জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—থাইল্যাণ্ড (এশিয়া)হাতি কেন ফুঁ দিয়ে দিয়ে পথ চলে /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—থাইল্যাণ্ড (এশিয়া)
হাতি কেন ফুঁ দিয়ে দিয়ে পথ চলে
চিন্ময় দাশ


[সবাই বলে, হাতি হাঁটবার সময় শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে ফুঁ দিতে দিতে যায়। এ কথাটি কি সত্যি? কে জানে, সত্যি কি না! তবে, এই নিয়ে একটি মজার গল্প বলে পূর্ব এশিয়ার লোকেরা। আমরা একটি গল্প সংগ্রহ করেছি থাইল্যাণ্ড থেকে। আজ সেটিই শোনাব এখানে।]

এক বনে এক হাতি ছিল। যেমন পাহাড়ের মত তার চেহারা, তেমন তার দেমাক। চেহারায় বড়। শক্তিতে বড়। দেমাক তার হতেই পারে। কারও তা নিয়ে টুঁ করবার কোন জো নেই। 
কিন্তু হাতিটা ভারি বদমাস। স্বভাবে বেজায় ধূর্ত। অন্যের অনিষ্ট করতে তার জুড়ি নাই। বনের কাউকে তোয়াক্কা করে না সে। 
একবার এজন্য ভারি নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল হাতিকে। এবং বাছাধনের স্বভাব বদলে ফেলতে হয়েছিল। সে আবার কার খপ্পরে পড়ে, সে কথা কেউ ভাবতেও পারবে না। সে কথাটাই বলব আমরা।
এ দুনিয়ায় একেবারেই ছোট্ট এক জীব পিঁপড়ে। পিঁপড়েদের কাছে হাতি হোল হিমালয়ের মতো বড়। সেই পিঁপড়েরাই স্বভাব বদলে দিয়েছিল হাতির। সেই ঘাটনা নিয়েই আজকের উপাখ্যান। 
একদিন তখন সকাল হয়েছে। হাতি বেরিয়েছে খাবার জোগাড়ে। হয়েছে কী, সেসময়েই পিঁপড়েরাও বেরিয়েছে তাদের ডেরা থেকে। বনের সবাই জানে, পিঁপড়েরা দল বেঁধে আসা যাওয়া করে। হাতিও জানে সে কথা। তবে এসব সে গ্রাহ্য করে না। 
হয়েছে কী, বনের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। এপাশ ওপাশ দু’দিকেই জঙ্গল। হাতি চলেছে সেই পথে। পিঁপড়েদের একটা মোটা সারি রাস্তাটার এদিক থেকে ওদিকে রাস্তা পার হচ্ছিল সেসময়ই। 
হোল কী, হাতি তো চলেছে নিজের মেজাজে। কোন দিন কোনও দিকেই হুঁশ থাকে না তার। আজ পিঁপড়েদের সারিটা চোখে পড়ে গেল তার।
অমনি বদবুদ্ধি এসে গেল মাথায়। সামনের পা দিয়ে আলতো করে বুলিয়ে দিল সারিটার ওপর। সেই চাপে যে কয়েক শ’ পিঁপড়ে থেঁতলে মারা পড়ল, হাতির তাতেই মজা।
যারা মারা পড়েনি, তারা চেঁচিয়ে উঠল—এটা কী করলে তুমি? আমরা তোমার কী ক্ষতি করেছি। কোন বিবেক নাই তোমার?
হাতি বলে উঠল—খুব বাড় বেড়েছে দেখছি তোদের। আর একটা শব্দ করেছিস কী গোটা সারিটাই পিষে ফেলব। সক্কাল বেলায় যত সব আপদের দল। 
হাতি চলে গেলে, হাহাকার পড়ে গেল পিঁপড়েদের মধ্যে। কিন্তু কী আর করে? কিছুক্ষণ হা-হুতাস করে, ডেরায় ফিরে গেল সবাই। 
পিঁপড়েদের কোন রাজা নাই। সব দলে একজন রানি থাকে তাদের। বাসায় ফিরে সবাই হামলে পড়ল—সর্বনাশ হয়েছে, রানিমা। 
ঘটনা শুনল রানিমা। কিন্তু করবার কী আছে। তারা ক্ষুদ্র জীব। বিধাতা ছোট করেই গড়েছে তাদের। করবার কী আছে? 
দুনিয়ায় আর এক ছোট জীব হোল উইপোকা। এই উইপোকাদেরও একজন করে রানি থাকে। 
পিঁপড়েদের সভা চলছে। সেসময় আচমকা উইপোকাদের রানি এসে হাজির। তাকে দেখে পিঁপড়েদের রানি বলল—কী ব্যাপার, দিদি? তুমি হঠাৎ আমাদের ডেরায়?
উইপোকাদের রানি বলল—নিজের চোখে দেখলাম ঘটনাটা। তাই ছুটে এলাম। 
পিঁপড়েরানি বলল—কী আর করব, এত বড় জীব। তার পায়ের তলায় তো মরতেই হবে ছোটদের।
--ছোট-বড়্রর কথা নয়, দিদি। এই হাতিটার স্বভাবটাই বড্ড খারাপ। একবার আমাদের ওপরেও ভারি অত্যাচার করেছিল। 
উইরানির কথা শুনে, পিঁপড়েরানি বলল—তোমরা থাকো জঙ্গলের ভেতরে ঘর বানিয়ে। তোমাদের আবার কী ক্ষতি করল? 
উইরানি বলল—তাহলে আর বলছিটা কী? একদিন বনের ভেতর শুঁড়িপথ ধরে যাচ্ছে হাতিটা। পথটার সামান্য দূরে আমাদের ঢিবি। একটু বড়ই ছিল ঢিবিটা। হল কী, ঢিবিটার সামনে এসে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল হাতিবাবাজী। কী মনে হোল, বিধাতাই জানে। ফিরে চলে গেল। করল কী জানো? নদী থেকে শুঁড় ভর্তি জল তুলে এনে, জোরে জোরে ছিটিয়ে দিল আমাদের ঢিবিটাতে। 
একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগল—সে কী দুরবস্থা আমাদের। আচমকা জল লেগে, পুরো ঢিবিটা গলে মাটিতে মিশে গেল। অধিকাংশই বের হতে পারল না। মাটি চাপা পড়ে রয়েই গেল চিরকালের মতো। 
পিঁপড়েরানি বলল—সে কী গো? 
উইরানি বলল—তবে আর বলছিটা কী? তোমরা এক কাজ করো দিদি। উচিত শিক্ষা দাও বদমাসটাকে।
পিঁপড়েরানি বলল—আমরা দেব হাতিকে শিক্ষা? বলছো কী তুমি? 
উইরানি বলল—শক্তিতে না পারো, বুদ্ধি দিয়ে লড়ো।
পিঁপড়েরানি বলল—তোমাদের এত বড় ক্ষতি করল। তাহলে, তোমরা লড়লে না কেন? 
উইরানি বলল—আমাদের কি আর ঢিবি ছেড়ে, বাইরে বেরোবার জো আছে নাকি? পাখির দল এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। খুঁটে খুটে খেয়ে ফেলবে যে। 

🍂

পিঁপড়েরানি বলল—হাতির সাথে লড়ব, সে বুদ্ধি আমাদের কোথায়? 
তাকে থামিয়ে দিয়ে, কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে, উইরানি বিদেয় হয়ে গেল।
পিঁপড়েরানি করল কী, নিজের বাহিনি থেকে দুটো পিঁপড়েকে বেছে নিল। তাদের আলাদা করে ডেকে, কিছু পরামর্শ দিয়ে দিল। বলে দিল—যেমনটি বললাম, হুবহু সেটাই করবি। তার কমও না, বেশিও না। তা যদি করিস, তাহলে প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। 
পরের দিন। খাওয়া দাওয়া সেরে, নদীতে নেমে ভর পেট জল খেল হাতি। উঠে এসে, একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ল। মনে ইচ্ছা, হাল্কা একটা ঘুম দিয়ে নেবে ডেরায় ফিরবার আগে। 
পিঁপড়ে দুটো জানে, হাতি এখানে জল খেতে আসে। তারা তৈরি হয়ে তক্কে তক্কে ছিল। ইয়া লম্বা শুঁড় হাতির। সেটা এখন মাটিতে বিছানো।
হাতি শুয়ে পড়ল দেখে, তারা বুঝে গেল—এটাই মওকা। তারা গুটি গুটি হাতির কাছে এগিয়ে এল। সুড়সুড় করে শুঁড়ের ভিতর ঢুকে পড়ল দুজনে। 
খানিক ভেতরে ঢুকেছে। সুড়সুড়ি লাগল হাতির। একটু নড়ে উঠল শুঁড়টা। পিঁপড়ে দুটো বুঝে গেল, এক মূহুর্তও দেরি নয় আর। হাতি হেঁচে উঠলে, কোথায় গিয়ে যে পড়বে দুজনে, তার ঠিক নাই। রানিমা বলে দিয়েছে, যা করবার এখনই করতে হবে।
শুঁড়ের ভিতরে বেশ নরম মাংস। কুটুস করে কামড়ে ধরল দুজনে। 
আর যায় কোথায়!হাতি তো ধড়ফড় করে উঠে পড়েছে। হোলটা কী? অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে ভেতরে। ছটফট করছে বেচারা। লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে, সে এক বিটকেল কাণ্ড হাতির। খানিক বাদে চিড়িক করে উঠল মাথার ভিতর,  গতকাল বিপদ ঘটিয়ে গিয়েছিল পিঁপড়েদের। আর কিছু নয়। এটা তাদেরই কাণ্ড। প্রতিশোধ নিচ্ছে তারা। 
যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে হাতি বলল—বেরিয়ে আয়, বাপধনেরা। মেনে নিচ্ছি আমার দোষ হয়েছে। কথা দিচ্ছি, আর কোন দিন কোন ক্ষতি করব না তোদের। 
ভিতর থেকে পিঁপড়েরা বলল—তোমার স্বভাবটাই খারাপ। কথা রাখবার লোক তুমি নয়। 
হাতি ককিয়ে উঠে বলল--নারে, বিশ্বাস কর। কথার খেলাপ হবে না। 
পিঁপড়েরা বলল—শুধু আমাদের নয়, কারও কোন ক্ষতি করবেনা কোনদিন, সেটা বলো নিজের মুখে। তখন ভেবে দেখা যাবে।
অগত্যা কী আর করে? হাতি বলল—ঠিক আছে, এই নদীর নাম করে বলছি-- কথা দিলাম, কোন দিন কারও ক্ষতি করব না আমি। স্বভাবটাই বদলে ফেলব আজ থেকেই। 
সেদিন উচিত শিক্ষা পেয়েছিল হাতি। বুদ্ধি থাকলে, ছোটরাও যে পাহাড় টলিয়ে দিতে পারে, পিঁপড়েরা তা প্রমাণ করে দিয়েছে। 
আর, হাতি? কথা রেখেছে সে। স্বভাবটাই বদলে ফেলেছে নিজের। শান্ত শিষ্ট নিরীহ জীবের মতো থাকে। সাতে পাঁচে যায় না কারও। আর, বেশি মনে রেখেছে পিঁপড়ের মতো ছোট জীবদের কথা। 
আজও রাস্তায় চলে যখন, শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে ফুঁ দিতে দিতে যায়। একটা পিঁপড়ে শুধু নয়, একটা পোকামাকড়ও যাতে তার পায়ের তলায় না মারা পড়ে, সেই ভাবনায় রাস্তায় ফুঁ দিতে দিতে যায় হাতির দল।

আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJune 25, 2024

    দারুণ গল্প। তবে আপনার সব গল্পই আমার ভালো লাগে।

    ReplyDelete