জ্বলদর্চি

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনীপর্ব ৭। যন্ত্র পেলো বুদ্ধি /বাসুদেব গুপ্ত

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনী
পর্ব ৭। যন্ত্র পেলো বুদ্ধি
বাসুদেব গুপ্ত

 
-পারসেপ্ট্রন ছিল একটা অদ্ভুত যন্ত্র। এর ছিলো দেখার চোখ, সে চোখের রেটিনা ছিল না, ছিল ৪০০টা ফোটো সেল। কুড়ি বাই কুড়ি করে সাজানো। ছবি থেকে আলো এসে পড়ত এই সেলগুলোর ওপরে। একে বলা হত কৃত্রিম রেটিনা। তারপর এই রেটিনার সংগে জোড়া ছিল ৫১২টা পারসেপ্ট্রন। প্রতিটা রেটিনা ইউনিট সিগন্যাল পাঠাত ৪০টা পর্যন্ত পারস্প্ট্রনকে। পারসেপ্ট্রনগুলো আবার জোড়া ছিল আটটা আর ইউনিটের সংগে। আর ইউনিটে শেষ যে সিগন্যাল পৌঁছবে তা থেকে জানা যাবে মেসিনটা কোন ছবি সনাক্ত করলো তার কোড। 

-এ নিয়ে অনেক হৈহৈ হলো। এনওয়াই টাইমস লিখল, এই মেসিনটি আগামী দিনের সেই মহাবুদ্ধিমান যন্ত্রের প্রথম আবির্ভাবের সূচনা। একদিন এই যন্ত্র হাঁটবে, কথা বলবে, দেখতে পাবে, লিখতে পারবে, নিজের কপি বানাতে পারবে। আর এর একটা আত্মচেতনাও থাকবে। যাকে সোল বা আত্মা বলা হয় ঠিক তার মত এটির এক বোধ থাকবে  নিজের সেলফ সম্বন্ধে। 
দাদু একটু থামলেন। তারপর হাসলেন দূরের ভারচুয়াল ভ্যালির অপূর্ব নীল ও সবুজের ঐকতানের দিকে তাকিয়ে। 
অনির্বাণ মন দিয়ে শুনছে। ওর থ্রিডি ভারচুয়াল গ্লাসের সংগে আছে ১০ টিবি মেমরি, সেখানে সব এনালিসিস করে রেকর্ড করে ফেলছে জ্ঞানগুরু নামের খুব পপুলার অ্যাপ। পরে যেমনটি দরকার তেমনি করে সাজিয়ে দেবে অনির্বাণের জন্য। 

দাদু শুরু করেন আবার।
-বলা যায় আজকের এআই এই পারসেপট্রনেরই উত্তরসূরী। সেনসিং আর আউটপুটের ক্ষমতায় স্মার্ট ফোনের দৌলতে বিপ্লব ঘটেছে তাও ২৫ বছর হলো। এতে ছিল ৪০০ পিক্সেল। ২০০ মেগাপিক্সেল এখন স্কুল ছাত্রের ফোনেও থাকে। আর এআই করার জন্য আলাদা কোন ঘরঘর করে ঘোরা হাজার হাজার গীয়ারওলা জায়েন্ট রোবট লাগে না, ক্লাউডে বসে আছে কোটি কোটি ইনটেলিজেন্স প্রসেসর। তাদের পেটের মধ্যে শক্ত শক্ত প্রোগ্রাম জিপিইউতে সমান্তরাল ভাবে লক্ষ লক্ষ হ্যাঁ নার সমাধান করে চলেছে। সেই প্রোগ্রামও এখন টেলিফোন কানেক্শানের মতই সুলভ। অথচ আমাদের ছোটবেলায় একটা টেলিফোনের জন্য পাঁচ বছর আবেদন করে বসে থাকতে হত যদি না উপরমহলে চেনা শোনা থাকে।

-কিন্তু এই যে এআই বা ক্লাউডে বন্দী করে রাখা দৈত্য কাজ করে কি করে? হ্যানত্যান না বলে সেটা একটু বোঝাও তো। অনির্বাণ অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে বুঝে একটা কামকুইক খেয়ে নেয় টপ করে। এটা ব্রেন লিংকটাকে শান্ত করে তাপমান কমিয়ে দেয়। দাদু দেখেন আর ভাবেন আমাদের ছোটবেলায় আমরা একটা ক্রোসিন গিলে নিতাম। 

-আজকের এআই ঠিক আমাদের এই ব্রেনের প্যাটারনটা নকল করে। এতে আছে স্তরের পর সত্র নিউরন ইউনিট। আর সেগুলো একদিকে জোড়া তার পূর্বসূরী নিউরনের সংগে, আর আর একদিকে জোড়া উত্তরসূরীদের সংগে। একটা অঙ্ক বা সমস্যা যা তুই সমাধান করতে চাস তার প্রশ্নগুলো ধরে নে এক একটা ইভেন্ট বা ঘটনা। ব্রেন যেমনি কিছু দেখল বা শুনলো, সেটাকে সেন্সার দিয়ে প্রথমেই বৈদ্যুতিক সিগনালে পাল্টে নেবে। তেমনি এ আই বানাতে গেলে আমাদেরও এই ইভেন্টটাকে শূন্য একের বাইনারী ডিজিট বা বিটে পাল্টে নিতে হবে। তারপর এটাকে ফিড করা হবে প্রথম স্তরে। ধর সিগনালের মান বা ভ্যালু হল সংখ্যা ১৬৫৭। এবারে এই লেয়ারের একটা নিউরনে সেট করা আছে ১৬৫০ সহ্য করার উচ্চতম সীমা। যেই ১৬৫৭ তার বেশী হল, তখন নিউরন আর সহ্য করতে না পেরে পরের লেয়ারকে সেটা জানিয়ে দিল। 

খানিকটা পরচর্চার মত। সকাল বেলায় ফোন করে রিমা সীমাকে জানালো কাল মীনাকে দেখা গেছে কফি হাউসে কৌস্তুভের সঙ্গে। সীমা মাথায় চুপচাপ হজম করে নিল। কিন্তু যদি কেউ বলত মীনা পালিয়ে গেছে কৌস্তুভের সঙ্গে, তখন আর হজম করতে পারল না। তাড়াতাড়ি ফোন লাগালো রঙ্গিলাকে।  ঠিক তেমনি এই নিউরনের কাজ। 

🍂

কিন্তু সংখ্যাটা অন্য কিছু, ধর ৭৮৯। এবার ঐ লেয়ারে একটা নিউরনে সহ্যসীমা ৮০০ আর একটায় ৭০০। তাহলে প্রথমটি চুপচাপ বসে রইলো। দ্বিতীয়টির কিন্তু সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গেল। তখন সে সিগনাল পাঠিয়ে দিলো তার সংগে জোড়া সব নিউরনকে। এইভাবে যেতে যেতে পৌঁছল শেষ লেয়ারে। ধর শেষ নিউরনের সংগে লাগানো আছে একটা করে লাইট। তাহলে যে নিউরনটা পা সরাবার নিউরন তার লাইটটা জ্বলে উঠলো। 
এইভাবে কৃত্রিম বুদ্ধির নেটওয়ারক বুদ্ধিমানের মত সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোন ইনপুট পেলে কি করতে হবে। এটাই কিন্তু ইনটেলিজেনসের প্রথম চিহ্ন। 
-সে তো হল। কিন্তু ঐ সংখ্যাগুলো কে ঠিক করবে! কোটি কোটি নিউরনের কোটি কোটি সংখ্যা। সম্ভব নাকি কারো পক্ষে করা?
-সেইখানেতেই আসছে অটোমেটিক লার্নিং সিস্টেমের গল্প। নে তুই কফিটা শেষ কর। আমি আবার বলছি। 
দাদু উঠে গিয়ে কাপটা রেখে দিয়ে হাতের ভন্গী করতেই একটা হলোগ্রাফিক পর্দা ফুটে উঠল। তাতে অজস্র স্তরের ছবি। একদিক দিয়ে সিগনাল ঢুকছে। তারপর আলোর মত সেটা ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্য সব লেয়ারে। এক একটা বিন্দু জ্বলছে নিভে যাচ্ছে। 
-এটা কি এআই দেখছো নাকি! ইনপুট লেয়ার আউটপুট লেয়ার। অনির্বাণ বেশ আত্মবিশ্বাসের সংগে জিজ্ঞেস করে। 
-না। এটা আমার নিজের ব্রেনের নিউরোমিটারে তোলা ছবি। আমি কফি খাচ্ছি। এই দেখ কতগুলো লাইট জ্বলে উঠলো। দেখ কেমন পরের পরের নিউরনগুলো ফায়ার করছে। আন্গুলে দিয়ে দাদু দেখায় কানের পেছনে একটা ছোট্ট কালো বিন্দু। নিউরোমিটার। ই ই জির 
উত্তরসূরী। 
অনির্বাণের এসব দেখে আরও উৎসাহ বাড়ে। মনে পড়ে ওর দাদা নির্মাণের কথা। কফি খেতে কি ভালোবাসত। নিশ্চয়ই ওর মাথাতেও এমনি লাইট জ্বলতো। 

