জ্বলদর্চি

বাংলাদেশ ভ্রমণ /পর্ব ৩/রোশেনারা খান

সি বিচে আলাপ হওয়া দুই মা।

বাংলাদেশ ভ্রমণ
পর্ব ৩
রোশেনারা খান



কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা বিচে পৌঁছে গেলাম। সামনেই একটা উঁচু মঞ্চ রয়েছে। ওর ওপর দাঁড়িয়ে সামনেটা ভাল করে দেখার চেষ্টা করলাম। অনেক দূরে জলের কাছাকাছি লাইন ধরে কিনারা বরাবর বড় বড় ছাতা দাড়িয়ে আছে।                                                                                                                                            কাছে গিয়ে আধো অন্ধকারে দেখলাম ছাতার নিচে বেডপাতা আছে, অনেকে সেখানে শুয়ে, বসে, সমুদ্রের বাতাস খাচ্ছেন, হয়ত বা ঢেউ গুনছেন। এদের  মধ্যে কপোত কপোতীর সংখ্যাই বেশি। এগুলো আগে থেকে বুক করতে হয়। আমরাও কিছুক্ষণ এখানে ঘোরা ঘুরি করে (বাতাস খেয়ে) মেয়েলি স্বভাব মতই মঞ্চের  কাছে ফিরে এলাম।কারণ মঞ্চের নিচে একপাশে নানারকম জিনিসের স্টল রয়েছে।  চুড়ি, ক্লিপ, পুতিরমালা, ঝিনুকেরমালা,সো-পিস কানের দুল, পার্স, ব্যাগ, নানারকম আচার, পাওয়া যাচ্ছে। টুকিটাকি জিনিসও কিনলাম। সাকিল এক জায়গায় বসে প্লেটে করে ফুচকা খাচ্ছিলেন।আমিও বসলাম, খেলামও, এদের ফুচকাগুলো অন্যকিছু মিশিয়ে বানানো। একটু শক্ত ধরণের। ভিতরের পুরটা ভালই। দুটোমাত্র খেলাম, আমি কোনদিনিই এসব খেতে পছন্দ করি  না।  

     কিছু পরেই বাকি সবাই দলবল নিয়ে হাজির হল, নিমেষে ফুচকার প্লেট খালি।ওরা অবার অর্ডার দিল, আমি আর খেলাম না। হোটেলে ফিরলাম। রাতেও একই খাবার, চিনিগুঁড়া(বাদশাভোগ) চালের ভাত আর চিকেন। এখানে রুমে এসি  নেই, তবে বাতাস খুব ঠাণ্ডা। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। একেবারে ভোরে ঘুম ভাঙ্গল।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সাহদাতদা আর গৌতমবাবু বললেন, ম্যাডাম   চলুন হাঁটতে হাঁটতে সি বিচ ঘুরে আসি। আমরা চারজন(সাহাদাতদার স্ত্রী সেরিনা ও) বেরিয়ে পড়লাম।মেন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাচ্ছি চারিদিক সবুজ,  কত শাকসবজি ফলে রয়েছে।এক জায়গায় খাটো সাইজের ঢ্যাঁড়শ গাছে প্রচুর ঢ্যাঁড়শ ফলেছে বলে মনে হচ্ছে। ঘন পাতার আড়ালে সব দেখা যাচ্ছে না।তবে একজন ঢ্যাঁড়শ তুলছিলেন, তাঁর উপচে পড়া ঝুড়ি দেখেই মনে হল। আমরা যে রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম তার উল্টোদিকে সমন্তরাল ভাবে দুজন মহিলাও গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছে। রাস্তার ধারে একটা চা-পরোটার দোকান দেখে  গৌতম বাবু বললেন, ফেরার সময় চা খাব।

       হেঁটেই চলেছি, আমরা কেউই জানি না যে বিচের সন্ধানে চলেছি সেটা আর কতদুরে। পথচলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করে মেন রোড ছেড়ে ডানদিকের মেঠো পথ ধরলাম। খোলা আকাশের নিচে গাছ গাছালির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একটি মুক্তমঞ্চ দেখতে পেলাম। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রের ধার মস্ত বড় বড় বস্তা দিয়ে ঘেরা রয়েছে। বস্তাগুলো লম্বায় ৩০/৩৫ ফিট হবে, আরও বেশিও হতে পারে। চওড়া ২০/২৫ ফিট হবে। এগুলোতে নিশ্চয় বালি ভরা আছে।কাছ গিয়ে মনে হল এগুলো তাঁবুর কাপড়ে তৈরি। হাতির পিঠের মত দেখাচছে। বাঁধ দেওয়ার বা সমুদ্রের ঢেউ আটকানোর এমন অভিনব পদ্ধতি  আমাদের দেশে দেখিনি। আমাদের ওখানে ছোট ছোট বস্তায় বালি বা ইট-পাথর ভরে তা দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়। সেগুলো কয়েক মাসের মধ্যেই বালির বাঁধের মত ভেঙ্গে ধুয়ে যায়। ভাঙ্গন আটকানো এত সহজ নয়।অনবরত সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাতে পাথরও খয়ে যায়।ইংল্যান্ডে আটলান্টিকের বুকে ডারডেল আর্চটি জলের ঝাপটাতে তৈরি হয়েছে।            
🍂
       এখানে মানুষজন খুব কম চোখে পড়ছে।পথে দেখা সেই মেয়েদুটিও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।আলাপ করে জানলাম ওরা স্বামীর কর্মসূত্রে এখানে বাস করে। এখন বাচ্চাদের স্কুলে ছেড়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে। নানা বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা হল ওদের সাথে। ওরা আগেই ফিরে গেল। আমরাও হাঁটতে হাঁটতে সেই চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।আমাকে আর সেরিনাকে ভিতরে বসতে দিল। গরম গরম পরোটা ভাজতে দেখে  খিদে পাচ্ছে মনে হল। আমি পরটা দিয়ে চা খেলাম।আমার সঙ্গিরাও চা খেলেন।  

      আমরা আবার হাঁটা দিলাম।হোটেলে ফিরে শুনলাম এখন টোটোতে করে  দূরের একটা বিচে যাওয়া হবে। সাড়ি বদলে শালোয়ার কুর্তি পরলাম। ছাতা, জলের বোতল আর সানগ্লাস নিলাম। রোদ থাকলেও বাতাস কিন্তু গরম নয়। বেশ উপভোগ্য। রাস্তার ধারে বাড়িঘর থাকলেও সবুজ রং বেশি চোখে পড়ছে।কতগাছ! সবজি ক্ষেত, ইত্যাদি। অনেকটা পথ পার হয়ে দেখতে পেলাম জঙ্গলে ঢাকা মাটির পাহার। তারই মাঝে পায়েচলা বনপথ। এক জায়গায় দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে          ছোট ছোট অনেক গর্ত। আসলে ওগুলো পাখির বাসা। পাখিরা বাসায় ঢুকছে, বের হচ্ছে।
হিমছড়ি ঝর্ণা

      এখন বাম দিকে সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি। আরও কিছুটা এগিয়ে আমরা বিচের পাশে নামলাম। রাস্তার ধারে একই রকম রকমারি জিনিসের স্টল।আমি ছোট নাত্নির জন্য একটি রঙ্গিন জাপানি ছাতা কিনলাম।তারপর সবাই মিলে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম।জল অনেক দূরে। জলের ধারে রয়েছে বেশ কিছু সাম্পান। এরকম নৌকো আমাদের বাংলায় দেখিনি,দুর থেকে সাম্পানগুলিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো রূপকথার দেশে পৌঁছে গেছি।কিন্তু বাস্তবটা দেখলাম অন্য রকম, এটাও আগে দেখিনি।বেস কিছু যুবক চার চাকার বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে।২০০/ টাকার বিনিময়ে বাইকে বসিয়ে সি বিচ ঘুরিয়ে দেবে।এসব চড়াতে আমার কোনও উৎসাহ নেই।আমি ডাবের দোকান দেখে আগিয়ে গিয়ে দেখি  পেছনের দিকে সাহাদাতদা আর সেরিনা দাঁড়িয়ে আছেন।আমার সঙ্গে মায়াদিও  এলেন। আমি তো ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের মত সাম্পাঙ্গুলিকেই দেখতে থাকলাম। মায়াদির শরীর ভাল নেই, উনি টয়লেটের খোঁজে গেলেন।আমি আর সেরিনা ১৫০ টাকা পার পিস ৩০০ তাকা দিয়ে দুটি ডাব খেলাম, অনেকখানি জল ছিল।সেরিনা আর সাহাদাতদা নিজেদের মত আলাদা থাকতে পছন্দ করেন। সাকিল আমি আর অঙ্কনা রাস্তা ক্রস করে হিমছড়ি ঝর্ণার খোঁজে গিয়ে ৫০ টাকা করে টিকিট কেটে  কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে সাকিল আমাদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।এই বয়সে, এই ভারি শরীর নিয়ে ওপরে উঠে জানলাম, ঝর্ণা নিচেতে। তবে ওপর থেকে সমুদ্রটা দারুণ দেখচ্ছিল।

       আবার নিচে নেমে দেখলাম একটু আড়ালে, একেবারে সামনেই হিমছরি ঝর্ণা। আমরা উল্টো দিকে চলে গেছলাম। খুব একটা বেশি উচ্চতা থেকে জলটা  পড়ছে না। তবু ঝরনা তো ঝর্ণাই। ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে অনেকে স্নান করছে।এই ঝর্ণার কথা লিখতে গিয়ে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল।বর্ষার শুরুতে আমাদের খিড়কীপুকুরে অজস্র ঝর্ণা সৃষ্টি হত। এই ঝর্নাগুলকে আমরা  আঙ্গুলে করে মাটি সরিয়ে পুকুরের জল পর্যন্ত নালা করে দিতাম।এই ঝর্ণার মালিকানা নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়াও হত।

                        ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments