প্রৌঢ়বেলা
পুলককান্তি কর
শেষ পেশেন্টটা দেখে উঠতে উঠতে তিনটে বেজে গেল গিরীশ ব্যানার্জীর। পাড়ায় অবশ্য গিরীশ ডাক্তার নামেই পরিচিতি তাঁর। বাড়ির লাগোয়াই চেম্বার। সকাল সন্ধে দুবেলাই সাতটা থেকে শুরুটা যদিও নির্দিষ্ট, শেষ হওয়াটা রোগীদের হাতে। রবিবার শুধু সকালেই রোগী দেখেন। দূর দূরান্ত থেকে রোগীরা আসে, তাই বেলা চারটের আগে ভাত খাওয়া হয়ে ওঠে না তাঁর।
অনেকক্ষণ থেকেই পেটের উপরের দিকটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছিলেন তিনি৷ গ্যাসট্রাইটিসটা বোধহয় এবার ধরেই গেল। দুটো বিস্কিট মুখে দেবেন কি না ভাবছিলেন; বগাদার তাড়ায় তোয়ালে পাজামা নিয়ে ঢুকলেন চানঘরে। তড়িঘড়ি স্নান শেষ করে গা মুছতে মুছতেই হাঁক পাড়লেন, বগাদা, টেবিলে খাবার দাও।
-- চান করতে করতেই খাবি নাকি ? আগে তো বেরো। আমার সব রেডি আছে।
বগাদার এই এক দোষ। টেবিলে বসলে তবেই খাবার গরম করবে৷ এই খিদের মুখে মানুষের তর সয়? বললেও শোনে না। একটু বিরক্তি নিয়েই বাইরে এসে গিরীশ দেখলেন, আজ যেন সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে। খাবারদাবার টেবিলেই সাজানো। পাশে দাঁড়িয়ে গজগজ করছে বগাদা। চেয়ার টেনে বসতে না বসতেই বলল, এত রোগী যখন, মাঝখানে উঠে এসে তো একটু খেয়ে যেতে পারিস।
-- চানটান না করে খেতে ইচ্ছে করে না বুঝলে।
-- তা চান করেই খাবি। না টা করেছে কে ?
-- রোগীরা বসে থাকবে যে !
-- থাকলে থাকবে! ডাক্তার বলে কি আর মানুষ না? যারা বাকি থাকবে তাদের বিকেলে দেখবি।
-- কত দূর দূর থেকে তারা আসে বলতো। সেই নামখানা, হিঞ্জলগঞ্জ, সাহেবখালি থেকে। বেশি বিকেল হলে ফেরার নৌকা পাবে না যে !
-- আর তুই যে মাঝে মাঝেই পেটের ব্যথা বলিস, তার কী হবে?
-- ও কিছু হবে না।
-- হ্যা, তুই তো সবজান্তা! ডাক্তার কিনা! আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। তবে বিকেল তিনটে চারটে পর্যন্ত আর আমি হাঁড়ি আগলাতে পারব না। তুই অন্য ব্যবস্থ করিস৷ বগাদা শাসিয়ে গেল।
বগাদা এই বাড়িতে অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে আছে৷ গিরীশের বাবার আমল থেকে। পুরো নাম সবাই ভুলে গেছে। বগলাচরণটরণ ছিল বোধহয়। সেখান থেকেই শর্টকার্ট হয়ে বগা। পাড়ার ছেলে-ছোকরা থেকে বাজার-হাটের দোকানদার, সবার কাছেই সে বগাদা। গিরীশের থেকে অন্তত বছর দশেকের বড়। সুতরাং শাসনের অধিকার তার আছে৷
-- হ্যাঁগো বগাদা, চিংড়ি দিয়ে এত ভালো কচুরশাক রান্না তুমি শিখলে কবে গো?
-- কেন আমার রান্নাবান্নায় তোর আজকাল অরুচি ধরেছে নাকি?
-- আরে না, না। তা নয়। আসলে কচু, লতিতে তোমার খুব ভক্তি কিনা!
-- ওটা ওপরের থেকে এসেছে। বগাদা নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে বলল।
-- তাহলে বোঝো, লক্ষ্মীও তোমার চেয়ে কত ভালো রাঁধে!
-- না, না। এটা ওসব লক্ষ্মীফক্ষ্মীর কাজ নয়। বৌদি রেঁধেছে।
-- তুমি কী করে জানলে ?
-- ওই সকালবেলা ওপরে গিয়েছিলাম। তুই যে সেন্টটা বৌদিকে দিতে বলে গেছিলি, সেটা নিয়ে। গিয়ে দেখলাম বৌদিই রান্না করছে৷
গিরীশের মনে পড়ল, দিন চারেক আগে এক ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ একটা লেডিজ পারফিউম গিফট করেছিল। লাভেণ্ডারের গন্ধ। নমিতার এই গন্ধটা খুব প্রিয় ছিল। ওদের বিয়ের তত্ত্ব কেনাকাটার সময় নমিতা পাউডার, পারফিউম, সাবান -- সব ক’টাই কিনেছিল লাভেণ্ডারের গন্ধের। আজকাল ওষুধ কোম্পানিগুলোও হয়েছে সেইরকম। এদের স্ট্র্যাটেজিই হল ডাক্তারের বদলে তার পরিবারকে খুশি করো। বউএর জন্য কাপ-ডিশ দাও। কুকিং এপ্লায়েন্সেস দাও। বাচ্চাদের খেলনা দাও। দোলের সময় রঙ-পিচকারি দাও। পরিবার খুশ তো ডাক্তারও খুশ। যেন এরা খুশি থাকলেই ডাক্তার মনের আনন্দে ওই কোম্পানির ওষুধগুলোই কেবল লিখবে। হঠাৎ একটু সিরিয়াস গলায় গিরীশ বলল, কিন্তু আজ রোববারে চিংড়ি কেন? তুই আজ উপরের জন্য বাজার করে দিসনি?
-- করে দিয়েছি তো! তবে বৌদি আজ কয়েক মাস যাবৎ মাংস খাচ্ছে না।
-- কেন ?
-- আজকাল নাকি আর ভালো লাগে না। তাছাড়া কিছুদিন নাকি অর্শের সমস্যাটা আবার বেড়েছে।
-- কই, এতদিন আমায় কিছু বলোনি তো?
-- জানতে চাইলেই বলতাম।
গিরীশ এই বাঁকা কথার পাশ দিয়েই গেলেন না। বরং চিন্তান্বিত হয়ে বললেন, ‘তা মাছটাছ ঠিক মত খায় তো? ওটা কিন্তু নিয়ম করে এনে দিও। দুধ সহ্য হয় না৷ মাছ, মাংস সব বন্ধ হয়ে গেলে বাতে ধরবে যে!’
-- বাতও তো ধরেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে ক’দিন, দেখতে পাস না?
চুপ করে রইল গিরীশ। সত্যি তো, নমিতাকে অনেকদিন চোখেই দেখেনি সে। হাতমুখ ধুয়ে এবার সে একটা সিগারেট ধরাল। বগাকে বিশটা টাকা দিয়ে বলল, খাওয়াদাওয়া হলে চারটে পান নিয়ে এসো। বৌদির খয়ের ছাড়া মিঠাপাতা আলাদা কাগজে মুড়ে এনো। গতবারের মত আমার জর্দা দেওয়া পানটা ভুল করে খাইও না যেন !
২
পানটা মুখে পুরে খাটে খানেকক্ষণ অলস ভাবে সুয়ে রইলেন নমিতা। মাথার চুলে দু-একটা রুপোলি রেখা উঁকি দিলেও চামড়া এখনো টানটান। হাতে একটা পত্রিকা উল্টাতে উল্টাতে আওয়াজ পেলেন, লক্ষ্মীর বাসন মাজা শেষ হল। এইরে! এইবার তেতো মত কী একটা গুলি গেলাতে আসবে সে৷ বলে নাকি এটা খেলে খাবার সব হজম হয়ে যাবে, গ্যাস-অম্বলও নাকি আর হবে না। নিজে ডাক্তার হলেও তাঁর চিকিৎসার ভারটা লক্ষ্মীই জোর করে নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। নানান টোটকা-টুটকি জানা আছে তার। নমিতা বাধা দেন না। লক্ষ্মীকে দেখতে পেয়ে বললেন, হ্যাঁ রে, তেতোটা গেলাবার পরে পানটা দিতে পারতিস না? দিলি তো পানের বারোটা বাজিয়ে !
-- ও ঠিক আছে। আমার পানটা খেয়ো গিয়ে না হয়।
-- কেন, তুই খাবি না?
-- না গো। আমার দাঁতের গোড়াটা কাল থেকেই ফুলেছে।
-- কোনও ওষুধ খাসনি?
-- সকাল থেকে পেয়ারা পাতা চিবুচ্ছি তো!
-- ওতে হবে, নাকি একটা ওষুধ দেব?
-- ও তুমি চিন্তা কোরো না বৌদি। ব্যথা না কমলে আমি নীচে গিয়ে দাদার থেকে ওষুধ নিয়ে আসবো।
-- কেন, আমার ওষুধে বুঝি তোর ভরসা নেই ?
-- তুমি তো মেয়েছেলেদের ডাক্তার ! তোমার থেকে দাঁতের ওষুধ নেব কেন?
-- তোদের দাদা বুঝি দাঁতের ডাক্তার?
-- না গো বৌদি, অতশত জানিনে। তবে আমাদের গাঁয়ের সব লোকেরা বলাবলি করে গিরীশ ডাক্তার সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। সব রোগেরই ওষুধ জানে সে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নমিতা। সব বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ডাক্তারিতে সত্যিকারের চৌখস ছিল গিরীশ। বিশেষ করে সার্জারিতে। ইন্টার্নশিপ করার সময়েই সিনিয়র ডাক্তারদের পটিয়েপাটিয়ে পেট খুলে ফেলতে পারত সে। বন্ধুরা বলত সপ্তপদীর কৃষ্ণেন্দু। এমন স্কলার ছেলে, অথচ কোনও ভাবেই এম.ডি, এম.এস এর পরীক্ষায় বসানো গেল না তাকে। বললেই বলত, কেন, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করলে কি ডাক্তারের আলাদা দুটো হাত-পা গজায় ? ভীষণ গোঁয়ার-গোবিন্দ! অজান্তেই ভ্রূ কুঁচকে গেল নমিতার।
-- বৌদি, তোমার ফোন। লক্ষ্মী বলল।
-- কোত্থেকে ?
-- হাসপাতালের। গৌরী সিস্টারের গলা মনে হল।
-- কী বলল, যেতে হবে?
-- হ্যাঁ, খুব জরুরি।
নমিতা হাসপাতালের কাছেই থাকেন বলে বাইরের ডাক্তারেরা রবিবারের “অন কল” ওঁর ঘাড়ে ফেলে দিয়ে যে যার বাড়ি চলে যান। নমিতাও আপত্তি করেন না। তাঁর কাছে রবিবার যা, সোমবারও তাই। প্রাইভেট প্রাকটিশ তিনি ছেড়ে দিয়েছেন প্রায় বছর পনেরো। মহিলা গাইনোকোলজিস্টের চাহিদা এই দেশে সব সময়েই। তবু আজকাল এই পেশা তাঁকে আর টানে না৷ অথচ একসময় তাঁরও কত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। বিয়ের পর চাকরি সামলে, রাত জেগে পড়াশুনো করে তিনি এম.ডি তে চান্স পেয়েছেন, পাশও করেছেন৷ গিরীশ তখন চাকরি করতেন আসানসোলের কাছে, এক কলিয়ারিতে। নমিতার পোষ্টিং ছিল অনেক দূরে। কোচবিহারের এক মফস্বল হাসপাতালে। মাসে হয়তো একদিন দেখা হত তখন৷ কলকাতায় এম.ডি পড়তে এসে যদিও কিছুটা সময় পেয়েছিল তাঁদের দাম্পত্য। সপ্তাহে দু-তিনবার আসানসোলে আসতেন নমিতা। গিরীশের সেখানে মস্ত একটা কোয়ার্টার ছিল। অবশ্য এত পেশেন্ট আর নাইটকল অ্যাটেণ্ড করতে হত তাঁকে যে দু'দণ্ড কথা বলার ফুরসত হত না কোনও কোনও বার।
দ্রুত শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে আনমনে নমিতার চোখ গেল টেবিলে রাখা পারফিউমটার দিকে। ল্যাভেণ্ডার! আঁচলের ফাঁকে আলতো করে একটু স্প্রে করলেন তিনি৷ চেনা গন্ধ। আগের মত কি? কী জানি!
হাসপাতাল স্কুটিতে মিনিট তিনেকের পথ৷ তাঁকে দেখেই গৌরী সিস্টার দৌড়ে এলেন। ম্যাডাম পেশেন্ট ও. টি তে আছে৷
-- কী হয়েছে ?
-- মিসক্যারেজ। ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে।
-- কোন পেশেন্ট?
-- ওই যে মেয়েটি আপনাকে দেখায়। সেবন্তী চট্টরাজ।
-- আবার মিসক্যারেজ হয়েছে? এবার নিয়ে বোধহয় চারবার হল। একটু বিষণ্ণ দেখাল তাঁকে। বললেন, আ্যানাস্থেসিস্টকে খবর দেওয়া হয়েছে ?
-- উনি ছুটিতে আছেন। তবে ডাক্তার ঘোষ ইমার্জেন্সিতে ছিলেন। উনি বললেন ও. টি করতে হবে। দরকার হলে ওঁকে ডাকতে।
নমিতা দ্রুত ও. টি তে গিয়ে পোষাক বদলে নিলেন। মিনিট পনেরোর কাজ। তবু এসব আর একটুও ভালো লাগে না তাঁর। বড় ক্লান্ত লাগে। মেয়েটি একটি কলসেন্টারে কাজ করে৷ স্বামী বেসরকারি চাকুরে। ভালো রোজগার। নমিতা বহুবার বলেছেন প্রেগনেন্সি এলেই বিশ্রামে থাকতে। এই সময় বেশি পরিশ্রম, রাত জাগা ঠিক নয়। কিন্তু সবাই কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। দ্রুত প্রেসক্রিপশন লিখে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। দেখলেন, মেয়েটির স্বামী উদভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে। তাঁরই জন্য অপেক্ষা করছে৷ ‘’- এই যে মিস্টার চট্টরাজ, পেশেন্ট ঠিক আছে৷ ওষুধপত্র সব লিখে দিয়েছি, কয়েকদিন একটু রেস্ট নিতে বলবেন।‘’
-- কিন্তু ও তো বেশি দিন ছুটি পাবে না।
-- মানে, শরীরের থেকেও কি চাকরিটা বেশি জরুরি?
-- সেটা তো আমিও বলি। কিন্তু শুনলে তো!
-- শুনুন, এবার যখন প্ল্যান করবেন, ইউরিন পজিটিভ হলেই হাসপাতালে এনে ভর্তি করে দেবেন। ন'মাস এখানেই রাখব। দেখি কী করে এবার নষ্ট হয়! যেন অচেনা কোনও শত্রুর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন তিনি৷
-- ম্যাডাম, সেবন্তীর চাকরি করার কোনও দরকারই নেই। তবু আজকাল নারী স্বাধীনতা-ফাধীনতার ব্যাপার আছে কিনা! বেশি বলতে গেলে অশান্তি। বেশ ক্লিষ্ট শোনাল ভদ্রলোকের গলা।
-- শুনুন, আজ বয়স আছে, উনি বুঝছেন না। যখন বুঝবেন, তখন কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাবে। গলায় উষ্মা ছড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন নমিতা। মাথাটা বেশ ধরে গেছে বহুক্ষণ। ঘরে ঢুকেই লক্ষ্মীকে বললেন, দ্যাখ তো দাদার ফ্রিজে সোডা আছে কি না?
-- কেন, এখন আবার ওসব ছাইপাঁশ গিলতে বসবে বুঝি ?
-- বড্ড মাথা ধরেছে রে!
-- তা মাথা ধরেছে তো একটু চা করে দিই না! চা খেয়ে বরং একটু শুয়ে পড়ো, আমি মাথায় অমৃতাঞ্জন মালিশ করে দিই।
-- তুই বরং নীচে দ্যাখ গে দাদা চা খাবে কি না। বগাদা আজ বিকেলে কোথায় যাবে বলছিল। জলদি জলদি যা, সোডাটা নিয়ে আয়।
লক্ষ্মী গজগজ করতে করতে নীচে গেল। দেখল দাদা ঘুমোচ্ছে। ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে ভাবতে ফ্রিজ খুলে সোডা নিল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে, এমন সময় দাদা ডাকল, কী রে লক্ষ্মী, কী ব্যাপার?
-- বৌদি একটু সোডা চাইল।
-- তা আমাকেও একটু দিয়ে যা।
-- কেন, তোমারও মাথা ধরেছে নাকি?
-- তাতে তোর কী দরকার? ধমকে উঠলেন গিরীশ। নে, একটা গ্লাস আর বরফ বের করে রেখে যা এখানে। আর শোন, উপরে গিয়ে কিছু বলিস না যেন!
-- জিগ্যেস করলে কী বলব?
-- বলবি, জানি না।
-- তোমার জন্য মিছে কথা বলব কেন?
-- “জানি না” আবার মিছে কথা হল কবে? তুই জানিস আমি সোডা দিয়ে কী করব?
-- সে আবার জানি না !
-- যা, বেরো এখান থেকে। তোর যা ইচ্ছা হয়, বল গিয়ে। বলেই হুইস্কির বোতলটা কাবার্ড থেকে বের করে আনলেন গিরীশ। ওঁর এক বন্ধু লন্ডনে থাকেন৷ মাস খানেক আগে এখানে বেড়াতে এসে দিয়ে গেছেন ক্রেট খানেক। ব্গাদাকে দিয়ে খান কয়েক বোতল তখনই উপরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নমিতা নিশ্চয়ই সেগুলো দিয়েই চালাচ্ছে। কে জানে! হাঙ্কা করে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দিলেন গিরীশ।
৩
মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেল বগার। ওঘরে যেন কেমন একটা ছটফটানির শব্দ। আলোটা জ্বালিয়ে সে দেখল, খাটের ওপর কেমন যেন আছাড় খেয়ে খেয়ে পড়ছেন গিরীশ। মাঝে মাঝে পেটে বালিশ চাপা দিয়ে স্থির হয়ে বসছেন কিছুক্ষণ।
-- কী রে বুড়ো, কী হয়েছে ?
-- পেটটা বড় ব্যথা করছে বগাদা।
-- ওষুধ খেয়েছিস ?
-- খেলাম কয়েকটা। তবে তাতে কমছে না৷ মনে হচ্ছে ইঞ্জেকশন লাগবে। তুমি বরং একবার ডাক্তার সরকারকে কল দাও।
-- তার চেয়ে একবার বৌদিকে ডাকি না ?
-না, না। ও ঘুমোক। তুমি ডাক্তার সরকারকে ফোন কর।
মিনিট পাঁচেক চেষ্টা করল বগা। রিং হচ্ছে, কেউ তুলছে না। অধীর হয়ে বলল, কেউ তুলছে না যে, নেই নাকি ?
-- তাহলে একবার ডাক্তার চৌধুরীকে দেখো।
বগা আর কালক্ষেপ না করে উপরে চলল নমিতাকে ডাকতে।
-- বৌদি। ও বৌদি ! লক্ষ্মী, ও লক্ষ্মী !
-- কী হয়েছে বগাদা? নমিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
-- এই দ্যাখো না, বুড়ো কেমন পেটের ব্যথায় ছটফট করছে৷
-- ওষুধপত্র খেয়েছে কিছু?
-- বলছে তো খেয়েছে। সরকার ডাক্তারকে ফোন করতে বলল। তা করলাম, কিন্তু কেউ ধরল না।
-- আচ্ছা চল তো দেখি। নীচে এসে নমিতা দেখলেন, চারদিকে বমি। খাটের ঠিক মাঝখানটায় গিরীশ বসে। মাঝে মাঝেই কাতরাচ্ছেন। বললেন, অনেক দিনই তো পেটে ব্যথা শুনি, আল্ট্রা-সোনোগ্রাফি করেছ?
-- না৷
-- না কেন?
-- প্রয়োজন মনে করিনি তাই!
-- আবার ঘাড় ত্যাড়ামি? এরপরও বসে বসে মদ গেলো, লজ্জা করে না?
-- সে তো তুমিও সাঁটো। তোমায় আমি বলি কিছু?
-- কোন মুখে বলবে শুনি? তার জন্যে কি তোমায় জ্বালিয়েছি কোনওদিন, নাকি পেট ব্যথায় কুঁই কুঁই করেছি?
-- ওহ, আমি তোমায় জ্বালাচ্ছি? ঠিক ঠিক। সুখনিদ্রা ভাঙাতে হল তোমার! বগাদা যাও, ডাক্তার দিদিমণিকে ওপরে দিয়ে এসো। কত ফিস্, জিগ্যেস করে দিয়ে দাও।
-- বলি, আমি বিদায় নিলে এই রাত্রে তোমায় দেখবে কে ? বগাদা? কল তো দিয়েছিলে ডাক্তারকে! এসেছে?
-- মরে যাই, কষ্ট পাই তাও ভালো। তোমার হাতে ট্রিটমেন্ট নেবো না আমি।
-- আদা পচলে ঝাঁজ যায় না দেখছি!
-- শোনো নমি, আমার এখন আর ঝগড়া করার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। তুমি দয়া করে ওপরে যাও। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে৷
নমিতা নিজের ব্যবহারে লজ্জা পেলেন। অনেক দিন পরে গিরীশের মুখে নিজের নামটা শুনে কেমন যেন শূন্যতা গ্রাস করতে লাগল তাঁকে। নিজেকে স্থির করে শান্ত গলায় বললেন, তোমার কাছে ইঞ্জেকশন আছে, নাকি ওপর থেকে আনাবো?
-- তোমার হাতে ইঞ্জেকশন নেবো না আমি। মিউমিউ করে উঠলেন গিরীশ।
-- লক্ষ্মী, যা তো, ওপর থেকে আমার ওষুধের বাক্সটা নিয়ে আয়।
ব্যথা আর ঘুমের ইঞ্জেকশন রেডি করে নমিতা এসে দাঁড়ালেন গিরীশের খাটের পাশে। তাঁকে দেখেই ছেলেমানুষের মত খাটের এপাশ থেকে ওপাশে নাগালের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন গিরীশ।
-- বগাদা, তুমি শক্ত করে পা দুটো ধরো, লক্ষ্মী তুই হাত দুটো চেপে ধর দেখি!
মৃদু প্রতিরোধ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এল। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন গিরীশ। নমিতা দেখলেন, সেই একই রকম ছেলেমানুষ, গোঁয়ার অথচ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার যুবক শুয়ে আছে খাটে। শুধু ঝাঁকড়া চুল তার কোনও স্মৃতি রাখেনি আশেপাশে। এই ফ্রেমটুকু ধরে রাখার মত কোনও ওষুধ যদি জানা থাকত তাঁর!
🍂
0 Comments