দূর দেশের রূপকথা—ডেনমার্ক (ইউরোপ)
রাজকুমারি ফিরে এলো
চিন্ময় দাশ
দু’জন ছেলেকে নিয়ে সংসার একজন চাষির। ছেলে দুটো সবে যুবক হয়েছে, একদিন চাষি মারা গেল। লোকটার থাকবার মধ্যে ছিল ভাঙাচোরা একটা কুঁড়েঘর। ছোট্ট একটা সবজি বাগান। একটা টেবিল, তিন-চারটা চেয়ার আর একটা পুরাণো বাক্স। এই যা।
বড়ছেলে বলল—এই সামান্য কটা জিনিষই তো বাবা রেখে গেছে সংসারে। এর আর দু’জনে ভাগাভাগি হবে কী করে? আমি বলি কী, আমি তো বড়। এগুলো আমারই থাক।
ছোট ছেলেটার নাম জেমস। সে আর কী বলবে। বলল—আমি আর কী বলব? তুমি যা ভালো মনে কর।
বড় বলল—দ্যাখ, ভাই। বাইরে দুনিয়াটা অনেক বড়। তুই বরং বেরিয়ে পড়। কোথাও নিশ্চয় একটা হিল্লে হয়ে যাবে তোর।
--দেখা যাক তাহলে। বেরিয়েই পড়ি। বলে, জেমস ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
কাঁধে একটা ঝোলা। রাস্তা হাঁটছে জেমস। হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে যখন সন্ধ্যা নেমে এল, জেমস তখন একটা পাহাড়ের তলায়। ঝোলা মাথায় দিয়ে মাটিতেই শুয়ে পড়ল। উপরে নীল আকাশ। কাঁচের মতো ঝকঝকে। তারারা ফুটতে শুরু করেছে একটা-দুটো করে। খানিক বাদে, ছায়াপথ ফুটে উঠল আকাশে।
জেমস দেখছে আর ভাবছে, আমি কোন পথে যাব? থিতু হতে পারব কোন পথে গেলে? কোথাও তো আমাকে বসতি গড়তে হবে। এত বড় দুনিয়ায় কোথায় লেখা আছে আমার ঠিকানা?
ভাবতে ভাবতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। খুব ইচ্ছা ছিল, বড় হয়ে একজন শিকারি হবে সে। সেই ভাবনাটা এখন আবার ফিরে এল। তখনই ভাবল, কিন্তু শিকারি হতে গেলে, সবার আগে তো, কিছু জিনিষপত্র চাই। সবার প্রথমে তো চাই একটা ঘোড়া। তারপর চাই একটা বন্দুক, আর একটা শিঙা। আপাতত এই হলেই কাজ চলে যাবে। কিন্তু পাওয়া যাবে কোথায়? এই ভাবতে ভাবতে, দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল।
কতক্ষণ বাদে একটা শব্দ। ঘুম ভেঙে গেল জেমসের। কেউ যেন খুব কাতরভাবে বলছে—একটু সাহায্য করো আমাকে। একটু সাহায্য করো আমাকে।
উঠে বসে, এদিক ওদিক তাকিয়েও, কাউকে চোখে পড়ল না।
তখন আবার সেই করুণ সুরটা শোনা গেল। এবার জেমস দেখল, ঠিক তার পায়ের কাছটাতে অদ্ভূত একটা জীব। একেবারেই একটা আঙুলের মতো ছোট্ট চেহারা। সরু লিকলিকে হাত-পা। তবে, সেসবের তুলনায় মাথাটা একটু বেশিই বড়। দেখতে বড্ড বেখাপ্পা। ছোট্ট একটা বামন।
বামন আবার বলে উঠল- একটু সাহায্য করো আমাকে।
জেমস জানতে চাইল—কী হয়েছে?
--এই পাহাড়েই থাকি আমি। পাহাড়ের উলটো দিকে আমার ঠাকুর্দা থাকে। তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এখন ফিরে এসে দেখি, একটা গরু রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। গরুটাকে একটু সরিয়ে দেবে? খুব উপকার হয় তাহলে।
--দাঁড়াও, আগে তোমাকে দেখি ভালো করে। জেমস বলল—এতো ছোট চেহারার কাউকে কখনও দেখিনি কি না।
--তা দ্যাখো। কিন্তু কাজটা তোমাকে তাড়াতাড়িই করতে হবে। সূর্য ওঠার আগেই। কেননা, গায়ে যদি রোদ লেগে যায় আমার, হয় মাকড়শার জাল, নয় তো রাতের শিশির হয়ে যাব আমি।
দেরি না করে বামন ছেলের সাথে রওণা হোল জেমস। পাহাড়ের ওদিকে গিয়ে, গরুটাকে সরিয়ে দিল।
অনেক ধন্যবাদ দিয়ে, বামন বলল—আগামীকাল ঠিক মাঝরাতে এসো এইখানে। যাতে তোমার উপকারের প্রতিদান দিতে পারি আমরা। এই বলে, ছোট্ট একটা গর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল চেহারাটা।
পরের দিন রাত হয়েছে। পাহাড়ের সেই জায়গায় এসে হাজির হয়েছে জেমস। হঠাৎই চারটা লাল রঙের থাম জেগে উঠল মাটি ফুঁড়ে। যেন একটা দরজা। সেই কাঠামোর ভিতরে দঁড়িয়ে আছে বামন ছেলেটা। বলল—ভিতরে এসো, বন্ধু! তোমার উপকারের কথা শুনে, বাবা খুব খুশি হয়েছেন। তোমার চাহিদা মতো, যে কোন তিনটা জিনিষ দেব আমরা তোমাকে।
জেমস ভেতরে যেতেই, লাল রঙের দরজা মিলিয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, অবাক হয়ে দেখে, পাহাড়ের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে জেমস।
ভিতরে এক অদ্ভূত দৃশ্য। হাজার হাজার বামন এদিকে ওদিকে। সবাই নানা রকম কাজে ব্যস্ত। কেউ তরোয়াল বানাচ্ছে। কেউ তাঁত বুনছে। মহামূল্য পাথর কাটছে কেউ কেউ। হীরে-মুক্তোর আলোর ঝলকানি ঘর জুড়ে।
--তুমি কোন কোন তিনটা জিনিষ চাইবে, ভেবে রেখেছ?
বামনের কথায়, জেমস বলল—হ্যাঁ। একটা বন্দুক, একটা ঘোড়া, আর একটা শিঙা।
--এই মাত্র? ঠিক আছে, চলো। যা তোমার মন চায়।
একটা বিশাল হলঘরে এনে হাজির করা হোল জেমসকে। একজন শিকারীর যা দরকার, সবই মজুদ আছে এখানে। বন্দুক যে কত রকমের তার ঠিক নাই। দামী-সস্তা, লম্বা-বেঁটে, সোনায় মোড়া-একেবারে সাধারণ—এইরকম সব।
চামড়ার ফিতে লাগানো, মরচে পড়া, একটা সেকেলে গাদা বন্দুক পড়ে ছিল। সেটাই বেছে নিল জেমস। বামন ছেলে অবাক হয়ে বলল—এটা নেবে!
জেমস জবাব দিল—ওসব মূল্যবান জিনিষ আমার জন্য নয়।
এবার তারা এল শিঙার ঘরে। সেখানেও একই অবস্থা। দু’ ধরণের সব জিনিষ। চোখ বুলাতে বুলাতে ঘরটার এক কোণে পড়ে থাকা একটা শিঙা বেছে নিল জেমস। বামন বলল—এইটা পছন্দ হোল?
--অন্যগুলো সব রাজা-সেনাপতি এদের জন্য। আমার এটাই ঠিক আছে। জবাব দিয়ে, আস্তাবলে এলো জেমস।
--নাও, তোমার পছন্দের ঘোড়া বেছে নাও। বামনের কথার জবাব দেবে কী, চোখ ফেরাতে পারছে না জেমস। কী সুন্দর সুন্দর তেজিয়ান ঘোড়া সব। চোখ ফেরানো যায় না। দেখেই যাচ্ছে জেমস।
ছাই রঙের একটা ঘোড়ায় চোখ আটকে গেল তার। দেওয়ালের একেবারে শেষের দিকে হেলাফেলা করে বেঁধে রাখা। সেটাই বেছে নিল জেমস—এই ছোটটাই নেব। আমি আর আমার বন্দুক আর শিঙার সাথে এটাই ভালো মানাবে।
বামনের মুখে হালকা হাসি—তোমার যেমন পছন্দ। নাও।
সাথে সাথেই সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ঘোড়া, বন্দুক আর শিঙা নিয়ে, জেমস দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ে। আর কেউ, আর কিচ্ছু কোথাও নাই। এক ফুঁয়ে সব মুছে গিয়েছে।
জিন তো পরানোই ছিল। ঘোড়ায় চড়ে বসল জেমস। কোথায় যাবে? তার মন বলল—চলো, এবার দেশের রাজার সাথে দেখা করতে যাই।
রাজার বাড়িতে পৌঁছে দেখে, দেউড়িতে পাহারাদার দাঁড়িয়ে। সে বলল—কী চাই তোমার?
জেমস বলল – রাজার শিকারী বাহিনীতে যোগ দিতে চাই আমি।
সেপাই বলল—শিকারী হতে চাও? তাহলে সেনাপতির কাছে যাও। সেখানেই কাজ হবে। রাজার দরবারে নয়।
এবার সেনাপতির বাড়ি চলেছে জেমস। একটা ছোট্ট পাখি গান গাইছিল গাছের ডালে বসে। ভারি মিষ্টি সুর। গাছের তলায় এসে, দাঁড়িয়ে পড়েছে জেমস। তখনই ফুড়ুত করে নেমে এসেছে পাখিটা। সোজা একেবারে জেমসের ঘোড়ার লাগামের উপর বসে পড়েছে।
অবাক হয়ে পাখিটাকে দেখছে জেমস। তাকে আরও অবাক করে, পাখি বলে উঠল—শোন গো, ছেলে। একটা কথা বলি তোমাকে। বামন ছেলের বাবার ঘাঁটিতে গেছলে তুমি। যে তিনটি জিনিষ তুমি বেছে এনেছ সেখান থেকে, অনেক ক্ষমতা তিনটারই। সেনাপতি তোমাকে রাজার দরবারে নিয়ে যাবে। তিনটা কথা মনে রাখবে। শিঙাটা বাজালে, যাদের কানে যাবে, সবাই নাচতে শুরু করে দেবে। হাতের বন্দুকটা ভুল করেও কারও দিকে তাক করবে না তুমি। কেননা, যার দিকে তুলবে, সে-ই মারা পড়বে সাথে সাথে। আর, রাজাকে বলবে, রাজা চাইলে, রাজকুমারিকে উদ্ধার করে আনবে তুমি।
গড়গড় করে বলে যাচ্ছে পাখি। জেমস ভয় পেয়ে গেল। বলল—রাজা যদি বলে, উদ্ধার করে আনতে। তখন আমার অবস্থা কী হবে। না পারলে, তো শূলে চাপাবে আমাকে। তুমি আসবে তখন আমাকে বাঁচাতে?
পাখি বলল— কথাটা শেষ করতে দাও আমাকে। এক বামন রাজার ঘাঁটিতে গিয়েছিলে তুমি। আসলে সে-ই বন্দী করে রেখেছে এ দেশের রাজকুমারীকে। মহা ধূর্ত লোক সে। রাজকুমারীর সাথে বিয়ের কথা ছিল যার, সেই ছেলেকেও বন্দী করেছে। তোমাকেই বুদ্ধি খাটিয়ে তাদের উদ্ধার করে আনতে হবে। তা যদি পারো, রাজা খুব খুশি হবেন। একজন শিকারীর চেয়েও, অনেক বড় হবে তুমি। কপাল খুলে যাবে তোমার। বলেই পাখি ফুড়ুৎ। উড়ে চলে গেল গাছের ডালে।
সেনাপতির বাড়ি গিয়ে হাজির হোল জেমস। সেনাপতি জানতে চাইল—কী চাও তুমি?
জেমস বলল—রাজার শিকারী হতে চাই আমি। শুনে, সেনাপতি হেসে উঠল। সেনাপতির কয়েকজন বন্ধুও ছিল সেখানে। তারা সবাই বড় বড় শিকারী। তারাও হেসে উঠল জেমসের কথা শুনে। একজন ব্যঙ্গ করে বলল—আরে, দ্যাখো, দ্যাখো। একেবারে বড়মাপের একজন শিকারীর মতই লাগছে একে। বন্দুকখানা দেখেছ? হলফ করে বলতে পারি, একেবারে খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি।
অন্য একজন বলল—আর, শিঙাটা যে বড় মাপের হীরা থেকে তৈরি, এতে কিন্তু কোন সন্দেহ নাই।
একটা লম্বা মতন লোক ছিল দলে। সে বলল—আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মহাবীর আলেকজাণ্ডার যখন বিশ্বজয় করছিলেন, এই ঘোড়াটাতেই চাপতেন তিনি।
তারপর সবাই মিলে সে কী হাসি? এক একজনের দম আটকে যাবার জোগাড়। হাসির দমক থামলে, সেনাপতি বলল—আমার মতে একে রাজার সামনে হাজির করাই ভালো।
সবার মনেই কৌতুক। তারা বলল—ভালো কথা বলেছ। এই ওস্তাদ শিকারীকে নিয়ে সবাই দরবারে যাই চলো।
সেনাপতির এ কথায় সায় নাই। সে বলল—না হে, দরবারে গুরুগম্ভীর পরিবেশ। রাজামশাইকে বরং এখানেই ডেকে আনা হোক। তাঁরও হাসির দরকার। মেয়ে হারাণোর দিন থেকে, মুখে হাসির ছোঁয়াটুকুও নাই মুখে। একজন যাও, রাজাকে ডেকে নিয়ে এসো।
রাজাকে ডেকে আনা হোল। রাজা জেমসের জিনিষপত্র দেখল চেয়ে চেয়ে। গম্ভীর গলায় বলল—কে তুমি? এখানে এসেছ কেন?
আমি রাজার সৈনিক হতে চাই। জেমস জবাব দিয়ে বলল—দায়িত্ব পেলে, রাজকুমারিকে উদ্ধার করে আনতেও চাই আমি।
এ কথা শুনে চমকে গেল সবাই। হাসি ঠাট্টা নিমেষে সব উধাও। রাজারও বিশ্বাস হতে চাইছে না।
--কী বলছো, তুমি নিজে জানো?
জেমস দৃঢ় গলায় জবাব দিল—জেনেই বলেছি কথাটা। রাজকুমারি কি মজা করবার মানুষ।
রাজা বলল—আমার মেয়ে আর তার হবু বর। বেড়াতে গিয়েছিল পাহাড়ের দিকে। আর ফিরে আসেনি। যেন বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। আজ এত বছর হয়ে গেল। তুমি বলছো, তাদের উদ্ধার করে আনবে! নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।
--বিশ্বাস করলে, সুফলই পাওয়া যাবে। এক্টুও কাঁপল না জেমসের গলা।
শুনে, রাজার মনে আশা জন্মাল। বলল—যদি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পারো, মন্ত্রীর আসনে বসাবো তোমাকে। শুধু তাই নয়। এই বিশাল রাজ্য আমার। আদ্ধেকটা কেটে তোমাকে দিয়ে দেব। তুমি শুধু আমার মেয়েকে ফিরিয়ে এনে দাও।
জেমস চনমনে হয়ে উঠল, রাজা রাজী হয়েছে শুনে। বলল—তাহলে, চলুন আমার সাথে। নিজের চোখেই দেখবেন সব কিছু।
রাজা হুকুম করল—ঘোড়া সাজাও আমার।
রাজার ঘোড়া সাজল। সেনাপতির ঘোড়া সাজল। তিনজন শিকারী ব্যঙ্গ করেছিল জেমসকে। ঘোড়া সাজল তাদেরও। দল বেঁধে রওণা হোল সবাই।
চলতে চলতে যখন সন্ধ্যা হয় হয়, সেই পাহাড়ের তলায় এসে হাজির হোল জেমস। পিছনে পাঁচজন ঘোড়সওয়ার বীরপুরুষ।
হাতের শিঙাটাতে ফুঁ দিল জেমস। এই প্রথম তার শিঙায় ফুঁ দেওয়া। এই প্রথম আওয়াজ বেরোল শিঙাটা থেকে। আর, সে কী আওয়াজ! আকাশ বাতাস পাহাড় জঙ্গল—সব কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। সে আওয়াজে ভড়কে গেছে রাজাও। কথা নাই রাজার মুখে। খানিক বাদে আওয়াজটা মিলিয়ে গেল বাতাসে।
তখনই আর একটা শব্দ শুরু হোল। গুমগুম গুরুগুরু গম্ভীর শব্দ। যেন পাহাড়ের বুকের ভিতর থেকে উঠে আসছে শব্দটা। চমকে গিয়ে ভয়ই পেয়ে গেছে রাজা। ভর সন্ধ্যায় এ কোন বিপদের মুখে এসে পড়া গেল।
তখন সকলের চোখের সামনে, চারটে মোটা মোটা থাম জেগে উঠল। টকটকে আগুনের মত লাল রঙ। যেন পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে এল থামগুলো। পিছনে একটা গুহার মুখ। সেই পথ ধরে বেরিয়ে একজন বামন রাজা। ছোট্ট একটা শিশুর মত চেহারা। তবে, মাথাটা বেশ বড়ই। চোখ দুটো তো নয়, আগুনের গোলা।
সামনে শিঙা হাতে জেমস দাঁড়ানো। তাকে দেখে, ভয়াণক গর্জন করে উঠল বামন রাজা। জেমস কিন্তু তাতে ভড়কে গেল না। বলল—বেশি হম্বিতম্বি কোর না। আমাদের রাজকুমারীকে আটকে রেখেছ তুমি। আটকে রেখেছ তার হবু বরকেও। রাজামশাই নিজে এসেছে তোমাদের পাহাড়ে। ছেলেমেয়ে দু’জনকে ছেড়ে দাও।
বামন রাজা বলল—ছেড়ে দেব? সন্ধ্যা থেকে সারা রাত সে মেয়ে গান শোনায় আমাকে। কী মিষ্টি গলা তার। বললেই ছেড়ে দেব?
জেমস বলল—ভালো মুখে বলছি, ছেড়ে দাও। নইলে, এমনি নাচন নাচাবো, তাতেই মারা পড়বে রাজ্যশুদ্ধ।
আবার হেসে উঠল বামন রাজা—নাচিয়ে মারবে আমাদের? এমন যুদ্ধ তো শুনিনি কখনও।
কথা শেষ হোল না, আবার শিঙা হাতে নিল জেমস। ফুঁ দিতেই একটা মিষ্টি সুর ফুটে উঠল তাতে। অমনি এক মজার দৃশ্য। বামন রাজা নাচতে লেগেছে। সেই সুর ভেসে গিয়েছে গুহার ভিতরেও। পিল পিল করে বামন সেনার দল নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসছে বাইরে। আসছে তো আসছেই। শ’য়ে-শ’য়ে হাজারে-হাজারে। কিন্তু সুরের সাথে তাল মিলিয়ে, নাচছে সকলেই।
রাজামশাই কিন্তু বামন রাজাকেই দেখে যাচ্ছে। লিকলিকে হাত-পাগুলো। কিন্তু মাথাখানা হাঁড়ির মত। লম্বা চোঙার মত নাক। মাথায় শনের নুড়ির মত ঝাঁকড়া চুল। এমন একজনের নাচ দেখে, হাসি চেপে রাখতে পারল না রাজা। আদরের মেয়েকে হারাবার পর, আজ কতো বছর বাদে, হাসি ফুটেছে রাজার মুখে।
নাচতে নাচতে বামন রাজার একেবারে কাহিল অবস্থা। কোন রকমে ককিয়ে উঠল—পাঁচশ’ বছর বয়স আমার। মারা পড়ব যে। দোহাই তোমার, বাজনা থামাও।
জেমস জবাব দিল—থামালাম। আমাদের রাজকুমারীকে এনে দাও। আঙুলের মত মাপ সৈন্যদের। এক দল সৈন্য ভেতরে দৌড় লাগালো। তাদেরও তখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মুক্তি পেলে বাঁচে।
একটু বাদেই রাজকুমারী বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। দৌড়ে এসে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
জেমস বলল—এবার রাজকুমারীর বরকে ফেরত দাও।
বামন রাজা বলল—তাকে তো ফেরত দেওয়া যাবে না। সে তো আর রাজার ছেলেই নাই। বামন হয়ে গিয়েছে।
জেমস কোন জবাব দিল না। আবার শিঙা ধরেছে হাতে। বাজাতে যাবে, বামন রাজা চেঁচিয়ে উঠল—এক্কেবারে না। ওটা বাজিও না। ব্যবস্থা করছি।
আবার দৌড়ল সৈন্যরা। এবার যাকে নিয়ে এল, জেমস দেখে অবাক। এ তো সেই বামন ছেলে। এর বাবাই তো ঘোড়া, বন্দুক আর এই শিঙা দিয়েছিল। এই চেহারায় বদলে দিয়ে এক রাজার ছেলেকে? নিজের ছেলে হিসেবে রেখে দিয়েছে!
জেমস ধমকে উঠল—নিজের চেহারায় ফিরিয়ে দাও একে। নইলে, আমার হাতে কী আছে জানো তো? নাকানি-চোবানি খাইয়ে, মেরেই ফেলব আজ তোমাকে।
উপায় নাই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বামন রাজাকে করতে হবে কাজটা। সে বলল—দিতে পারি। আমার শিঙাটা আমার হাতে দাও।
জেমস যেই শিঙাটা বামন রাজার হাতে দিয়েছে, সাথে সাথেই বামন ছেলে মিলিয়ে গেল বাতাসে। তার বদলে, অপূর্ব সুন্দর এক রাজার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সবার সামনে।
সবাই খুশি। সবার মনে আনন্দ। এত বছরের হারা নিধি পেয়ে, এবার রাজামশাই নাচতে লেগেছে ধেই ধেই করে।
কিন্তু তখনই ভোজবাজির মতো এক কাণ্ড! বামন রাজা, তার হাজার হাজারে সৈন্য, আগুন রঙের থাম, জেমসের ঘোড়া, হাতের বন্দুক সব উধাও। কোন কিছুর কোনও চিহ্নই নাই কোথাও। প্রচণ্ড শব্দে পাহাড়ের গুহামুখটাও বন্ধ হয়ে গেল। কেবল তারা আটজন প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়তলীতে।
সারা রাতের যাদু শেষ। সূর্যদেব উঁকি দিচ্ছে আকাশে। আলো ছড়াতে শুরু করেছে। জেমস বলল—এবার আমি যাই।
রাজামশাই হাঁ-হাঁ করে উঠল— বললেই হোল? কোথায় যাবে তুমি?
আমি তো গরীবের ছেলে। ভাগ্যের খোঁজে বেরিয়েছি ঘর থেকে। আরও কতদূর হয়ত যেতে হবে আমাকে।
রাজা এবার হা-হা করে হেসে উঠল—ভাগ্য তোমার ফিরে গেছে বাপু। তুমি আর গরীব নাই। কোথাও যেতে হবে না তোমাকে।
রাজকুমারি মুখঝামটা দিয়ে বলল—যাব বললেই, যেতে দিচ্ছেটা কে তোমাকে? আমাকে মুক্ত করে এনেছ তুমি। ভাই-বোনের মত সারা জীবন একসাথে থাকব আমরা দুজনে। এখানেই থাকবে তুমি।
রাজা বলল—খুব ভালো কথা বএলছিস, মা। সিকি নয় হে। রাজ্যটা আধাআধি ভাগ করে, তোমাদের দু-ভাইবোনকে দেব আমি। নতুন একটা প্রাসাদ বানিয়ে দেব তোমার জন্য। অন্য কোথাও যাওয়ার কথা মনেও এনো না কোনদিন।
সবাই খুশি। ধুমধাম করে বিয়ে হোল রাজকুমারির। রাজ্য জুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল।
কিন্তু চারজন লোকের মনে সুখ নাই। সেনাপতি আর তার তিন স্যাঙাৎ। হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে যেতে লাগল লোকগুলো।
0 Comments