মিলি ঘোষ
বাসস্ট্যান্ডের পেছনের পাঁচিলে কী একটা পাতা মাথা বের করে আছে। নবীন পাতা। সুতোর মতো তার শাখা। কিংশুক বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ। দু'বার মুখ ঘুরিয়ে দেখল পাতাটাকে।
নিজের মনেই বিড়বিড় করল, প্রাচীরের গাত্রে এক নামগোত্রহীন ....
তখনই সামনে দিয়ে একটা লাল রঙের গাড়ি বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কেউ একজন মুখ বাড়িয়ে ডাকছে। হ্যাঁ, কিংশুক বলেই তো ডাকছে। গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকার মতো পরিচিত কেউ আছে বলে মনে পড়ল না কিংশুকের। অন্য কাউকে ডাকছে হয়তো। তবু, দু'বার চোখ গেলো। ভাস্বর না?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক বললেন, "দাদা, আপনাকে ডাকছে বোধহয়।"
এবার কিংশুক পায় পায় এগিয়ে গেলো।
"আয় ওঠ। কতবার ডাকব তোকে? পেছনের গাড়ি হর্ন মারছে।"
কিংশুক গাড়িতে উঠে বলল, "কবে কিনলি?"
"তা প্রায় বছর তিনেক। ভালো কথা। তুই এখন কী করছিস বল তো?"
"তেমন কিছু না। ওই ফেরিয়ালার কাজ।"
"সেলসে আছিস। কোন কোম্পানি?"
"ছোটখাটো। বাদ দে। তোর কথা বল।"
ভাস্বর একবার বাইরের দিকে তাকাল।
তারপর বলল, "তোকে ক'দিন ধরে খুঁজছিলাম। ফেসবুকেও তো পেলাম না। হঠাৎ রাস্তায় এভাবে তোকে পেয়ে যাব ভাবিনি।"
কিংশুক গাড়িটাতে ভালো করে চোখ ঘুরিয়ে বলল, "তুই আমাকে খুঁজছিলি? বলিস কী রে!"
ভাস্বরের অনুরোধ রাখতে লেকটাউনে ওর ফ্ল্যাটেই যেতে হলো কিংশুককে। ফ্ল্যাটে ঢুকে অস্বস্তি হতে লাগল কিংশুকের। পয়সাওয়ালা লোকেদের বাড়িতে ও কিছুতেই সহজ হতে পারে না। ভাস্বরের শোকেসে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের বোতল।
"ওয়াইন চলবে তো তোর?" ব'লে কিংশুকের উত্তরের অপেক্ষা না করে সাজিয়ে গুছিয়ে বসল।
বলল, "শোন, একটা কাজ আছে। ভালো স্যালারি দেবে।"
"তোর কোম্পানিতে? তুই আজকাল মানুষকে ডেকে ডেকে চাকরি দিচ্ছিস?"
"আরে না, না। আমার কাজটা শুধু যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। সোজা বাংলায় দালালি।"
কিংশুক গ্লাস নামিয়ে রেখে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বলল, "দালালি করে এত পয়সা করেছিস?"
"কাজটা কী, সেটা শোন। তোর তো রাস্তার কুত্তাদের খাওয়ানো স্বভাব আছে। স্কুলে পড়তে দেখেছি তো, কুকুর টুকুর ভালোই হ্যান্ডল করতে পারিস। পলাশ স্যারের জাঁদরেল অ্যালসেশিয়ানটার সঙ্গেও বন্ধুত্ব করেছিলি, মনে আছে তোর?"
"কার সারমেয়কে খাওয়াতে হবে বল?"
"এক ভদ্রলোকের বিশাল এক কুকুর আছে। ভদ্রলোক টাকার কুমীর। কিন্তু স্ট্রোক হয়ে একটা সাইড পড়ে গেছে। ফিজিও করে এখন অনেকটাই ভালো। তবে হাঁটাচলা করতে পারেন না। সমস্যা হলো ওই কুকুরের ভয়ে দু'বেলার আয়া, রান্নার মাসি কেউ ওই বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায় না। তোকে সারাদিন কুকুরটাকে সামলাতে হবে। আর ওই বুড়োর সঙ্গে গল্প করতে হবে। ওঁর একটাই ক্রাইটেরিয়া, যে এই কাজটা করবে, সে যেন শিক্ষিত হয়।"
কিংশুক প্রথমে অবাক হলো। তারপর হাসল।
বলল, "এই প্রথম কেউ আমার শিক্ষার দাম দিতে চাইল।"
জানতে চাইল, "রাতে থাকতে হবে নাকি?"
"সে তোর ইচ্ছা। রাত দশটার পরে কুকুরটাকে গ্যারেজ করে তুই চলে আসতে পারিস। থাকতেও পারিস। ঘর আছে। খাওয়া ফ্রী। স্যালারি কত দেবে জানতে চাইলি না তো।"
"কত?"
"পঞ্চাশ হাজার। বাট নো বারগেনিং।"
🍂
সোমনাথ ঘোষাল জানলা দিয়ে বাইরেটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, "আজকাল আর বৃষ্টি ভালো লাগে না।"
কিংশুক বলল, "কেনো স্যার? গরম থেকে তো মুক্তি পাওয়া গেলো। যা গরম পড়েছিল।"
"তোমার এই স্যার স্যার করাটা বন্ধ করো তো। আর আপনি নয়, তুমি। আমার ছেলে বেঁচে থাকলে তোমার থেকে বড়োই হতো। জেঠু ডেকো। খুশি হবো।"
"আচ্ছা স্যার। ওহ্! সরি, জেঠু।"
হাসতে গিয়েও হাসি থেমে গেলো দু'জনেরই। ঘরের মধ্যেই বিদ্যুতের ঝলক। সঙ্গে কান ফাটানো শব্দ। কিংশুক গিয়ে জানলাটা আটকে দিল।
সোমনাথ ঘোষাল বললেন, "বুঝলে তো, কেন এখন আর বৃষ্টি ভালো লাগে না।"
তাঁর সারমেয়টিও এই একটি বিষয়ে জব্দ। ভয়ে গুটিয়ে থাকে। যা ওর চেহারা আর স্বভাবের সঙ্গে মানায় না। কিংশুক ওকে কাছে ডেকে গায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মালিক আদর করে ওর নাম রেখেছে টাপুর। একেবারে ছোট্ট অবস্থায় সোমনাথবাবু ওকে নিয়ে এসেছিলেন। এই পাঁচ বছরে শরীরে এবং শক্তিতে টাপুর প্রায় বাঘের সমতুল্য।
কিছুদিনের মধ্যেই কিংশুক বুঝে গেছে ওর কাছে টাপুরের থেকে টাপুরের মালিকের দায়িত্ব কোনও অংশে কম নয়। জেঠুর সঙ্গে ওর গল্প রাজনীতি, খেলাধুলা, সঙ্গীত থেকে একেবারে রবীন্দ্রনাথ শেকসপিয়র পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু সোমনাথবাবু নিজের পরিবারের কথা খুব কম বলেন। টুকটাক যে'টুকু বলেছেন, তার থেকে কিংশুক বুঝেছে পুত্রের অকাল বিয়োগের পর তাঁর স্ত্রীর শরীর একেবারেই ভেঙে যায়। এক বছরের মধ্যে তিনিও চোখ বোজেন। তারপরেই টাপুরকে নিয়ে আসেন তিনি। একমাত্র কন্যা রাই থাকে জার্মানিতে স্বামী পুত্রকে নিয়ে। ফোন, ভিডিও কল রোজই আসে। কিন্তু দেশের মাটিতে পা দেয় না ভুলেও।
সোমনাথবাবু এখন অনেকটাই সুস্থ। লাঠি নিয়ে ঘরের মধ্যে হাঁটাচলা করেন। দিনের আয়াকে তাই ছুটি দেওয়া হয়েছে। তবে রাতের মহিলাটি আছে। কিংশুক সকাল দশটা নাগাদ পৌঁছে যায়। পাইকপাড়ার বাড়িতে ওর মা সারাদিন একা থাকেন। কিংশুকের নিজের খরচ বলতে গেলে কিছুই নেই। মাসে মাসে যে টাকা সোমনাথবাবু ওর অ্যাকাউন্টে পাঠান, তা দিয়ে ভদ্রমহিলা শাড়ির ব্যবসা শুরু করেছেন। শুনে খুশি হয়েছেন সোমনাথ ঘোষাল।
একদিন গল্পের মাঝে হঠাৎ থেমে গিয়ে সোমনাথবাবু বললেন, "আমি বোধহয় তোমার প্রতি অন্যায় করছি।"
কিংশুক অবাক হয়ে উত্তর দিল, "কী বলছ জেঠু! তুমি আমার জীবনের মানচিত্রটাই পাল্টে দিয়েছ।"
"ঠিকই বলেছ। আমি এভাবে নিজের স্বার্থে তোমাকে আটকে না রাখলে আজ তুমি স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে।"
কিংশুক লজ্জিত মুখ হাসে।
বলে, "ওই ধরনের সুখ আমি ঠিক পেতে চাইনি।"
"বয়স কত হলো?"
"পঁয়ত্রিশ।"
"আর দেরি কোরো না। পাত্রী খোঁজো। সে তোমার মায়ের সঙ্গে ব্যবসাটাও করতে পারবে। আর রাতে তো তুমি বাড়িতেই থাকবে। তবে তোমার কাজের টাইম একটু কমিয়ে দেব।"
সোমনাথবাবুর উৎসাহেই কিংশুক একটা বিয়ে করে ফেলে। সাত বছরে কিংশুকের স্যালারি বেড়ে হয়েছে পঁচাশি হাজার। মধ্যবিত্ত ধ্যানধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠা কিংশুক এতগুলো টাকা হাত পেতে নিতে খুব সঙ্কোচ বোধ করে।
আজকাল টাপুরের তেজ কমেছে। বারো বছর বয়স হলো। বসে বসে ঝিমোয়। অপরিচিতের উপস্থিতিতে পাড়া কাঁপানো হুঙ্কার নেই। এই বয়সটা কুকুরদের বার্ধক্য কাল। হঠাৎ একদিন টাপুরের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। ডাক্তার দেখিয়েও কোনও সুরাহা হলো না। চলে গেলো টাপুর। ভুগল না। ভোগালো না।
টাপুরহীন বাড়িতে পিন পতনের স্তব্ধতা। টাপুরের খাবার থালা, জলের বাটি, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় দেওয়ালে টাপুরের ছবি। শুধু টাপুর নেই। দু'দিন কোনও কথা বললেন না সোমনাথবাবু।
তৃতীয় দিন কিংশুককে বললেন, "এবার রাই আসবে। আমার মেয়ে।"
কিংশুক কিছু না বুঝেই বলল, "টাপুরের খবরে কষ্ট পেয়েছেন বোধহয়।"
সোমনাথবাবু মুখ তুলে তাকালেন কিংশুকের দিকে।
বললেন, "তোমার তাই মনে হলো?"
একটু থেমে আবার বললেন, "টাপুর ছিল ওর জাত-শত্রু। ওর ধারণা, আমি ওর থেকে টাপুরকে বেশি ভালোবাসি। খুব অশান্তি করত টাপুরকে নিয়ে। তোমার মতো একটি ছেলে টাপুরের দেখাশোনা করত। ওকে যা তা অপমান করে তাড়িয়ে দিল। ছেলেটি আর দ্বিতীয় দিন এ বাড়িতে আসেনি।"
এই ঘটনা শুনে কিংশুক একটু শঙ্কিত হয়।
সোমনাথবাবু সেটা বুঝেই বললেন, "তোমাকে আমি জানিয়ে রাখলাম। দরকার হলে ও যে ক'দিন থাকবে, তুমি ছুটি নিয়ে বাড়িতে থেকো।"
"ঠিক আছে জেঠু।" ঘাড় নাড়ে কিংশুক।
রাই সত্যিই এলো। আট বছর পর। কিন্তু কিংশুককে দেখে ওর মেজাজ খারাপ।
স্নান করে এসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, "বাপির সঙ্গে আমার কথা আছে।"
"সিওর।" ব'লে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো কিংশুক।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শুনতে পেল, "টাপুর তো নেই। তাহলে একে পুষছ কী জন্য? পয়সা বেশি হয়েছে তোমার?"
বাইরে লু বইছে। রাস্তায় লোক খুব কম। সূর্য বোধহয় সব তাপটাই মাটিতে উপুর করেছে আজ। ফুটন্ত জলের বাষ্পের দিকে তাকালে যেমন হয়, কিংশুকের সামনেটা তেমনই। ঘোরের মধ্যে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলল কিংশুক।
বেশ ভোরের দিকে রাতের আয়ার ফোন আসে কিংশুকের কাছে, "দাদা! জেঠু হাসপাতালে।"
কিংশুক হুড়মুড় করে উঠে বসে বিছানায়।
"সে কী! কী হলো হঠাৎ?"
"আর বোলো না। যেমন দজ্জাল মেয়েটা। তেমনি জামাইটা। এসে থেকে জেঠুর সঙ্গে ঝগড়া করছে।"
"আরে, জেঠু কোন হসপিটালে আছে বলো।"
"এপুলোতে।"
"এপোলো? আমি এখনই যাচ্ছি।"
"হ্যাঁ, দাদা। তুমি যাও। নাহলে মানুষটা বাঁচবে না। বাড়ি বিককিরি করার জন্য এসে থেকে চাপ দিচ্ছে।"
কিংশুক লাইন কেটে দিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে যায়।
হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল রাইয়ের বর।
কিংশুককে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে বলল, "আপনার এখানে কী দরকার?"
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, "আপনি আসুন।"
কিংশুক ওকে পাশ কাটিয়ে হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে এনকোয়ারি থেকে খবর নিল সোমনাথ ঘোষাল আইসিইউ'তে আছেন। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে রইল ও বেঞ্চে। ঘন্টা খানেক পরে চরম খবরটা পাবার পর আর দাঁড়ায়নি কিংশুক। ফেরার সময় ট্যাক্সিতে বসে মনে পড়ছিল জেঠুর কথাগুলো।
একদিন বিকেলের দিকে বলছিলেন, "কিংশুক, তুমি আমার পুত্রশোক অনেকটাই ভুলিয়েছ। তোমাকে একটাই অনুরোধ, মরদেহ নিয়ে টানাটানির মধ্যে তুমি থেকো না। বেঁচে থাকতে করাটাই করা। কেউ না জানুক, আমি তো জানি, তুমি আমার শেষ জীবনটা কতটা ভরিয়ে দিয়েছ!"
এমন সৎ পরোপকারী মানুষকে শেষ বারের মতো দেখতে শ্মশানে ভির কিছুটা হয়েছিল। মেয়ে জামাইয়ের মাতব্বরিতে লোকজন একটু দূরত্ব রেখেই দাঁড়িয়েছে। সেই ভিড়ের পেছনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল কিংশুক।
ক'দিন অস্বাভাবিক গরমের পর আজ সন্ধ্যা থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে একটা হালকা ঝোড়ো হাওয়া। মেঘের গর্জন নেই। আকাশের বুক চিরে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বিদ্যুতের করাল অস্তিত্ব নেই। তবে কি আকাশ আজ নীরবে কাঁদছে? কিংশুক ওপরে এসে ছাদের ঘরের জানলা খুলে দিল। নেট অন করতে এক গুচ্ছ মেসেজ ঝাঁপিয়ে পড়ল। দ্রুত হাতে হোয়াটস অ্যাপের মেসেজ সরাতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো কিংশুকের। অনেক রাতে জেঠু মেসেজ দিয়েছে।
-- "চিন্তা কোরো না, কিংশুক। আমার এক তলার সবক'টা দোকানঘর আমি তোমার নামে লিখে দিয়েছি আগেই। আমার অবর্তমানে দোকানের যাবতীয় ভাড়া পাবে তুমি। আমার উকিল মিস্টার মজুমদারকে তো তুমি দেখেছ। তোমার সঙ্গে সময় মতো তিনি যোগাযোগ করে নেবেন।"
কিংশুক মেসেজটা একবার পড়ল। দু'বার পড়ল। আরও কয়েকবার। তারপর বুকের মধ্যেকার সারাদিনের জমে থাকা কান্নাটা তীব্র বেগে বেরিয়ে এলো।
নিজের মনেই বলতে লাগল কিংশুক, "শুধুই টাকার জন্য যেতাম, জেঠু? আর কি কিছুই পায়নি তোমার থেকে? জেঠু ডাকলেও আসলে তুমি আমার কে, তোমার চেয়ে ভালো কে বুঝেছে বলো?"
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments