জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ২১/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ২১


স্বপন কুমার দে

মল্লিকার মনটা ভালো নেই। সেকেন্ড সেমিস্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছে, তার রেজাল্ট ভালো হয়নি। পরীক্ষার আগে বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল, ডাক্তারখানা ছোটাছুটি করতে হয়েছে। দুশ্চিন্তায় সে সময় বিশ্রাম বা পড়ার সুযোগ, কোনোটাই পায়নি। তারপর বাবার মৃত্যু কিছু সময়ের জন্য তাকে একেবারেই থমকে দিয়েছিল। পরে পরে শ্রাদ্ধ শান্তি দারিদ্র্যের বোঝা-- সব নিয়ে সে বিপর্যস্ত হয়েছে। তাই যতটা স্টাডি করবার দরকার ছিল ততটা সে করতে পারেনি। মার্কশীটে এগুলো লেখা থাকবে না, থাকবে শুধু কয়েকটা সংখ্যা, যে সংখ্যা নির্ধারণ করে দেবে স্টুডেন্ট হিসেবে তুমি কতটা ভালো বা খারাপ।

মল্লিকার মার্কশীটের নম্বরগুলো তাকে খুশি করতে পারেনি। আগের সেমিস্টারে যেমন রেজাল্ট হয়েছিল, এবারে তার তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। এরজন্য তার মনে হতাশা জাগেনি কিন্তু একপ্রকার জেদ চেপে বসল, পরের বার ভালো করতেই হবে। তাই লড়াইয়ের জন্য নিজের মনটাকে প্রস্তুত করতে লাগল। বিরুদ্ধপক্ষ অবশ্য কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কেউ খোঁচা মেরে বলল," কার কতটা দম আমরা জানি। যার যেমন স্ট্যান্ডার্ড, সে সেরকমই রেজাল্ট করবে।" আবার কয়েকজন ব্যাপারটাকে উপভোগ করতে লাগল।

অভির রেজাল্ট আগের বারের তুলনায় অনেকটা ভালো, তাই তাকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। সে মল্লিকাকে সান্ত্বনা দিল," তুই যে মেধাবী ছাত্রী সেটা আমরা সবাই জানি অথচ মানতে চাই না। এটা আমাদের মজ্জাগত রোগ, বলা ভালো সমাজের উন্নাসিকতা। একটা গরিব বস্তির মেয়ে হয়ে সমানে টক্কর দিচ্ছিস তথাকথিত সভ্য সমাজের সঙ্গে, এটাই তাদের গাত্র জ্বালা। তাই সামান্য সুযোগ পেয়েই উল্লাস করছে। তবে আমি তোকে বলে রাখছি, লড়াইয়ের এখনও অনেক বাকি, শেষ হাসিটা তুইই হাসবি আর যারা তোকে নিয়ে উপহাস করছে তারা কাঁদবে। এখন এটা নিয়ে মন খারাপ করবি না। চল্ দোকানে বসে টিফিন করি।" মল্লিকার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু অভির পীড়াপীড়িতে দোকানে গিয়ে হাজির হল।
🍂
এদিকে মল্লিকা আর অভিরূপকে নিয়ে একটা গসিপ রটে গেল। এমনকি আড়ালে অবডালে ' মলি-রূপ' জুটি নিয়ে রঙ্গ ব্যঙ্গ চলতে লাগল। কথাটা পাঁচ কান হতে হতে ওদের কানেও এল।অভিই একদিন মল্লিকাকে কথাটা জানাল। মল্লিকা ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিল না। একটু হেসে বলল," যাদের কোনো কাজ নেই, তারাই ওসব নিয়ে চর্চা করে আনন্দ পায়। আমি ওটা নিয়ে চিন্তিত নই।" একথার মধ্যে অভিরূপ যেন অন্য আরেক ইঙ্গিত পায়। মনের কোণে একটা জায়গায় সুখের স্পর্শ অনুভব করে। সে নিজেকে মল্লিকার সদানিবিষ্ট প্রকৃত বন্ধু, অভিভাবক, হিতাকাঙ্খী হিসাবে আবিষ্কার করে। মল্লিকার সুখে দুখে পাশে দাঁড়াতে চায়। মল্লিকাকে যারা বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চায়। একটু একটু করে ভালোবাসা জন্ম নেয়। স্পর্শ চায় ভালোবাসার, অনুরক্ত হয়।

হায় রে মানুষের মন! কোনোকিছুই যে একতরফা হয় না, এইটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি বা ভাবার মতো বিচারবোধ থাকে না। আমাদের রোমান্টিক মন অসম্ভবকেও সম্ভাব্যের সীমায় নিয়ে আসে। অগ্র পশ্চাৎ ভাবনাগুলো পিছনে পড়ে থাকে। জানলেও মানতে চাই না। আলেয়ার আলোতে চোখ ধাঁধায়, পরিণাম সুখের হয় না।

প্রতিদিনের মতো মল্লিকা আজও টিউশন পড়াতে গেছে। বাবার অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সময় সে কয়েকটা দিন ছুটি নিয়েছিল, তারপর আর সে কামাই করতে চায় না। আজ সে গেছে মন্টিকে পড়াতে। ম্যাডাম মন্টির প্রিয় শিক্ষিকা। তার কাছে মন্টি খুব আনন্দের সঙ্গে সে পরের পর অংক করে যায়, নতুন ধরনের অংক শেখে। মল্লিকার টেকনিক, তার এনার্জি, নিষ্ঠা ছাত্রী এবং অভিভাবকের কাছে পরম সন্তোষের বিষয়। আর মন্টির জন্য উপরি পাওনা থাকে শেষ সময়টুকুতে নানান ধরনের গল্প বলেন ম্যাডাম।

মল্লিকা বুঝতে পারে, আজকের পরিবেশটা একটু আলাদা। বাড়িতে কেমন যেন একটা থমথমে ভাব, কাউকেই হাসিখুশিতে দেখা গেল না। মন্টি পড়তে বসল, একরাশ মন খারাপের করুণ চাহনি নিয়ে। যাই হোক, অপরের পারিবারিক বিষয়ে কৌতূহল না থাকাই ভালো, এই ভেবে মল্লিকা নিজের পড়ানোর ওপর মনোযোগ দিল। মন্টি বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। কথায় কথায় জানাল, তার কাকু পুরুলিয়াতে বদলি হয়ে গেছে, আগামী সোমবারই সেখানে চলে যাচ্ছে, তাই বাড়ির সবার মন খারাপ।

ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না মল্লিকা। সরকারি চাকরিতে ট্রান্সফার হওয়া তো স্বাভাবিক, তার জন্য বাড়ির লোকের মন খারাপের কী আছে? মন্টির কাকুকে বড়লোকের আদুরে ছেলে ছাড়া অন্য কিছু মনে হল না তার। এদের কাছে পৃথিবীটা এক রকম আর যারা একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে তাদের কাছে আলাদা রকম। এই সব ব্যাপার নিয়ে মন্টির সঙ্গে আলোচনা করতে তার রুচিতে বাধে বলে  কথা না বাড়িয়ে মল্লিকা নিয়ম মতো ছাত্রীকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়াতে থাকল।

প্রতিদিনই মন্টির ঠাম্মা এ ঘরে ঢুকে মল্লিকার সঙ্গে পাঁচ দশ মিনিট গল্প করে যান, আজ তিনিও এলেন না। এমনকি মন্টির মা-ও দিদিমণির চা- টিফিন টেবিলের উপর রেখে দিয়ে চলে গেল। মন্টিও আজ দিদিমণির কাছে গল্প বলার অনুরোধ করল না। আজ একটু আগেই পড়ানো শেষ করে মল্লিকা ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বেরোনোর সময় একটা কথা কানে এল," এসব মেয়েদের থেকে দূরে থাকাই ভালো। এরা কখন কী যে করতে পারে তার কোনো ঠিক নেই।"

শেষ কথাটা মল্লিকার মনে একটা ধন্দ তৈরি করল। কাকে নিয়ে এই কথা হতে পারে? তবে কি বাইরের কারো সম্পর্কে? তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই নয়,কারণ সে মন্টিদের পরিবারের আলোচ্য বিষয় হবে না এটা নিশ্চিত। তবে কি মন্টির হবু কাকিমাকে নিয়ে? সে শুনেছিল, মন্টির কাকুর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েই আছে, শুধুমাত্র রেজিস্ট্রি এবং সামাজিক অনুষ্ঠানটাই বাকি আছে। তাহলে, আজ অন্য কথা কেন? বিয়েটা কি ভেঙে গেছে? বড়লোকদের এরকম অনেক বদ্ খেয়াল আছে আর দোষ পায় মেয়েরা। যাই হোক, আপাতত সে পরের চিন্তা ছেড়ে নিজের বাড়ির পথে পা বাড়ায়।  

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments