্চে থাকে আইকন, থাকে মোমদানী, ধুপের গন্ধ। সেদিক থেকে ক্যাথলিক বা প্রটেস্ট্যান্টদের চার্চ অনেকটা বিচারালয়ের মত অথবা ক্লাস রুম। আমি চেষ্টা করলাম যারা ছিলেন তাদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু কেউই তেমন আগ্রহ দেখালেন না। বললেন জার্মান যারা ছিল তারা চলে গেছে। তবে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে ওরা জার্মান, আমাদের সাথে কথা বলতে চায়নি। সেটা আমাদের ভারতীয় চেহারা দেখে নাকি রাজনৈতিক কারণে কে জানে? কথায় বলে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। এদের অনেকেরই হয়তো সেই কাজাখস্তানের স্মৃতি মনে আছে। তবে সারেপতা দেখতে একটু অন্য রকম মনে হল। এদেশে শহর, রাস্তাঘাট সাধারণত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দিলীপ তো সব জায়গায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করত, কী ছোট, কী বড় – সব কিছুই এত পরিষ্কার রাখে কী ভাবে? আমি বলতাম – মানুষ যদি নোংরা না করে তাহলে সব কিছুই পরিষ্কার রাখা অনেক সহজ হয়ে যায়।        

সারেপতা

দিলীপ সেই প্রথম দিন থেকেই ভোলগা তীরের জার্মানদের কথা জানতে চাইছিল, তাদের সাথে দেখা করতে চাইছিল। তাই ওদের সম্পর্কে একটু জানা যাক। জারের রাশিয়ায় ইউরোপীয়দের জন্য এ দেশ ছিল খুবই লোভনীয়। একদল যেমন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশে যেত, আরেক দল আসত রাশিয়ায়। রাশিয়ায় আসার ক্ষেত্রে মূল বাঁধা ছিল জেনারেল শীত আর অর্থডক্স ধর্ম। পিওতর পিয়েরভি বা প্রথম পিওতর ইউরোপের জানালা খুলে দিলে এই আগমন শুরু হয়। এটা ঠিক যে ইউরোপীয়রা অনেকবারই রাশিয়া দখলের চেষ্টা করেছে একে নিজেদের কলোনি করার জন্য, কিন্তু সব সময় যুদ্ধে হেরে পালিয়ে গেছে। এখানে যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা অভিবাসী। সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনার সময় এখানে একাডেমী আর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে বিজ্ঞানীরাও  আসতে শুরু করেন। বিখ্যাত গণিতবিদ অয়েলার এখানে কাজ করেছেন। ইউরোপীয় স্থপতিরা তৈরি করেছেন বিভিন্ন শহর। সেই ইয়েকাতেরিনার সময় বিরাট সংখ্যক মূলত জার্মান এদেশে আসে বসবাস করতে। তারা সাথে আনে নতুন ধর্ম, আনে নতুন সংস্কৃতি।  

🍂
ভোলঝস্কিয়ে নেমৎসি বা ভোলগা তীরের জার্মান – এটা বিংশ শতকের শুরুর দিকে রাশিয়ায় সেসব জাতিগোষ্ঠী গড়ে ওঠে তাদের একটি। এরা মূলত ইয়েকাতেরিনার মেনিফেস্টের ভিত্তিতে জার্মান রাজ্যসমূহ থেকে ১৭৬০ সালের দিকে আসা ভোলগার ভাটি অঞ্চলে বসবাসকারী অভিবাসীদের উত্তরসূরি। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পরে সেখানে ভোলগা তীরের জার্মানদের স্বায়িত্বশাসিত অঞ্চল গঠন করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে এরকম অনেক স্বায়ত্বশাসিত এলাকা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান রাশিয়ায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দূরপ্রাচ্যের ইহুদি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। ১৯৪১ সালে হিটলারের জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে ভোলগা তীরের জার্মানদের কোমি, সাইবেরিয়া, কাজাখস্তান, কিরঘিজিয়া ও তাজিকস্তানের উত্তরাঞ্চলে স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে ভোলগা তীরের জার্মানরা তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে ও ধীরে ধীরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায়। এর ফলে এখানে মাইগ্রেশন মুভমেন্ট জন্ম নেয় যা ১৯৯০ এর দশকে তীব্র আকার ধারণ করে যখন এরা জার্মানিতে যেতে শুরু করে হাজারে হাজারে।      

“বিদেশীদের রাশিয়ায় বসবাস ও দেশত্যাগীদের রাশিয়ায় ফেরা” নামক সম্রাজ্ঞী ইয়েকাতেরিনার মেনিফেস্ট অনুযায়ী বিদেশীরা এখানে কলোনি গড়ে বসবাস করতে পারত, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরা আর্থিক সহযোগিতাও পেত। এখানে উপনিবেশ বলতে মূলত এদের বিস্তীর্ণ এলাকা বাসযোগ্য করে তোলা, সেখানে কায়িক পরিশ্রম করে নিজেদের বেঁচে থাকা ও দেশের উৎপাদন বাড়ানো। এরা বিভিন্ন মেয়াদে কর মুক্ত থাকত। যদি আমেরিকায় আফ্রিকা থেকে লোকজনকে দাস হিসেবে আনা হত, এখানে এরা আসত স্বেচ্ছায় ও সরকারি সহযোগিতায়। এটা অনেকটা বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত দেশ নিজেদের কর্মক্ষম মানুষের অভাব পূরণের জন্য  প্রতি বছর বিদেশীদের যেরকম আমন্ত্রণ জানায় সেরকম। ইয়েকাতেরিনার এই মেনিফেস্ট বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়, এছাড়া মৌখিক প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। বেশির ভাগ অভিবাসীরা এসেছিল বাভারিয়া, বাডেন, হেসসেন, পফালয ও রেইন এলাকা থেকে। ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত ৩০ হাজারের অধিক অভিবাসী রাশিয়ায় এসেছিল। নবাগতদের আহ্বানে আরও প্রায় ১৫০০০ অভিবাসী রাশিয়ায় আসে যারা সারাতভ এলাকায় বসবাস শুরু করে। অভিবাসীদের প্রথমে পিতেরবুরগে রাখা হয়, এরপর তাদের এক থেকে দুই মাসের জন্য শহরের উপকণ্ঠে অরানিয়েনবাউমে স্থানান্তরিত করা হয় যেখানে তারা রুশ রীতিনীতির সাথে পরিচিত হয়। এরপর ১৭৬৩ সালের ৩ আগস্ট কাউন্ট অরলভ রচিত শপথ পাঠ করে নতুন দেশের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। পিতেরবুরগ থেকে মূলত নৌপথে অভিবাসীদের ভোলগার ভাটি এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। কয়েক মাসের এই যাত্রা পথে অভিবাসীদের প্রায় ১৩% মৃত্যু বরণ করে। এরপরে বেশ কিছু প্রস্তুতিমূলক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ১৭৬৪ থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের মধ্যে ভূমি বন্টন করা হয়। এই অভিবাসনে রুশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষি কাজের উন্নয়ন। এরা সাথে করে লাঙ্গল, বিশেষ ধরণের কাস্তে, শস্য মলার কাঠের যন্ত্র নিয়ে এসেছিল যা আগে এদেশে ব্যবহার করা হত না। রাশিয়ায় আগে রাই আর কিছু কিছু গম চাষ হত। অভিবাসীরা আলু, শণ, তামাক, ওটস, বার্লি এসবের চাষ করতে শুরু করে। চাষাবাদের উন্নতির সাথে সাথে আসে স্বচ্ছলতা, অভিবাসীরা শিল্পোন্নয়নে মনোযোগ দেয়। এলাকায় ময়দা ও তেলের কল গড়ে উঠে। সারেপতায় কাপড়ের কারখানা গড়ে ওঠে আর এখানকার কাপড় সারপিনকা নামে খ্যাতি পায়। জার্মানির অভিবাসীরা এখানে আসার আগে রাশিয়ায় কোন ক্যাথলিক চার্চ ছিল না। ১৮১০ সালে বিদেশীদের ধর্ম পালনের সুবিধার জন্য বিশেষ সংস্থা তৈরি করা হয় আর ১৮৩২ সালে রুশ সম্রাট প্রথম নিকোলাই লুথারিয়ান চার্চের প্রধান হন।  ১৯২০-২১ সালে এই এলাকায় কৃষক বিদ্রোহ দমনের পরে চার্চের উপর কমিউনিস্টদের খাঁড়া নেমে আসে। চার্চ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে বাধ্য হয়। শুরু হয় নাস্তিকতার প্রোপ্যাগান্ডা। 

চার্চের জানালা

১৯১৮ সালের ১৯ অক্টোবর রুশ ফেডারেশনের মন্ত্রী সভার নির্দেশক্রমে সারাতভ ও সামারা অঞ্চলের কিছু অংশ নিয়ে প্রথম স্বায়িত্বশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়। এর রাজধানী ছিল সারাতভ যদিও পরবর্তীতে সেটা ইয়েকাতেরিনস্টাডটে স্থানান্তরিত হয়। ১৯১৯ সালের ৪ মে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মার্ক্সস্টাডট। ১৯২২ সালের ২৪ জুলাই রাজধানী পাক্রোভস্কে সরিয়ে নেয়া হয়, ১৯৩১ সালে যার নামকরণ করা হয় এঙ্গেলস। এটা সারাতভের পাশে ভোলগা নদীর অন্য তীরে অবস্থিত শহর যেখানে বর্তমানে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রবাহী বিমান ঘাঁটির একটি। তবে পরবর্তীতে কালেক্টিভিজেশন বা কালখোজ তৈরির হিড়িক পড়লে ভোলগা তীরের জার্মানদের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে শুরু করে। প্রায় সমস্ত শস্য সরকারি গুদামে চলে গেলে ১৯৩২-১৯৩৩ সালে এখানে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সে সময় রাশিয়ার বিশাল অংশ, কাজাখস্তান ও ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এরপর শুরু হয় স্তালিনের রিপ্রেশন। ১৯৩৫-১৯৩৭ সালে দু লাখের মত জার্মানদের কাজাখস্তান ও ইউক্রেনের সীমান্ত এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার পরে ১৯৪১ সালের ২৮ আগস্ট সোভিয়েত মন্ত্রীসভার নির্দেশে স্বায়ত্বশাসিত জার্মান অঞ্চল বিলুপ্ত করা হয় এবং  সারাতভ, সামারা ও ভোলগা তীরের স্বায়ত্বশাসিত জার্মান অঞ্চলের জার্মানদের কাজাখস্তান, কিরঘিজিয়া, তাজিকস্তান, উরাল, আলতাই, সাইবেরিয়া ইত্যাদি এলাকায় নির্বাসন দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালে পুনরায় জার্মান স্বায়ত্বশাসিত এলাকার দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে, ৎসেলিনাগ্রাদে ডেমনস্ট্রেশন বের হয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে জার্মানদের একটি বড় অংশ জার্মানি চলে যায়। ১৯৮৯ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী রাশিয়ায় ২০ লাখ ৩৮ হাজার ও কাজাখস্তানে ৮ লাখ ৪৩ হাজার জার্মান বসবাস করত। ২০০২ সালের গণনা অনুযায়ী রশিয়ায় জার্মানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ লাখ, আর ২০১০ সালের হিসেবে ৪ লাখ। যদিও জার্মানির আধুনিক নিও লিবারেল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে অনেক জার্মান এখন রাশিয়ায় ফিরে আসছে, তবে সেই সংখ্যা তেমন বড় নয়। যাই হোক, এখানেও আমরা জার্মানদের দেখা পেলাম না, বা দেখা পেলেও কথা হল না। দিলীপ মনঃক্ষুণ্ণ হল এজন্যে যে আমাদের দেশে লোকজন সাংবাদিকদের দেখলে এগিয়ে এসে সুখ দুঃখের কথা বলে, আর এখানে বার বার বলার পরেও কেউ ইন্টারভিউ দিতে রাজী হচ্ছে না। এর মানে এই নয় যে এরা মিশুক না। এরা মিশতে কথা বলতে পছন্দ করে। আমি তো প্রায়ই এদের সাথে গল্পগুজব করি। তবে ইন্টারভিউ মানেই কোন বিশেষ ব্যাপারে মতামত দেয়া। কোন বিষয়ে না জানা থাকলে এরা সে ব্যাপারে নাক গলাতে খুব একটা পছন্দ করে না। 

ভিডিওতে সারেপতা ও ভোলগা দন  

https://www.youtube.com/watch?v=zf-uT9E3PH4

ছবিতে সারেপতা ও ভোলগা দন  

http://bijansaha.ru/album.php?tag=263

Post a Comment

0 Comments