দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
এখনও মনে আছে, সে রাতে ঘুম হয়নি বিরজার। এই সামান্য জীবনে শোকে উৎকন্ঠায়, আবার কখনও বা ভালোবাসায়ও আরও অনেক রাত জেগেছেন তার আগে বা পরে, কিন্তু সে রাতের রোমাঞ্চ আজও এক অপূর্ব মোহময়তা জাগায় তাঁর মনে।ঐ যে আছে না গানের কথায়, “পাওয়ার আগে কিসের আভাস পাই…” অনেকটা ঠিক সেই রকমই।
আজন্ম লালিত এক স্বপ্নের বাস্তবতা পাওয়ার হঠাৎ এসে যাওয়া সম্ভাবনা; সে স্বপ্ন সত্যি হবে কি না জেনেও আধোঘুম- আধো জাগরণে ভেসে ভেসে বেড়িয়েছিলো সে কালবৈশাখীর মেঘের মতো কালো কালো পাহাড়ের পরে পাহাড়ের তলে, নববর্ষার জল ঘরের চাল গড়িয়ে ছাঁচতলায় পড়ার মতো ঝরোঝরো ঝর্ণার কোলে,সেই কবে ভুলে যাওয়া শউরবাড়ি যাওয়ার পথে দেখা বনের চাইতেও ঘন গভীর বনের পারে…
বাংলাদেশের এক অতি সাধারণ বাড়ির বিধবা তরুণীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তীর্থযাত্রা খুব একটা সহজ কাজ ছিলনা সেকালে। আর্থিক সমস্যার চাইতেও বড়ো সমস্যা ছিল পারিবারিক দায়বদ্ধতার। বাড়ি ভর্তি একগুচ্ছ কচি কাঁচা,মাথার ওপরে জ্যাঠামশায়-জ্যাঠাইমা নেই,বড়োদাদা সংসারের প্রয়োজনে আরও অর্থ সংস্কারের চেষ্টায় বাড়ি আসা কমিয়েছে…এই অবস্হায় তাঁর ও মেজদাদার ওপরে সংসারের দায়িত্ব বেশি;দূরদেশ যাওয়া তো আর মুখের কথা নয়, অনেক দিনের ব্যাপার।তবু তিনি ছিলেন আশাবাদী।কারণ,বৌদিদি।
আশেপাশের আর পাঁচটি বিধবা মেয়েদের বাপের সংসারে ফিরে আসার পরে যে দুরাবস্থার কথা শুনতেন, এবং কখনও কখনও দেখতেনও বিরাজ, তার কণামাত্র তাঁকে ভোগ করতে হয়নি,জ্যাঠামশাই-জ্যাঠাইমা চলে যাওয়ার পরেও। বাড়ির কারণ, ঐ ছোটখাটো চেহারার মানুষটি।
হ্যাঁ।জ্যাঠাইমার মতো উজ্জ্বল চেহারা তার ছিলনা,সাজগোজও খুব কম, গয়নাগাটি থাকলেও পরতো বলে মনে হোত না,সংসারের কোন বিষয়েই খুব বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করতো না কখনও।তবু এক প্রচ্ছন্ন আভিজাত্য তাকে ঘিরে থাকতো,সবাইকে ভালোবাসার,সবাইকে সম্মান দেওয়ার মতো কিছু।তাই তার কথা কেউ ফেলতেই পারতো না।
আর, বিরজার সারাজীবনের বড়ো ভরসা ছিল বৌদিদিই। বৌদিদি বলেছিল বলেই ও আশায় ছিল, হয়তো শিকে ছিঁড়বে। তা নাহলে...
আসলে এখন বুঝতে পারেন, সুযোগ পেয়েই ভগ্নীসমা ননদিনীকে খানিক সুখের খোঁজ দিতে চেয়েছিলেন, মাকে দেখেশুনে তীর্থ করিয়ে নিয়ে আসার চাইতে যে শুভকামনা ছিল অনেকটাই বেশি।
যাহোক,সন্ধ্যেয় কথা আরও খানিক এগিয়েছিল, চা খেতে খেতে দাদা তাঁর মা আর বোনকে বলেছিলেন,
-’ যেতে চাইলে কয়েকদিনের মধ্যেই কিন্তু বেরিয়ে পড়তে হবে। বৈশাখ মাস পড়ে গিয়েছে,অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চারধামের দরজা খোলা হয়।’
একটু দূরে বসে বিরজা সেসব কথা শুনছিলেন। কোনদিনই পেলব নারীসুলভ সলজ্জ ভাব তাঁর তেমন নেই, তায় যে মানুষটির সঙ্গে এতোদূর যাওয়ার কথা হচ্ছে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করাই যায় মনের কথা, সেই ভেবে বলে উঠলেন,
-’দরজা খোলা হয় মানে দাদা! ঠাকুর তাহলে নিত্য পূজা পান কি করে!’
দাদা তখন খোলসা করলেন,
-’আসলে ওসব জায়গা তো বছরের অর্ধেক সময় বরফে ঢাকা থাকে। তাই অক্ষয় তৃতীয়া থেকে মোটামুটি দীপাবলী পর্যন্ত মন্দিরে বিগ্রহ থাকেন, ভক্ত সমাগম হয়। মাঝের সময়টুকু ডুলি বা পালকি চেপে নীচের নির্দিষ্ট মন্দিরে তিনি স্থানান্তরিত হন।’
-’অদ্ভুত কথা তো দাদা! এমনও হয়!‘
-’হয় বোন। এতো বড়ো দেশ আমাদের। কতো কি দেখার, কতো কি শেখার আছে!আমরা সাধারণ মানুষ শুধু আপন সংসার আর তার টানাপোড়েনে আটকে না থেকে যদি… ‘
মুখ খুললেন মা। উদাস গলায় বললেন,
-’যখন প্রথম হারিয়ে গেলি, কতো কেঁদেছি, কতো থানা পুলিশ করেছেন তোর বাবা। শেষ অবধি বড়ো ছেলের হাতের জলটুকু না পেয়েই তো…
কান্না উথলে উঠলো বৃদ্ধার চোখে। ছেলে তাঁকে আগলে ধরে বললে,
-’কি করতাম মা! ঘরে যে মন টেকেনি আমার!’
মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলেন মা,
-’জানি বাবা। সবাই কি আর একরকম হয়!’
তারপরেই কথা ঘুরিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,
-’হ্যাঁ রে সুরো!বিরজাকে যেতে দেবে তো জামাই?ও সঙ্গে গেলে আমার যাওয়া হয়।একবার দেখতে চাই সেসব জায়গা,যার টানে আমাদের ছেড়ে গিয়েছিল তোর দাদা!তাঁর কপালে তো হলো না,বড়ো সখ আছে এখনও আমার!’
🍂
-’হ্যাঁ মা। আমি তাঁকে রাজি করাবোই। ঠাকুরঝি গেলে তোমারও যাওয়া হবে, আমিও নিশ্চিন্তে তোমায় ছাড়তে পারি।’
পরের সকালে দাদা টেলিগ্রাম করলেন কলকাতায়, আবার তিনিই নিয়ে এলেন তাঁদের দুজনকে দেশের বাড়িতে।
এসে যথারীতি গন্ডগোল;মেজদাদা এবং বৌদিদি তীব্র আপত্তি জানালে, …গ্রামদেশে নাকি এমন কমবয়সী মেয়েদের এভাবে যাওয়ার চল নেই,তাও আবার নিজের বাপ-ভাই ছাড়া! লোকে কটু কথা বলবে, ও না থাকলে সংসারে সমস্যা;ইত্যাদি ইত্যাদি…
যদিও ধোপে টেকেনি সেসব।
অচল, স্হির সিদ্ধান্তে বড়ো বৌদিদি পরের সকালে বাক্স গুছিয়ে তাঁকে ফের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দাদার সঙ্গে, সঙ্গে একটি চিঠি, কলকাতার পৌঁছে যেন দাদাকে দেয়।
এখনও মনে আছে, গরুর গাড়ির যাত্রাপথে দুই একটি মামুলি কথাবার্তা হয়েছিল দাদার সঙ্গে। তার মধ্যেই তিনি জানিয়েছিলেন, দেবদ্বিজে তাঁর ভক্তি তেমন নেই, কিন্তু ভালোবাসেন প্রকৃতি। ছোটবেলায় পাড়ার এক জামাইবাবুর কাছে শুনেছিলেন পন্ডিচেরীর কথা;পাহাড়-সমুদ্র-নদী… আর তার টানেই ছেড়েছিলেন ঘর, ফেরার ইচ্ছেও ছিল না,টান প্রায় কাটিয়ে ফেলেছিলেন।তবু এক সন্ধ্যেয় হর কি পৌড়ীর ঘাটে এক পুত্রহারা মায়ের বিলাপ তাঁকে ফিরিয়ে দেয় ঘরে, কিছু পিছুটান তো রয়েই যায়, অস্বীকৃত কিন্তু অমোঘ হয়েই…
তবে ফিরে এসে দেখলেন, ঘর তাঁর জন্য নয়;তাঁকে ছাড়াও সব চলছে ঠিকঠাকই। তাই তো আবার ফিরছেন পথে, তবে এবার নতুন সংযোজন; সঙ্গে মা আর বোন।
কথাগুলি বলতে বলতে স্মিতহাস্যে তাকিয়েছিলেন বিরজার দিকে, বিরজার মনে পড়ছিল, বৌদিদির যখন বিবাহ হয়, এই দাদা তখন তরুণ যুবক। আর সে নিতান্ত বালিকা। আর আজ সে প্রায় ত্রিশের তরুণী, দাদা প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়। দুজনের জীবনের গতি, উদ্দেশ্য পৃথক, তবু অভিলাষের গন্তব্য এক…
যাহোক, সেদিন আবার বৌদিদির বাবার বাড়িতে পৌঁছে পিসিমার সব জিনিসপত্র গুছোতে গুছোতে প্রায় রাত কাবার হয়ে যায়… কি ছিল না বুড়ির তল্পিতে! পানদোক্তা, কালমেঘ-চিরতার বড়ি-জপের মালা থেকে শুরু করে কলসী-থালা-বাটি, মায় গীতাটি পর্যন্ত গুছিয়ে ভোরের সূর্যকে সাক্ষী রেখে একটি পূর্ণবয়স্কা তরুণী বিধবা এক সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা ও তাঁর প্রৌঢ় সন্তানের সঙ্গে চললেন গরুর গাড়িতে।
স্মৃতির পাশ ফিরে শুয়ে শুয়ে আজকের বৃদ্ধা ভাবলেন, এখনকার দিনে যাতায়াতের কি সুবিধা! নতুন বৌমার মুখে শুনছিলেন, এখন নাকি ট্রেনগুলো সব চলে ইলেকট্রিকে;ট্রেনের ভেতরেও ঠান্ডা মেসিন, যা খুশি খাওয়ার ব্যবস্থা…
অথচ সেদিন! ভোরবেলায় বেরিয়ে বাকসীর হাটে যখন পৌঁছলেন, সুয্যিঠাকুর মধ্যগগনে… তারও পরে কোলাঘাটে পৌঁছনো নৌকা বেয়ে;সেখান থেকে ট্রেনে চেপে হাওড়া ইষ্টিশান।
পথে যেতে যেতে দেখা নতুন তৈরি হওয়া পাঁশকুড়া রেল ইষ্টিশান, ঘাটাল-পাঁশকুড়ার পীচ রাস্তা তৈরিতে কাজ করা অনেক অনেক মজুরজন;শান্ত নিরিবিলি পথে মাঝেমধ্যেই তাদের কলরব, ব্যস্ততা… তখন তো বিরজার পড়া হয়ে গিয়েছে ‘পথের পাঁচালী’;বয়সও অপু-দুগ্গাকে ছাপিয়ে অনেক দূর…
তবু প্রথম পীচের তৈরি রাস্তা দেখা, নদীর ওপরে বানানো লোহার ব্রীজ, রেলগাড়ির গতিময়তার রোমান্টিসিজম তাকে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়েছিল. .. পরের জীবনে সারা ভারত ভ্রমনের উন্মাদনার কাছেও যা চির অম্লান। (ক্রমশঃ… )
0 Comments