-আচ্ছা দাদু এগুলো তো হলো বাচ্চা এআই। সুপার এআই গড এই ব্যাপারটা কি?

-তোকে এর পর বুঝতে হবে ডাটা হোর্ডিং ব্যাপারটা। ২০০০ সাল থেকেই আমরা মানুষরা ডিজিটাইজ হতে থাকি। একের পর এক কোম্পানি আসে যাদের মূল কাজ যত বেশি সম্ভব তথ্য জোগাড় করে ডাটাবেসে পুরে ফেলা। গুগল পথচলা শুরু করে ১৯৯৮ সালে। ফেসবুক শুরু করে মার্ক জুকারবার্গ ২০০৪ সালে। তখন এর কাজ ছিলো সুন্দরী মেয়েদের ছবি ডাটাবেসে তুলে কে হটেস্ট তার ভোট করানো। এই করতে করতে মার্কের একদিন মনে হয় সারা পৃথিবীর সবার ছবি জোগাড় করলে কেমন হয়। ফেসবুকের পুরোদমে প্রবেশ হয় ২০০৫ সালে। ১৯৯৮ তে শুরু হয় কনফিনিটি আর ১৯৯৯তে শুরু হয় এলন মাস্কের এক্স.কম। সে দুটো মিলে জন্ম হয় পেপ্যাল। যার দখলে চলে যায় ডিজিটাল পেমেন্ট। অর্থাৎ আমাদের টাকা খরচের একটা বড় অংশের টাকা জমা হতে থাকে পে প্যালের হাতে। ১৯৯৪ থেকে ঠুকঠুক করে এগোতে এগোতে আমাজনের মালিক হঠাৎ ২০০০ সালে ম্যান অফ দি ইয়ার হন। আর সেই সংগেই আমাজনের মঞ্চ সব বিক্রেতার কাছে খুলে দেওয়া হয় । যার ফলে আমাজন দু দশকেই হয়ে ওঠে সারা বিশ্বের দোকান এবং একমাত্র দোকানও বলা যায়। আমাজনের কাছে খবর থাকে আমরা কে কি কিনি, কি পছন্দ করি, আমাদের ও আমাদের সব পরিচিতদের ঠিকানা, পোষাকের সাইজ, কম্পিউটারের মডেল। সব। গুগল জানতে থাকে আমরা কি খুঁজছি, যা থেকে জানা যায় আমাদের স্বাস্থ্য বেড়াতে যাওয়া, পছন্দের খাবার, বর্তমান লোকেশন সব। তোর অসুখের লক্ষণ সারচ করে দেখে গুগল জেনে যায় তোর স্বাস্থ্যের হাল হকিকত। তোর খবর সারচ দেখে বুঝে যায় তুই লেফট না রাইট, বাইডেন না ট্রাম্প।  কি বুঝলি?

-বুঝলাম সুপার এআইএর ইনপুট নোড তৈরী হতে শুরু করল ২০০০ সাল থেকেই। 
-একদম ঠিক। সমস্ত তথ্য, সব ভাষা, সব গান, সব পেন্টিং সব কিছুর তথ্য এবং মালিকানা ধীরে ধীরে কয়েকটি কম্পানীর মালিকের কাছে। আর তখনই মানে ২০২৪ থেকে উত্থান শুরু হলো ইনডিয়া মানে আজকের ভারতভূমি দেশে। একদিন দেখা গেল এই দেশের লোকসংখ্যা ১৫০ কোটি। তাদের প্রায় প্রত্যেকের ফোন আছে। কারণ সরকারী আইনমতে ওটিপি না হলে কোন অর্থকরী কাজ করা যাবে না। আর এই ১৫০ কোটির ইন্টারনেট কানেকশনের সুতো ধরা একজনের হাতে। আকাশ নাদকার্ণি। আমেরিকার সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট প্রোভাইডার টি মোবাইল ১২ কোটি মানুষ ব্যবহার করে। সেখানে আকাশের আকাশনেটের ব্যবহারকারী ৫০ কোটি। 

একসময় আকাশ একে একে পৃথিবীর নেটওয়ার্ক কিনতে শুরু করে। আর দু বছরের মধ্যেই তারা হয়ে যায় বিশ্বের ৮০ শতাংশের মোবাইল ও নেট প্রোভাইডার । এরপরেই তারা হঠাৎ একটা ব্যাপার করে। তারা ঘোষণা করে এক সপ্তাহ নাকি সর্ব গ্রহ সম্মেলন হতে চলেছে ও সেই জন্য নাকি আকাশ নেটের খুব ক্ষতি হতে পারে। যেমন সূর্যগ্রহণ হলে লোকে বাইরে বেরোত না, খাবার খেত না, ঠিক তেমনি আকাশ প্রচার করে যে সেদিন সব গ্রহ নাকি এক রেখায় আসবে। তাই সেদিন তারা ডার্ক ডে ঘোষণা করে ও তাদের ইন্টারনেটের সব রাউটারের কানেকশান অফ করে দেয়। 

এটা ইন্ডিয়াতে দৈনন্দিন ব্যাপার। প্রায়ই হত। মাঝে মাঝেই মাইনে বাড়াও, বা ফসলের দাম বাড়াও বা স্ত্রীলোকদের ওপর শক্তিমান লোকদের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য লোকে ভিড় জমিয়ে রাস্তা ঘাট বন্ধ করার চেষ্টা করত। বিশৃঙ্খলা যাতে ছড়াতে না পারে তাই ড্রোন ও মিনি মিসাইল ব্যবহার করে, নানা রকম গ্যাস ছড়িয়েও যদি সমস্যা হত, তখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হত। এদিকে ততদিনে মানুষ ইন্টারনেট ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারত না। পাশের লোককেও মেসেজ পাঠাতে, জনসভায় বক্তৃতা শুনত মোবাইল ফোনে, আর ফুটবল বা ক্রিকেট মাঠে মোবাইলেই খেলা দেখত। মাঠে বসেও। কিন্তু বিদেশের অনেক দেশে ইন্টারনেট বন্ধ কখনও হয়নি, এবারেই প্রথম। ফলে এ নিয়ে বিশ্বজোড়া হৈ চৈ হলো। পুরনো কেবল ও টেলিফোন লাইন দিয়ে কাজকর্ম চালাতে হলো যতদিন না ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম কনক্লেভ সুইজারল্যান্ড আলাপ আলোচনা করে একটা উপায় বার করে। বেশিরভাগ নেট ও মোবাইল পেটেন্ট ছিলো সুইজারল্যান্ডের। চুক্তি হল প্রায় যুগান্তকারী। আকাশ নেট চালু করবে কিন্তু তার বদলে ৫০% পছন্দমত পেটেন্টএর রাইটস তাদের দিতে হবে। এরকম ব্যবসাবুদ্ধি ভারতভূমি ছাড়া কারো হয় না। আকাশ হয়ে গেল বস্তুত ইন্টারনেটের একছত্র অধিপতি। 

এর পরে বেশিদিন লাগেনি পৃথিবীর সব যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আকাশের একচেটিয়া দখল কায়েম করতে। একই সংগে ভারতভূমি হয়ে গেল সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র। আই এন পিতে আমেরিকার ভেটো অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সেটা ভারতভূমির দখলে চলে গেল। 

মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল অনির্বাণ। কিন্তু এত বড় পলিটিকাল লেকচারে সে হাঁফিয়ে উঠে বলল, 
-দাদু আজ এই পর্যন্ত থাক। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যগুলো আমার বিমকে (ব্রেন লিংক) দিয়ে গুরুজীর 
মডেল আপডেট করে দি। যাতে ইচ্ছেমত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করা যাবে। 
দাদুর আরো ইচ্ছে ছিল কিন্তু গুরুজী অ্যাপ কে ফিড করার দরকার শুনে আজকের মত দাদুকে থামতে হল। 

(ক্রমশ)
আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments