জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /উনবিংশতি পর্ব/মলয় সরকার

সোনালী মন্দির

উদয়ের পথে
উনবিংশতি পর্ব

মলয় সরকার

ভাবলাম, ওরা ওদের ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধগুলো কি সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করে পৃথিবীর মানুষদের দেখাচ্ছে, আর আমরা মালদহের মত বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাজধানীর রাজবাড়ির প্রাচীন ইঁটও খুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের বাড়ির দেওয়ালে লাগাচ্ছি। হায়রে ভারতবর্ষ!

যাক, ফিরলাম বর্তমানে।

প্রথম এটি নির্মিত হয় ১৩৯৭ সালে, যখন এক ধনী মানুষের বাড়িকে পরিবর্তিত করা হয় এই বৌদ্ধ মন্দিরে। পরে ১৪৬৭-১৪৭৭ এই দশ বছর ধরে চলা মন্দির, অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য এক বিশাল গৃহযুদ্ধে বহু বিখ্যাত মন্দিরের মত ,এটিও আগুনে ভস্মীভূত হয়।  পুনর্নির্মাণ হওয়ার পর  এটি ১৯৫০ সালে এক তরুণ সন্যাসীর বালখিল্যতায় আবার দগ্ধ হয়। শেষে শেষবারের মত এটি ফের সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয় ১৯৫৫ সালে। এটিতে কিন্তু সত্যিকারের সোনার খুব পাতলা প্লেট দিয়েই আবৃত করা। আর সেই সোনালী প্যাভিলিয়নের ছায়া শেষ বিকালের রোদের সোনালী আভায় বিচ্ছুরিত হয়ে পাশের জলে যখন পরে তা এক অদ্ভুত সৌন্দর্য্যের ব্যাপার হয়। এর লোভে বহু ছবিশিকারীর দল ভিড় করেন এই মন্দির চত্বরে।জলাশয়ের মাঝে পাথর দিয়ে ছোট্ট একটি দ্বীপের মত করা আছে, যাতে সুন্দর দেখতে দুটি গাছ রয়েছে। তাতে জলাশয়ের সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেছে।

মন্দিরের নীচের তলাটি সাদা রঙের , শুধু দ্বিতীয় আর তৃতীয় তলা, চূড়া সমেত, সোনালী।

এই গোল্ডেন প্যাভিলয়নের মাথার উপরে একটি ফিনিক্স পাখীর মূর্তি আছে।এর ভিতরে যেতে দেওয়া হয় না সাধারণতঃ।তাই বাইরের সৌন্দর্য্যেই তৃপ্ত থাকতে হল। ভিতরে বুদ্ধের মূর্তি আছে। এর সামনে দিয়ে রয়েছে বাগানে ঘেরা রাস্তা। সেটি দিয়ে যেতে যেতে মন্দিরের সৌন্দর্য্য আশ মিটিয়ে দেখে নেওয়া যায়।
এখানে প্রতিটি গাছই যেন ছবি। দেখে মনে হচ্ছে অযত্নে রয়েছে।কিন্তু না, এই গাছ গুলি বিশেষ কায়দায়, বিশেষ ভাবে, বিশেষ জায়গায় রাখা আছে, যাতে সব মিলিয়ে একটা অন্য ধরণের স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি হয়। এই বাগানই এইসব জায়গাগুলোর মন্দিরের একটা প্রধান বিশেষত্ব।এই বাগানটি আসলে Muromachi যুগে( (১৩৩৬-১৫৭৩) যে বাগান সাজানোর এক বিশেষ রীতিতে জাপান সমৃদ্ধ হয়েছিল, তার এক জ্বলন্ত নিদর্শন।সেই যুগকে বিজ্ঞানীরা বলেন, এই রীতির স্বর্ণযুগ।
সামনের জলাশয়ে মন্দিরের ছায়া আর সাজানো গাছেরা

আমার মনে হল, জাপান যদি কেউ অন্ততঃ এক মাস ধরে ঘুরতে পারে, সে যত আনাড়িই হোক, সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে তার কিছুটা ধারণা জন্মাবেই, এবং সে সৌন্দর্য্যপ্রীতিতে মুগ্ধ হয়ে তার ভিতরে কিছু পরিবর্তন আসবেই।

এগিয়ে চললাম বাগানী রাস্তা ধরে। সবাই লাইন দিয়ে চলেছে শান্ত ভাবে সব দেখতে দেখতে। দেখলাম, একটি খুব ছোট্ট জলাশয় । তাতে সবাই অনেক পয়সা ফেলেছে।যার  নাম  Anmintaku Pond  ।এই জলের মধ্যে পয়সা ফেলে পূণ্য অর্জনের মানসিকতা বোধ হয় এশিয়া ইউরোপ , সমেত সারা পৃথিবীতেই আছে। এ দৃশ্য দেখেছি, আমাদের মা গঙ্গার বুকে, হরিদ্বারই হোক, বা কলকাতায়, দেখেছি রোমের ফোয়ারায়, দেখেছি চীন কি জাপানেও কিংবা মেক্সিকোতেও। তখন আমার মনে হয়েছে, মানুষ যে দেশের বা যে ধর্মেরই হোক তার ভিতরের সুক্ষ্ম অনুভূতি বা সংস্কার কি কুসংস্কার সবই একসূত্রে বাঁধা! 
এ ছাড়া দেখেছি সারা পৃথিবীর মানুষের মনের ভিতরের যে আসল মানুষ, তা সারা পৃথিবীতেই এক। তখন মনে হয় সেই কথা,কবি সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীর অমোঘ উচ্চারণ, “ চেয়েছি বলে দেশ, একটাই পৃথিবী হয়’।

এছাড়া চলার পথে দেখলাম, প্রধান পুরোহিতের থাকার ঘর, আরও একটি মন্দির, কিছু মেমেন্টো কেনার দোকান, চায়ের জায়গা(Sekkatei Teahouse) যেটি ইদো (EDO Period) যুগ থেকে রয়েছে। এই চায়ের জায়গাটি অনেক পুরানো। আসলে এই চা এখানকার এক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অবশ্য সে চা আমাদের ওখানকার দুধ এলাচ চিনি মেশানো নয় বা আজকালকার তন্দুরী চাও নয়। সত্যি চায়ের আসল আমেজ যা অনেক পবিত্রভাবে অবিমিশ্রিত রূপে পরিবেশিত ও গৃহীত হয় এখানে।

বেরিয়ে এলাম এখান থেকে। মন্দিরের সময়ও শেষ। পায়েও বেশ ব্যথা করছে।বেরোনোর সময় সুন্দর কিন্তু বেশ লম্বা সিঁড়ি। সবাই বের হচ্ছে। ভাবলাম একটু সিঁড়িতে বসে পায়ের ব্যথাটা ছাড়িয়ে নিই। ও বাবা, একটু পরেই দেখি, “ হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী, ঝুঁটি বাঁধা উড়ে–” না উড়ে নয় জাপানী দারোয়ান এসে ঠেলে তুলে দিয়ে বলল, এখানে বসা যাবে না।”মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান” ‘বসিতে দেবেনা সিঁড়িতে , তাই লিখি দিল সামনের রাস্তা দর্শনীর পরিবর্তে’।

যাক,সামনের এটিএম থেকে ক্যাশ পাওয়া গেল।তবে ধড়ে প্রাণ এল।এখানে অনেক জায়গাতেই যে ক্যাশ নেয়, তাই এই সমস্যা।

যাক, ফেরা হল আরাশিয়ামা হয়ে কিয়োতো । ফিরতে রাত হল।
🍂

পরদিন আমাদের যাত্রা Kintetsu Kyoto Line এ। ট্রেনে চেপে বসলাম। এটা হল লিমিটেড এক্সপ্রেস। এখানে আমাদের এক্সপ্রেস ট্রেন ওদের দেশে হল লিমিটেড এক্সপ্রেস। এর দামও বেশি , আরামও আমাদের রাজধানীর মতই।

আমাদের যাত্রা হল শুরু। যাত্রাপথ মাত্র ৩৫ মিনিটের।ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতাও খুব ভাল। এখানে রাস্তায় অনেকেই মোটা মোটা বই পড়ে। এই ব্যাপারটা আমি দেখেছি আমেরিকা কিংবা ইউরোপের বহু জায়গায়। এই মোবাইলের যুগেও ওরা আসল বইই পড়ে, রাস্তায় ঘাটে যখনই সময় পায়। 

তবে আজকাল আমাদের দেশের কিছু বই অনুরাগী তরুণ প্রজন্মকেও দেখছি এরকম।কিন্তু সে খুবই কম। আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় বিনা পয়সায় বই দেওয়া নেওয়ার জন্য অনেক বাক্স থাকে। সেখান থেকে সবাই বই নেয় ও পড়ে। ভারতে এরকম এখনও আমরা ভাবতে পারি নি। তবে বিদেশের বই পড়া আমাদের থেকে অনেক গুণ বেশি। তাই পৃথিবীর অর্ধেক দেশ যখন রবীন্দ্রনাথ, নেহেরু স্বামীজীকে জানে পড়ে, আমরা আমাদের পাশের রাজ্যের লেখকদেরও চিনি না।
ঠাকুরের সামনে মনস্কামনা পূরণের মানত

যাক, আসল প্রসঙ্গে আসি।

ট্রেনে ওঠার জন্য কোন ধাক্কাধাক্কি নেই, রাগ বা অসহিষ্ণুতা নেই। টিকিটের নির্দিষ্ট কামরার সামনে লাইন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই। ট্রেন এলে এক এক করে উঠে পড়ল।সমস্ত কর্মচারীরা সুন্দর ইউনিফর্ম পরে নিজের জায়গায় কাজ করছে। এরা প্রত্যেকেই খুব সহানুভূতিশীল ও সাহায্য করতে কোন বিরক্তি নেই। যদিও সবই স্বয়ংক্রিয়, মানুষ ঠিকঠাকই সব করছে, তবু কেউ কোথাও অসুবিধায় পড়লে বা আমাদের মত বিদেশীদের জন্য ওরা হাত বাড়িয়েই আছে।
ট্রেনের ভিতরে যে জ্ঞাতব্য তথ্য দিচ্ছে, তা জাপানী এবং ইংরাজীতে। কাজেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

এসে পৌঁঁছালাম নারা স্টেশনে।এই নারাই একসময় ছিল জাপানের রাজধানী , ৭১০ -৭৯৪ সাল পর্যন্ত, অন্ততঃ যতদিন না এই রাজধানী কিয়োটোতে স্থানান্তরিত হল।বলা হয় এই নারা হল জাপানের সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন ও সবুজ সহর। কিন্তু এই শহরের উপর তেমন জোর দেওয়া হয় নি।এখানে বিখ্যাত অন্ততঃ ৮ টি মন্দির রয়েছে।Tōdai-ji, Saidai-ji, Kōfuku-ji, Kasuga Shrine, Gangō-ji, Yakushi-ji, Tōshōdai-ji, Heijō Palace।এর সব তো যাওয়া সম্ভব নয় আর দরকারও নেই। তাই আমরা দু একটি বিশেষ মন্দির ছাড়া অন্য গুলোতে আর যাব না।

এখানে যদিও ১৯৮৮এর পর উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হয়, এখানে কিন্তু বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপত্যও রয়েছে যা বহু পর্যটককে আকৃষ্ট করে।এই নারাকে ইউনেস্কো হেরিটেজ শহর বলেও আখ্যাত করা হয়েছে।
আরও অনেক কিছু দেখার আর জানার আছে বন্ধুরা, অদেখা জাপানের নানা জিনিস।সঙ্গে থাকুন আর সাহস দিন–

ক্রমশঃ–

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments