জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব-১৮/স্বপন কুমার দে

চিত্র - শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব-১৮


স্বপন কুমার দে

সারাদিনের পরিশ্রম, ক্লান্তি আর শোক বিধ্বস্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকল মল্লিকা। চারপাশটা চেয়ে চেয়ে দেখল, বাবার অজস্র স্মৃতি ঘরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। জামা,জুতো,লুঙ্গি, গামছা, বিছানা, চাদর, বালিশে বাবার গায়ের গন্ধ এখনও টাটকা। চোখের জল তার শেষ হয়ে গেছল, তাই ভেতরের হাহাকার শব্দহীন, অশ্রুহীন কান্নায় হৃদয়কে নিংড়ে অব্যক্ত যন্ত্রণা নিরাকার অবয়বে ছড়িয়ে পড়েছিল নির্জন ঘরের প্রতিটি কোনায়। দু'হাতে চোখ মুখ ঢেকে বসে পড়ল বাবার খাটটায়। বিছানাটা এখনও আলুথালু, হয়তো মালিকের অপেক্ষায় রয়েছে। পরনের লুঙ্গিটাও খাটের একপাশে। দরজার সামনে ক্ষয়ে যাওয়া চপ্পল জোড়া আগের মতোই মালিকের অপেক্ষায় চেয়ে আছে। তারা কি জানে যে তাদের মালিক আর কখনও ফিরে আসবে না? সারা ঘরে বাবার উপস্থিতির চিহ্ন। ঠিক মনে হয়, এখুনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলবে," দে তো মা দুটি মুড়ি, খুব খিদে পেয়েছে।" হয়তো বাজার থেকে ঘুরে এসে বলবে," বাজার থেকে আজ কুচো চিংড়ি নিয়ে এসেছি, লাউ দিয়ে চচ্চড়ি রেঁধে দে তো মা। তোর হাতের লাউ চিংড়ি যেন অমৃত।" একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরোল। না, বাবা আর কোনোদিন ফিরবে না। কোনওদিন না। তাকে ভালোবাসার শেষ আধারটুকুও আজ চলে গেল। পৃথিবীতে সে একা, সে শক্তিহীনা। ঈশ্বরের কাছে নালিশ জানাতে গিয়েও পারল না। মনে পড়ল রবিঠাকুরের গানের সেই লাইনগুলি,
        বিপদে মোরে রক্ষা করো
                এ নহে মোর প্রার্থনা,
        বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
        দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে
                নাই বা দিলে সান্ত্বনা
        দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।

প্রকৃতির নিয়মে রোজ যেমন সকাল সন্ধ্যে হয়, এখনও ঠিক তেমনই হতে লাগল। পিতৃমাতৃহীনা মল্লিকা একা ঘরে তার আটপৌরে জীবনে শোকের দিন রাত্রি কাটাতে লাগল। কোনো কোনো প্রতিবেশি মাঝে মাঝে খোঁজ নেয়, কেউ নানান ধরনের পরামর্শ বা উপদেশ দেয়, কেউ বা খোঁজ নেয় বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির ব্যাপারে। মল্লিকা সবার সঙ্গেই কথা বলে, ধৈর্য্য নিয়ে কথা শোনে, পরামর্শ নেয়। অশৌচ অবস্থাতে আপাতত টিউশনগুলো বন্ধ রেখেছে। টিউশন বাড়িগুলি এক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল ও মানবিক।

🍂

নিজের সাধ্যমত শ্রাদ্ধ শান্তির ব্যবস্থা করল মল্লিকা। পাঁচজন বামুন, কয়েকজন প্রতিবেশি এবং শ্মশানযাত্রীদের নিমন্ত্রণ করল। এরজন্য তাকে খুব একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি। নিমাইকাকু সবকাজে তাকে সাহায্য করেছে। শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ মিটে গেলে তারপর থেকে যথারীতি ক্লাস এবং টিউশন করতে লাগল।

এদিকে আবার পাড়ায় সুজনের যাতায়াত বাড়তে লাগল। শোনা যাচ্ছে পুরানো ক্লাবঘরটা ভেঙে নতুন পাকা ছাদের ক্লাবঘর বানিয়ে দিচ্ছে সুজন। তারই তদারক করতে দু'বেলা এ পাড়ায় এসে হাজির হয় সে। মল্লিকাদের বাড়ির কিছুটা দূরে বাইক ঠেকিয়ে সিগারেট খায়। তখন ক্লাবের কেউ না কেউ সঙ্গ দেয়।
মল্লিকা কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে এড়িয়ে যায়। দেখেও যেন দেখতে পায় না, এমন ভাব করে সরে যায়। কখনো কখনো যাতায়াতের রাস্তায় বাইকটাকে এমনভাবে রাখে যেন মল্লিকাকে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল ঠেলে পেরোতে হয়। বুঝতে পারে একজোড়া ধূর্ত চোখ তার শরীরটাকে মেপে নিচ্ছে। কিছু প্রতিবাদ করে না সে। এইভাবে চলে যায়।

দু'একদিন পরের ঘটনা। মল্লিকা তখন ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, এমন সময় শোনা গেল, বাইরে থেকে কেউ একজন ডাকছে," বাড়িতে আছেন?" দরজা খুলে মল্লিকা দেখল, একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক একটি কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মল্লিকার দিকে সেটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন," নিচের কাটা অংশে রিসিভ করে আমাকে দিন।" মল্লিকা কাগজে হাত না দিয়েই বলল," এটা কী?"
" পুরসভা থেকে ডেকে পাঠিয়েছে।আপনারা গত চার বছর ধরে বাড়ির ট্যাক্স দেননি।"
কাগজটার নির্দিষ্ট জায়গায় সই করে রিসিভ করা অংশ ভদ্রলোককে ফেরৎ দিয়ে নোটিশটি নিয়ে বাড়িতে ঢুকল মল্লিকা।তারপর সেটিকে তুলে রেখে ইউনিভার্সিটি চলল।

রাতে বাড়িতে বসে বসে চিন্তা করতে থাকল, কী করা যায়। কাল একবার নাহয় কাউন্সিলরের সঙ্গে দেখা করা যাক। এতদিনের ট্যাক্স বাকি, তার কাছে তো তেমন কোনো সম্বল নেই, যদি কাউন্সিলরকে অনুরোধ করে মকুব করা যায়। সাত পাঁচ চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন রবিবার, কাউন্সিলর সকালবেলাটা বাড়িতেই ধাকেন। মল্লিকা ছুটল তাঁর কাছেই।

কাউন্সিলর মল্লিকাকে চিনতে পারলেন, বসতে বললেন। জানতে চাইলেন," বলুন, আপনার কী সমস্যা?" মল্লিকা এক এক করে সব বলল,তার বাড়ির অবস্থা, পুরসভার নোটিশ। মাঝে মাঝে কাউন্সিলরের মোবাইলে একটার পর একটা ফোন আসার জন্য বলার ব্যাঘাত ঘটল। যাই হোক, সবটা শুনে তিনি কিছু একটা বলতে যাবেন, এমন সময় হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লেন নেতা অবিনাশবাবু। কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলেন," কী ব্যাপার তপন, তুমি এখন আর আমাকে পাত্তাই দাও না। কবে থেকেই তোমাকে বলে রেখেছি সুজনের মাস্টার প্ল্যানটা স্যাংশান করাতে, সেটা এখনও ঝুলে আছে?" বলতে বলতেই মল্লিকার দিকে তাঁর চোখ গেল। কিছুটা আন্দাজ করেই বললেন, " তুমি সেই দিনু সামন্তর মেয়ে না? এখানে কী মনে করে? তোমার তো কিছু সাহায্যের প্রয়োজন নেই তাহলে এখানে?" কথাগুলো শেষ করে কাউন্সিলরকে বলল," জানো তপন, এই মেয়েটাকে আমি নিজে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। লোক পাঠিয়েছিলাম, আমার লোককে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এরা ভাঙবে, তবু মচকাবে না। যাক্ গে তপনের ব্যাপার, তপন বুঝবে। আমি যেটা বলছিলাম,  ..."
কাউন্সিলর তপন দাস অবিনাশবাবুর একান্ত অনুগত, বলা ভালো, অবিনাশবাবুর জন্যই আজ সে কাউন্সিলর। কাজেই তপন মল্লিকাকে জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর এ ব্যাপারে কিচ্ছু করার নেই।

মল্লিকার সামনে আবার ভয় শরীর ধারণ করে ভয় দেখাতে লাগল। বাড়িটাকে রক্ষা করতে হবে। মাথার ওপর ছাদ বলতে এই বাড়িটাই। এই বাড়িটাই এখন তার রক্ষক, তার গার্জেন। তাই পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করে নেয়।

পরদিন আবার ক্লাস কামাই। পুরসভায় হাজির হল। সকাল এগারোটা নাগাদ চেয়ারম্যান চলে আসেন। তার আগেই পৌঁছে গেল মল্লিকা। চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করার জন্য সে মরিয়া। গিয়ে শুনল, চেয়ারম্যান জরুরি মিটিং-এ ব্যস্ত আছেন। এক ঘণ্টা পরে আসতে হবে। মল্লিকা সেখান থেকে নড়ল না। ভিজিটরদের জন্য যে বেঞ্চ পাতা আছে সেখানেই বসল। একজন মাঝবয়সি মহিলা দরজার পাশে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন, তিনিই চেয়ারম্যান স্যারের অ্যাটেনডেন্ট। বেশ মিশুকে ভদ্রমহিলা, নিজের থেকেই মল্লিকার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। একে একে অনেক কথা হল দুজনের মধ্যে। তিনিই মল্লিকাকে বললেন," দাঁড়াও, মিটিংয়ের মাঝখানে যখন চা দিতে যাবো,তখন আর একবার স্যারকে  তোমার কথা বলবো।"

মোটামুটি চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর চা-বিস্কুট নিয়ে ঢুকলেন ভদ্রমহিলা। পাঁচ সাত মিনিট পর বেরিয়ে এসে বললেন," স্যার তোমাকে ডাকছেন।"

ভেতরে ঢুকেই মল্লিকা দেখল বেশ বড় ঘর, একসঙ্গে ষোলো সতেরো জন বসে আছেন। মিটিংয়ের মাঝে এখন একটু বিরতি চলছে। মল্লিকাকে দেখেই চেয়ারম্যান বললেন," বলুন, আপনার কী বক্তব্য।"
মল্লিকা এর আগে চেয়ারম্যানকে কোনোদিন দেখেনি। ষাটোর্ধ ভদ্রলোক, মাথার বেশিরভাগ চুল সাদা,পরনে সাদা প্যান্ট এবং নেভি ব্লু টি সার্ট।


" স্যার, আমার নাম চন্দ্রমল্লিকা সামন্ত। আপনারা আমার বাবার নামে নোটিশ পাঠিয়েছেন গত চার বছরের ট্যাক্স মিটিয়ে দেওয়ার জন্য।"
" হ্যাঁ, সে তো দিতে হবেই। ট্যাক্স বাকি থাকলে নোটিশ তো যাবেই।"
" কিন্তু স্যার, আমার ট্যাক্স দেওয়ার মত কোনো ক্ষমতাই নেই। এতদিন আমার অসুস্থ বাবা কোনওরকমে বেঁচে ছিলেন, এখন তিনিও মারা গেছেন। আমি বেকার, কোনওরকমে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। এই অবস্থায় আপনি কনসিডার না করলে আমি কোথায় যাবো? চেয়ারম্যান সাহেব সবকিছু শুনে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, " সে কি! আমার তো জানা ছিল না। আমাকে আগে কেউ বলেনি। তোমাদের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তপন দাস, তুমি তার কাছে গিয়েছিলে?"
" হ্যাঁ স্যার, কিন্তু উনি বললেন,..."
ওর কথাটা কেড়ে নিয়ে চেয়ারম্যান তপনের দিকে দৃষ্টি ঘোরালেন," তপন, এই মেয়েটি যা বলছে, তা ঠিক?"
পুরসভার মিটিংয়ে অন্য সব কাউন্সিলরের সঙ্গে তপন দাসও উপস্থিত ছিলেন। চেয়ারম্যানের কথার জবাবে তিনি বলেন," হ্যাঁ ঠিক, তবে এভাবে যার তার ট্যাক্স মকুব করলে পুরসভা চলবে কী করে? তাছাড়া ও কোনোদিন আমাদের পার্টির মিটিংয়ে যায় না। অবিনাশবাবু নিজে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, মেয়েটি যায়নি। তারপরেও কী করে.. ?"
চেয়ারম্যান স্যার চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন," তপন, এমন কিছু বলো না বা করো না, যাতে পার্টির ক্ষতি হয়, যাতে বিরোধীরা বলবার সুযোগ পায়। অবশ্য আমি এ বিষয়ে বিরোধী দলনেতা পুলক বিশ্বাসের কাছে জানতে চাইছি, কী করা উচিত?"
পুলকবাবু বললেন," দাদা, অন্যান্য বিষয়ে আমি আপনার বিরোধিতা করলেও এ ব্যাপারে আমার ভোট আপনার দিকেই।" ব্যস, আর কোনো কথা নয়  চেয়ারম্যান স্যার মল্লিকাকে বললেন," তুমি বাইরে গিয়ে একটু অপেক্ষা করো, আমি লিখে দিচ্ছি, সেটা ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে দেখাবে। যতদিন পর্যন্ত তুমি স্টুডেন্ট থাকবে ততদিন তোমাকে বাড়ির ট্যাক্স দিতে হবে না।"

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments