জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬২/বিজন সাহা

উটের কাফেলায়

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬২

বিজন সাহা 

এলিস্তা  

এলিস্তা – কালমিকির রাজধানী। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। আমার সোভিয়েত জীবন কেটেছে মস্কোয়। মাঝে মধ্যে এদিক সেদিক ঘুরতে গেলেও সেটা মূলত ছিল ইউরোপিয়ান রাশিয়ায় আর রুশ প্রধান এলাকায়। সে সময় ঈশ্বর পালিয়ে বেড়াতেন, তাই তার ঘরবাড়ির ছিল নাজুক অবস্থা। কিছু কিছু যা ছিল তা প্রাচীন রুশ শহরগুলোয় যাদের অবস্থান ছিল গোল্ডেন রিং ও তার আশেপাশে। এরপর ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিত কাজান যেতে শুরু করি। তাই মূলত পরিচয় ছিল গির্জা আর মসজিদের সাথে। কিন্তু এখানে চারিদিকে প্যাগোডা আর বাড়িঘর কিছুটা জাপানী বা কোরিয়ান স্টাইলে। তাই সব কিছুই কেমন যেন অন্য রকম মনে হচ্ছিল। এটা যে রাশিয়া সেটা উপলব্ধি করতে কষ্ট হচ্ছিল। 

এই জনপদ গড়ে ওঠে ১৮৬৫ সালে, আজ থেকে দেড় শ বছর আগে। শহরের নামকরণ করা হয় এলিস্তা বা এলিস্তিনকা নামক নদীর নামানুসারে। এলিস্তা শব্দ এসেছে কালমিকি শব্দ এলসেন থেকে যার অর্থ বালি বা বালুকাময়। ১৯৩০ সালে এই জনপদ শহরের মর্যাদা পায়। ১৯৪৩ সালে কালমিকদের নির্বাসনে পাঠানো ও কালমিকি স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্র বিলুপ্ত করা হলে শহরের নাম বদলিয়ে রাখা হয় স্তেপনই। ১৯৫৭ সালে শহরকে তার আদি নাম ফিরিয়ে দেয়া হয়। 

🍂

১৮৪৫ সালে সম্রাট প্রথম নিকোলাই কালমিকির স্তেপভূমি বনভূমিতে পরিণত করার নির্দেশ জারি করেন। বন বিভাগের কর্তৃত্বে প্রথম বৃক্ষরোপণ করা হয় ১৮৫৩ সালে এরগেনেই বলে এক জায়গার দক্ষিণে ও এলিস্তা এলাকায়। বনাঞ্চল বৃদ্ধির জন্য অধিক লোকবলের প্রয়োজন দেখা দিলে বন বিভাগ প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে এলিস্তা এলাকায় জনপদ গড়ে তোলার জন্য আবেদন জানায়। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত এক্সপিডিশন চালিয়ে এলিস্তা নদীর ধার দিয়ে ক্রেস্তোভস্কই ও আস্ত্রাখানের মধ্যে ১৫ টি জনপদ গড়ার জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়। প্রথম জনপদ গড়ে তোলার আগে এই এলাকায় কালমিকির যাযাবররা বসবাস করত।   এই এলাকার ভূমি ছিল বালুকাময় তাই কালমিকরা এর নাম দেয় এলস্তা। পরবর্তীতে এই নামটি গৃহীত হয়। এলিস্তার প্রতিষ্ঠাতা রুশ ভূমিদাস স্তেপান প্রকপিয়েভিচ কীকভ যিনি ১৮৬২ সালে এখানে প্রথম ডাগআউট স্থাপন করেন। ১৮৬৫ সালে এখানে ১৫ পরিবার বসবাস করত। এই ১৮৬৫ সালকেই তাই শহরের প্রতিষ্ঠা বর্ষ হিসেবে ধরা হয়। এলিস্তা পরবর্তীতে সবচেয়ে বড় পশু মেলার জন্য খ্যাতি লাভ করে। বিপ্লবের আগে পর্যন্ত কালমিকি আস্ত্রাখান প্রভিন্সের অংশ ছিল। ১৯১৮ সালে এখানে সোভিয়েত রাজ স্থাপিত হয়। ১৯২০ সালের ০৪ নভেম্বর   কালমিকির জনগণের স্বাতন্ত্র্য এলাকা গঠনের আদেশ জারি করা হয়। তবে সাময়িক ভাবে সেই রাজ্যের প্রশাসন আস্ত্রাখান থেকে কাজ চালিয়ে যায়। ১৯২৫ সালে কালিমিকির প্রাশাসনিক কেন্দ্র এলিস্তায় স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯২৬ সালের ২৯ এপ্রিল সোভিয়েত মন্ত্রী সভা এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করে আদেশ জারি করে। ১৯২৭ সালে রাশিয়ার গণ কমিসারদের সোভিয়েত কালমিকির প্রশাসন আস্ত্রাখান থেকে এলিস্তায় স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সেই কাজ শুরু হয়। ১৯৩০ সালের ১০ মার্চ এলিস্তাকে শহর বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এসব ঘটনা থেকে আমরা সোভিয়েত আমলের ব্যুরোক্র্যাসির একটি পরিষ্কার চিত্র পাই।

অস্তাফ বেন্দেরের স্ট্যাচু

১৯৪২ সালের ১২ আগস্ট জার্মান সেনারা কালমিকি দখল করে। সে সময় কালমিকির আশেপাশে সোভিয়েত ও কালমিকির বিভিন্ন বাহিনী আন্ডারগ্রাউন্ডে তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যায়। এ সময় হানাদার বাহিনী অনেক বেসামরিক লোক ও গেরিলাদের হত্যা করে। ১৯৪২ সালের ০৯ সেপ্টেম্বর শহরে বসবাসকারী ৬০০ ইহুদীকে জার্মান বাহিনী হত্যা করে। ১৯৪২ সালে ৩১ ডিসেম্বর রেড আর্মি এলিস্তা শহর শত্রু মুক্ত করে, তবে পালিয়ে যাবার আগে শত্রু বাহিনী আগুন লাগিয়ে প্রায় পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ১৯৪৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর ককেশাসের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে কালমিকিদের জোরপূর্বক সাইবেরিয়া, উত্তর কাজাখস্তান ও দূরপ্রাচ্যে নির্বাসন দেয়া হয়। ১৯৪৩ সালে কালমিকি প্রজাতন্ত্র বিলোপ করা হয়। ১৯৪৪ সালের ২৫ মে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের আদেশক্রমে এলিস্তার নাম বদলিয়ে রাখা হয় স্তেপনই। তখন স্তেপনই ছিল আস্ত্রাখান প্রদেশের স্তেপনই অঞ্চলের প্রাশাসনিক কেন্দ্র। ১৯৫২ সালে স্তেপনই অঞ্চল স্তাভ্রোপোল প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করা হয়। কালমিকি প্রদেশের বিলোপ ও জনগণের নির্বাসনের পরে যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর আর গড়ে তোলা হয়নি। শহরবাসী তখন শহরতলীতে বসবাস করতে শুরু করে। ১৯৫৭ সালে স্তালিনের কাল্টের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে কালমিকি প্রজাতন্ত্র নতুন করে গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬৯ সালে এখানে রেল স্টেশন উদ্বোধন করা হয়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কলকারখানা তৈরি হতে থাকে। ১৯৭০ – ১৯৮০ দশকে চলতে থাকে নির্মাণ কাজ। মরুভূমির মধ্যে তৈরি হয় এলিস্তা - আস্ত্রাখান, এলিস্তা – ভোলগাগ্রাদ হাইওয়ে। ১৯৯৮ সালে এখানে বিশ্ব দাবা অলিম্পিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, তৈরি হয় দাবার শহর বা চেস সিটি। ১৯৯০ – ২০০০ সালে তৈরি হয় বিভিন্ন স্থাপনা যা কালিমির মানুষের প্রথাগত ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এই শহর হয়ে ওঠে রাশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। 

আমরা যে বাসায় থাকতাম তার পাশেই ছিল অস্তাফ বেন্দেরের প্রতিকৃতি। অস্তাফ বেন্দের এক গল্পের নায়ক, বলা যায় খল নায়ক যে লোকজনকে ঠকাতে পছন্দ করে। আসলে এ দেশে সিনেমার বিভিন্ন নায়কদের স্ট্যাচু হরহামেশাই দেখা যায় আর এদের দেখে যতটা না আসল মানুষের কথা মনে হয় তারচেয়ে বেশি মনে হয় গল্পের নায়কের কথা। অস্তাফ বেন্দেরের স্ট্যাচু দেখে ফিরে গেলাম ইলফ ও পেত্রভের লেখা বারোটি চেয়ার নামক গল্পে। মনে আছে আমি আর দেমিদ এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসিও করলাম। কিছুটা দূরে দেখা গেল রুশ অর্থোডক্স চার্চ। মনে হয় নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি অথবা পুনর্নির্মাণ কাজ চলছে। যদিও কালমিকি ও এলিস্তার বাসিন্দারা মূলত তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি তবে এখানে রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদী এসব ধর্মানুসারী লোকজনও একেবারে কম নয়। আমরা প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলাম এখানকার প্যাগোডাগুলো দেখতে যাব। তবে এর বাইরেও অনেক কিছুই আমাদের দেখার ছিল। তাদের অন্যতম ছিল উটের খামার। মরুভূমিতে এলাম আর উট দেখব না তা কি করে হয়? এদিক সেদিক জিজ্ঞাসা করে আমরা প্রথমে গেলাম শহর থেকে দূরে এক তাবুতে। সেখানে উট, ঘোড়া এসবের দেখা পেলাম। তবে সেটা কি কোন সার্কাস নাকি অন্য কিছু তা উদ্ধার করতে পারলাম না। সেখানেই একটা স্থানীয় রেস্তোরাঁয় আমরা লাঞ্চ সেরে নিলাম। রেস্তরার নাম ছিল যাযাবরদের ক্যাফে। খাবার মূলত মাংসের, ওদের নিজেদের মত করে তৈরি। নিরামিষ বলতে কেবল সালাদ। বেচারা দেমিদ। সেখানে বেশ কিছু ইউরতা ছিল – এগুলো তাবু। এখানে চাইলে মনে হয় কুমিজ বা ঘোড়ার দুধ এবং উটের দুধ পাওয়া যায়। একটু টক টক স্বাদের এসব দুধ শুনেছি খুবই উপকারী। এসব প্রথম খেয়েছি সেই সোভিয়েত আমলে যখন কাজাখস্তান, কিরঘিজিয়া এসব জায়গায় বেড়াতে গেছিলাম। আসলে এই এক সমস্যা। কোন পরিচিত কিছু দেখলেই মনে পড়ে যায় পুরানো দিনের কথা, হারানো দিনের বন্ধুদের কথা। 

স্থানীয় অর্থোডক্স চার্চ

এখান থেকে আমরা গেলাম আরেকটি খামারে। সেখানেও কাউকে পেলাম না। তবে সব দেখে বুঝালাম এখানে উটের পিঠে চড়ে ঘোরার ব্যবস্থা আছে। তবে সেটা মনে হয় স্তেপে নয়, এদের খামারের ছোট্ট জায়গায়। এদিক সেদিক হেঁটে শুনতে পেলাম উটের ডাক। তিন জনেই রওনা হলাম সেই শব্দ লক্ষ্য করে। না, আমরা রাজা দশরথ নই যে শব্দভেদী বাণ মেরে বিপদে পড়ব। দেখি একটা খাঁদের মত। সেখানে অনেকগুলো উট ঘোরাফেরা করছে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জায়গাটি ঘেরা। এটা উটের হাত থেকে আমাদের মত লোকজনদের রক্ষা করতে নাকি আমাদের হাত থেকে উটদের – সেটাও জানা হল না। মনের আনন্দে ওদের ছবি তুললাম। আগে অবশ্য আমরা কয়েকটি প্যাগোডা, বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি স্থানীয় মেমোরিয়ালে এসব দেখেছি। কথা বলেছি অনেকের সাথে। সে গল্প আগামী পর্বে। 

বৌদ্ধ শহর এলিস্তা
https://www.youtube.com/watch?v=PYBx7-UCH_Y&t=3134s

ছবিতে এলিস্তা 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=267

 

Post a Comment

0 Comments