বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ২৯
চিহড়
ভাস্করব্রত পতি
'চিহড় গাছের পাতা, ঝরতে
দ্যাখলেই
মনে পড়ে – আসছে আষাঢ়।
মা উঠোনে, বুননে – ঘঙ
সেটা মাথায়, ভোঁদৌড়ে
আনবো – বর্ষা এবার'।
-- ঘঙ, নটরাজ অধিকারী
এই অখ্যাত কবির কবিতায় জঙ্গলমহলের ঊষর জমিতে জন্মানো চিহড় গাছ নিয়ে আষাঢ়ের বর্ষার আগমন বার্তা খুঁজে পাওয়া যায়।
চিহড় গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম Bauhinia vahliivahlii এবং Bauhinia racemosa। এটি Fabaceae পরিবারভুক্ত। চিহড় গাছকে অসমীয়াতে নাক কাটি লেওয়া, হিন্দিতে মালু, জাল্লার, জাল্লুর, মহুল, কন্নড়ে চম্বোলি, মালায়ালামে মোত্তানভাল্লি, ওড়িয়ায় শিয়ালি, মারাঠিতে চমবুলি চাম্বুলি, সংস্কৃতে আসমানটাকা, মালানঝানা, তামিলে মাণ্ডারাই, কুট্টুমাণ্ডারাই, আড্ডা, তেলুগুতে মাডাপু, আডাট্টিগে, নেপালিতে ভোরলা ভোর্লা বলে। ইংরেজিতে বলে Maloo Creeper, Bauhinia climber, Camel’s Foot Climber।
চিডহড় গাছের ফুল
চিহড় গাছের ফল ফাটার সময় বিকট শব্দ হয়। এর ছালে রয়েছে ৭ শতাংশ ট্যানিন এবং কাণ্ডে থাকে ৮ শতাংশ ট্যানিন। কাঁচা ফল ও তার বীজ তরকারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর পাকা বীজের মধ্যে মেলে কাজুবাদামের গন্ধ। ১০-৪০ সেমি আয়তনের পাতাগুলো উটের ক্ষুরের মতো আকৃতির। সাধারণত গরমকালে এখানকার মানুষ এই চিহড় পাতা সংগ্রহ করে রোদে শুকোতে দেয়। আস্তে আস্তে গাছের পাতার রঙ সবুজ থেকে হালকা তামাটে হলে বাড়ির মহিলারা সেগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে সেলাই করে। এর আগে সংগ্রহ করা হয় সজারুর কাঁটা। সেই কাঁটাকে দু’দিক থেকে পালিশ করে একটার পর একটা চিহড় পাতা জুড়ে সেলাইয়ের কাজ করা হয়।
চিহড় গাছের পাতা
'আনন্দ পুরস্কার' প্রাপ্ত সাহিত্যিক নলিনী বেরা তাঁর 'অপারেশন পাঁচ কাহিনা' ছোটগল্পের এক অংশে উল্লেখ করেছেন, "আচমকা কে বা কারা সামনের বড় জঙ্গলে ডালে পাতায় ঝোপেঝাড়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ‘হই-হুস হুস’ আওয়াজ করে কাকে যেন তাড়া করছে। জঙ্গল আর সে জঙ্গল নেই। গরু-ছাগল চরাতে এসে বট-অশ্বত্থের ঝুরিতে চিহড় লতার দোলনা বানিয়ে দোল খাওয়ার দিন শেষ"!
বর্ষার সময় জঙ্গলমহল এলাকার মানুষজনের কাছে চিহড় পাতার 'ঘঙ' টুপি হয়ে ওঠে ঘরোয়া ছাতা। গ্রামীণ লোকজন বৃষ্টির ছাঁট থেকে মাথা বাঁচাতে আজও এই বিশেষ টুপি ব্যবহার করেন সমস্ত কাজে। এই ঘঙ টুপি আসলে পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ড এলাকার মানুষের সস্তার বর্ষাতি।
আসামে তালপাতার তৈরি অনেকটা এরকম ধরনের যে টুপি মেলে তা হোলো 'জাপি'! পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বাঁশের চঁচালি দিয়ে এ রকম টুপি 'টোকা' ব্যবহার করে চাষীরা। মাঠে চাষের সময় এটা পরা হয়! রোদ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা মেলে। 'আমরা চাষ করি আনন্দে, মাঠে মাঠে বেলা কাটে, সকাল থেকে সন্ধ্যে' ছড়ার সঙ্গে যে চাষীর ছবি থাকতো, তাঁর মাথায় এরকমই টুপি পরানো ছিলো। নদীয়ার খেদাইতলার সাপের মেলাতেও এরকম বাঁশের তৈরি 'টোকা' বিকোয়। তালপাতার 'পেখুয়া'ও ব্যবহৃত হয় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে। একে 'মাথালি'ও বলে।
চিহড় পাতায় তৈরি ঘঙ টুপি মাথায় নিয়ে লোক গবেষক চিন্ময় দাশ
ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া থেকে ১৫ কিমি দূরে কানাইসর পাহাড় পূজার মেলায় প্রতি বছর অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে এই চিহড় পাতার ঘঙ টুপি। প্র চুর মানুষ কেনেন এই টুপি। এরকম টুপি এই প্রান্তদেশ এলাকার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য এলাকাতেও মেলে বর্ষার সময়। পুরুলিয়ায় কেউ কেউ অবশ্য 'টুকা টুপি'ও বলে। বেলপাহাড়ির পার্শ্ববর্তী বারোডাঙা, মালিবনি গ্রামে এগুলো তৈরি হয়। আজকের দামী দামী হ্যাট, ক্যাপদের সাথে লড়াইতে মাথা উঁচু করেই টিকে আছে চিহড় পাতার ঘঙ টুপি।
ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া এলাকার প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার জঙ্গলের চিহড় গাছের বড় বড় পাতা দিয়ে জুড়ে জুড়ে অপূর্ব শিল্প সুষমায় বানানো টুপিগুলোর গায়ে লেগে রয়েছে আদিম বন্যতার নির্যাস! জঙ্গলের প্রান্তবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতির উপহার। আর চিহড় গাছের বিভিন্ন অংশে রয়েছে agathioflavone, mono and di-o-methyl derivatives; kaempferol, glycosides of quercitol, isoquercitroside, rutoside, alpha- taxifoline rhamnoside, quercetin, betulinic acid, tannins and proteins 5, kaempferol, quercitroside ইত্যাদি।
চিহড় পাতার বিশেষ বর্ষাতি -- ঘঙ টুপি
তবে পুরুলিয়া সংলগ্ন এই ঘঙ টুপি সবার চেয়ে আলাদা এবং অভিনব। এখনও জঙ্গলের পরিচিত চিহড় গাছের পাতা দিয়ে তৈরি লোকজ সংস্কৃতি হারিয়ে যায়নি'। মোটামুটি ৮০ - ১০০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হয় বড় ঘঙ এবং ৫০ - ৬০ টাকা দাম পড়ে ছোট ঘঙের। এক একটা বড় ঘঙের ওজন তিন থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত হয়।
ঔপন্যাসিক নলিনী বেরার ছোটগল্প 'যৌবনমেলা'তে আছে এই চিহড়ের কথা --
"মঙলুরা এতবড় মেলা আগে কখনও দেখেনি। যেদিকেই দেখছে শুধু লোক আর লোক, শুধু দোকান আর দোকান। কানাইসর পাহাড়পূজার মেলাতেও এত লোক আসেনি, এত দোকান বসেনি।
কী নেই? দোকানগুলোয় বিক্রি হচ্ছে রাজ্যের জিনিস। মাদল ধামসা, তিরিয়ো আড়বাঁশি, কেঁদরি, ভুয়াং, চ্যাচ্চেড়ি, ঘন্টি। এমনকি গরুর গলার ‘ঠরকা’ও।
কতরকম শিকড় বাকড়। শতমূলি, চুরবন, বাঘনখী, কানকুলি, মেঢ়ামারী, দধিগড়া, ঘৃতকুমারী, বহেড়া, চিহড়ের মূল, ফল ফুল। হাড়গিলের ঠোঁট, বাজপাখীর নখ, ঝিঁকরকাঁটা, ঘোড়ার ল্যাজের চুল"।
🍂
3 Comments
কবি নটরাজ অধিকারী।।
ReplyDeleteশূন্য দশকের কবি।।
বাংলাদেশের যে ক'জন প্রতিভাবান কবিদের আবির্ভাব তাদের মধ্যে সে অন্যতম।।
নটরাজ অধিকারী আমার প্রতিবেশী, আমার অনুজ, সে কারণে জানি স্বহজাত কবি সে।।
অখ্যাত কবি বলার জোর প্রতিবাদ জানাই। উনি অখ্যাত নন। বিখ্যাত বলতে যা প্রচলিত তা নয় কিন্তু। কবি নটরাজ অধিকারী ধীরে ধীরে তিন বাংলার আকাশেই জ্বলতে থাকা এক নক্ষত্র হয়ে আবির্ভূত হবেন। আপনারা তাঁকে আরও জানলেই সে বিখ্যাত হয়ে উঠে। উনি মানুষ হিসেবে পরিষ্কার মনের অধিকারী।
ReplyDeleteকাব্যের একটি গুন আছে, যা কম লোকই অস্বীকার করবে; কাব্য গদ্যের তুলনায় অনেক অল্প কথায় অনেক বেশি ভাব প্রকাশ করে থাকে।
ReplyDeleteপ্রিয় কবি নটরাজ অধিকারী অসামান্য একজন লেখক।তিনি এ সময়ের সেরা কবি'দের একজন। নটরাজ অধিকারী এ কালের সাক্ষী, এ কালের শিক্ষক।