উদয়ের পথে
অষ্টাদশ পর্ব
মলয় সরকার
যাই হোক ,এসে গেছি Ryoanji Temple এ। এতদূর এসেছি আর পয়সার অভাবে ঢুকব না! বাঙ্গালীর ছেলে বিদেশে এসে হেরে যাব পয়সার জন্য! সে কি হয়!
জয় মা , বলে টিকিট কেটেই ফেললাম।ঢুকে তো পড়ি, তারপর দেখা যাবে, বুদ্ধের কৃপায় কি হয়।
ঢুকে দেখি, পাথর বিছানো পরিচ্ছন্ন রাস্তা চলে গেছে ভিতরের দিকে। রাস্তার পাশে পাশে নানা গাছ পালা।গাছপালায় ছাওয়া প্রশস্ত রাস্তায় খেলা করছে মেনি বেড়ালের মত নরম রোদ আর ছায়া। তার তলায় হাঁটতে বেশ ভালই লাগে। কোনো হৈ হট্টগোল নেই, চেঁচামেচি নেই, নোংরামি নেই, এমন জায়গায় মন স্থির হবে না তো কোথায় হবে।
তাই বোধ হয়, এখানে একসময় সমস্ত রাজারা চিরশান্তির জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। তাই এখানে রয়েছে, সাতজন রাজার সমাধিক্ষেত্র (Seven Imperial Tombs)। এটি সম্ভবত; পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন সময়ে তৈরী হয়েছিল। তবে এ নিয়ে অনেক মতদ্বৈধতা আছে।
মন্দিরে ঢোকার প্রবেশপথ
যাই হোক, এটি রক গার্ডেন নামেও বিশেষ পরিচিত।এটি বিখ্যাত এর Karesansui (Dry landscape) এর জন্য। এখানে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কিছু পাথর সাজানো আছে। যদিও আমি তার অর্থ কিছু উদ্ধার করতে পারি নি, অত জ্ঞান আমার নেই , আমি নিরক্ষর পথিক মাত্র। তবে দেখতে মনের এবং চোখের যে একটা ভাল লাগা বা আবিষ্টতা ছিল এটা বলতে পারি।আসলে সুন্দরের বোধ হয় কোন আলাদা ভাষা হয় না। তার জন্য মনকে খোলা রেখে অনুভূতিকে ছড়িয়ে দিলেই যে কোন সৌন্দর্য , কোন শিল্প প্রীতির জ্ঞান ছাড়াই ,বোধগম্য হয়।অন্ততঃ আমার নিজের অনুভূতি আর জ্ঞান দিয়ে আমি এটুকুই বুঝেছি।তাই পিকাসোর আঁকা কি রঁদার ভাস্কর্য , যে কোন দেশের সুর, কবিতা আমার কাছে সবই অদ্ভুত সৌন্দর্য্যের অনুভূতি আনে।আমি সব থেকেই রস আহরণ করতে পারি আমার মত করে।
এখানে তার মধ্যেও রক গার্ডেন বলে যে অংশটি রয়েছে, সেখানে বারান্দার একটু নীচে বেশ কিছুটা ঘেরা জায়গাতে (দৈর্ঘ্য ২৫ মি, প্রস্থ ১০ মি) সাদা পাথরের আস্তরণের মধ্যে শিল্পের কোন অজানা শৈলীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাত্র পনেরোটি পাথর সযত্নে রাখা রয়েছে।এটি হল ছোট গ্র্যাভেলস পাথরের সমুদ্রে ভাসমান পনেরোটি পাথর, যার ,মাত্র চৌদ্দটি কোন এক জায়গা থেকে দেখা যাবে। এই গোটা পাথরের বাগানে একমাত্র , কয়েকটি পাথরের গায়ে একটু মস জাতীয় কিছু ছাড়া কোন সবুজের চিহ্নমাত্র নেই।
শুনলাম,এর দেওয়ালটি যে ইঁট দিয়ে তৈরী তা তেলের মধ্যে ফোটানো হয়েছে ব্যবহারের আগে।
তবে হেঁটে হেঁটে আমাদের পায়ের অবস্থা বেশ শোচনীয়। এখানে দেখতে গেলে বেশ কিছুটা হেঁটে ঘুরতেই হয়।তাই তাকে অস্বীকার করেও এগিয়ে চললাম, জীবনের মত এই সমস্ত সৌন্দর্যকে আন্তরিক ভাবে গিলে নিতে।
এখানকার সৌন্দর্য নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেছেন, এখানের বাগান সাজানোর নানা গূঢ় তত্বের কথা, আবার কেউ বলেছেন, এর মাথামুণ্ডু কিচ্ছু নেই। সব একটা প্রাকৃতিক বিশেষত্ব নিয়ে এইমাত্র। তবে এ নিয়ে যে গবেষণার অন্ত নেই তা বোঝা যাচ্ছে।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি একেবারে মন্দিরে। আর এসব মন্দিরে তো দেবতা বা দেববিগ্রহ দর্শন করার মত কিছু নেই। আছে কিছু বড় বড় কাঠের ফাঁকা ঘর। আর কোথাও কোথাও তার দেওয়ালে জাপানী রীতির কিছু আঁকা। জাপানী রীতির আঁকাতে একটা জিনিষ দেখলাম, কোথাও খুব গাঢ় বা বেশি ঊজ্বল রঙের আধিক্য নেই। সবটাই কেমন যেন , অনুজ্বল অথচ স্পষ্ট শান্ত মহিমায় আচ্ছন্ন বা আবিষ্ট। সময় থাকলে অনেকক্ষণ বসতাম। অনেকেই চোখ বুজে বসে রয়েছেন।
🍂
সময়ের সাথে তাল দিয়ে চলতে হচ্ছে। তাই এগিয়ে এলাম বাইরের পথের দিকে।
এখান থেকে অল্প দূরেই রয়েছে Ninnaji Temple।এটি যদিও নবম শতাব্দীতে তৈরি, আমরা আর এর ভিতরে ঢুকলাম না। বাইরে থেকেই এক ঝলক দেখে এগিয়ে গেলাম।এখানে নিয়ম হল,
রাজ বংশের কোন রাজপুত্র এসে এখানে প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব নেবেন।
এটিও পুড়ে যায় ১৪৬৭সালে। পরে এটি রাজপরিবারের দাক্ষিণ্যে আবার পুনর্নির্মিত হয়।এটিতে একটি পাঁচতলা টাওয়ার আছে। এখানে অনেক মন্দিরের সঙ্গেই পাঁচতলা টাওয়ার আছে।এই পাঁচতলার অন্তর্নিহিত অর্থ হল, আমাদের যে পঞ্চভূত আছে ক্ষিতি, অপ ,তেজ মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চভূতের উদ্দেশ্যে এর এক একটি তলা নির্মিত হয়।
এ ছাড়া এখানে একটি সুন্দর জলাশয় আছে জাপানী রীতিতে তৈরী।মন্দিরটি বৌদ্ধ মন্দির।
আমরা এগিয়ে গেলাম এখান থেকে কাছেই Kinkakuji Tample এর দিকে। অল্প রাস্তা তবে রাস্তার সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয়। আমাদের দেশের মতই সবুজ চাষের মাঠ রাস্তার পাশে। জায়গাটা নিছক জাপানের গ্রাম্য এলাকা। তবে ওই এক কথা, এখানে সব জায়গায় পরিচ্ছন্নতা আর নীরবতার শান্তি, সে গ্রাম বা শহর যা-ই হোক। সেটিই সৌন্দর্যের আর এক দিক।
মন্দিরের ভিতর জলাশয়
আমরা এসে পৌঁছালাম কিঙ্কাকুজি মন্দিরে। এটিকে আবার Rokuonji Temple ও বলে।Kinkakuji Temple এর অর্থ "Temple of the Golden Pavilion আর Rokuonji Temple এর অর্থ Deer Garden Temple'। তবে যাই হোক , এটির খ্যাতি এর গোল্ডেন প্যাগোডা ,যার ত্রিতল পর্যন্ত সোনালী রঙে মণ্ডিত । মন্দিরের ছায়া পড়ে পাশের সুন্দর কাকচক্ষুর মত পরিষ্কার জলের উপর। সে যে কি সুন্দর দৃশ্য না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না।
এখানে এসে আবার সেই সমস্যা। এখানে টিকিট কাটাও তো সেই এক ব্যাপার -অনেক টাকার ব্যাপার। তবে শুনলাম, এখানে এটিএম আছে। সেটা অবশ্য অনেক নিশ্চিন্ততা দিল।
মন্দিরের সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে পার্কিং, মন্দিরটিও বেশ একটা চৌরাস্তার মাথার মত জায়গায় রয়েছে।
ঢুকলাম ভিতরে।
ঢুকেই সামনে রয়েছে একটি জাপানী প্রথায় বেশ বড় গাছ পাথর দিয়ে সাজানো বড় জলাশয়।
এই মন্দিরটি আসলে একটি জেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মন্দির, যেটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবেও আখ্যাত। এখানে প্রতি বছর প্রচুর মানুষের সমাগম হয়, কেবলমাত্র এর সৌন্দর্য্যের জন্য।তা ছাড়াও এটি, কিয়োটোর বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধগুলির অন্যতম।
চলুন এগোব আমরা আরও সামনের দিকে। সঙ্গে থাকুন আপনারা, আমার প্রিয় পাঠক বন্ধুরা–
ক্রমশঃ-
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments