ভাঙা আয়নার মন
পর্ব ১৭
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
আকাশ ভরে জোছোনায় ...
প্রায়ই আজকাল তাদের বাবাকে নানা জায়গায় দৌড়োদৌড়ি করতে হয় ।বাবার চাকরির নাকি কি সব ভুল হয়ে গেছে। পুজোর ছুটি শেষ হবার পরও বাপি তার কলেজে গেল না। একদিকে ভালোই হয়েছে। বাবার সঙ্গে অনেক বেশি থাকা যাচ্ছে। যদিও বাবা তার দরকারি কাগজের ফাইল নিয়ে হরদম কলকাতা, বারাসাত আরও কোথায় কোথায় চলে যায় তবে দুতিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসে।
ঝিনি ভোরে উঠে ফুল কুড়োতে যায়। মা'র ঠাকুরের আসনে অনেক ফুল রেখেও সে পেতলের রেকাব, কাঁসার গেলাস সব কিছুতে জল দিয়ে ঘরে ঘরে শিউলি রাখে। একটা দুটো স্থল পদ্ম সাজায়। কাঁসার বাটি ,মনে হয় গোল হয়ে গোলাপি এক টুকরো আলো যেন ধরে আছে। মণি টেনি খোকন বাচ্চুদের সাথে খেলতে যায় আবার।
বাড়িতে থাকলে সন্ধেবেলা তিন ভাইবোন পড়া করে নিয়ে তাদের বাবাকে ঘিরে বসে। ইংরেজিতে লেখা গ্ৰিম ভাইদের রূপকথা,হান্স আন্ডারসনের ,
গল্প পড়ে মানে করে শোনায় বাবা। পড়ে শোনায় রুশ উপকথা ,জাদুকর পেনসিল ও সর্বকর্মার কাহিনি,কাশতানকা, মুমু,সার্কাসের ছেলে, ভেরা পানোভা এবং ইভান তুর্গেনিভের পিতা ও পুত্র,রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা।শুনে টুনে ইদানিং খাবার টাবার ভাগাভাগির সময় কথায় কথায় 'তারা সাগর তীরে 'গল্পের সংলাপ থেকে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে "সমবায়ের জিনিস, পাবি না আর, যা!"
তার কয়েক মাসের অনুপস্থিতি নিয়ে ছেলেমেয়েদের ভয় ভয় অনিশ্চয়তা যেন আপ্রাণ মুছে দিতে চাইছে তাদের বাবা। কিংবা ছেলেমেয়েদের ছেড়ে থাকতে গিয়ে বাবা আরও বেশি অনুভব করেছিল বিপন্ন এক মায়া। সমস্ত হতাশা কাটিয়ে আবার অন্য রকম স্বপ্ন দেখতে চেয়ে হাতের কাছে পাওয়া কাদা মাটির তাল ছুঁয়ে ছেনে গড়ে তুলতে চাইছিল খুব নিজস্ব এবং প্রিয় কোনো আদল।
বাড়িটা বাচাল ইয়ার্কি দিতে লাগল আগের মতোই।আবার শুরু হলো ফুল ফর্মে দাদাদের তার পেছনে লাগা।দাদামণি প্রায়ই বলে ঝিনিটা বড্ড বাজে কথা বলে। সেদিন কোথাও কিছু নেই,সে এসে পাশে বসেই বলতে লাগল আকাশে সাইকেল চালায় কারা? মাথা খারাপ নাকি তোর? শূন্যে হাঁটা যায় না সাইকেল চালানো যায়? পাখি আর এরোপ্লেনের ডানা আছে তাই উড়তে পারে। তাও কলকব্জা খারাপ হলে উড়োজাহাজও উড়তে পারে না। মাটিতে পড়ে আগুন ধরে যায়।তুই বেশি জানিস? জাদুকর পেনসিলের আঁকা শসা তাহলে উড়ল কি করে? ওটাতো গল্পে বোকারাম ! সত্যি তেমনটা হয় না যে!ঝিনি তাও তক্কো করে; নিজের চোখে পষ্ট দেখলাম সাইকেল চালিয়ে কাল আকাশে পেরিয়ে গেল একটা ছেলে। মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদ পড়ে তার গা চিকচিক করছিল।একটা লোক হেঁটে হেঁটে মেঘের মধ্যে থলি নিয়ে বাজারে যাচ্ছিল তাও দেখেছি রাত্তিরে। তাই বল রাতে দেখেছিস। কাল রাতে ডিম খেলি তো,পেট গরম হয়ে স্বপ্ন দেখেছিস। মোটেও কক্ষোনো আমার পেট গরম হয়নি। তাছাড়া আমি তো মোটে ঘুমোইনি তখনো।দাদামণির কথায় ঝিনি রেগে উঠে বলে বিশ্বাস করছিস না? তোরা রেডিওতে মুরগির খাঁচাতে গানটা শুনছিলি তখন আমিও তো শুনলাম। ঘুমিয়ে কি কেউ শুনতে পায়?
বাহ্ !বাহ্! রেডিওতে কী গান বললি? ঝিনি উৎসাহে গেয়ে উঠল "মুরগির খাঁচাতে তুমি আছো আমি আছি/পাশাপাশি... ঘুরে আসি ..."
মুরগির খাঁচায় গিয়ে ঢুকলি,এতো নিয্যশ ডিম খেয়ে পেট গরম!এ ছাড়া কিছু হতেই পারে না।
তা গান শোনায় বলতে নেই তোর দিনদিন কিন্তু উন্নতি হচ্ছে।এর আগে শুনেছিলি "পেয়াঁজ ফুরুলি দিন/হয়ত চিরদিন /তুমি যখন থাকো নাগো/কাটে নাগো সিম" সেই গানের পর এবার মুরগির খাঁচা?
এরপর ডিমভাজা নয়তো ঝোলের গান নির্ঘাত তুই শুনে ফেলবিই হাসতে হাসতে নিজের পেট চেপে নুয়ে গেল দাদামনি।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কিচ্ছু বিশ্বাস করে না ওরা।খুব ইয়ে। সেদিনকে তো সন্ধেবেলা তার এইসব গান নিয়ে রীতিমত সভা বসে গেল। হাত পা ছুঁড়ে সে যত বলে এরপর রেডিওতে বাজলেই সে সবাইকে শুনিয়ে দেবে তত সবাই হাসে।
যথেষ্ট হয়েছে বলে বাপি শুধু তাকে কোলে বসিয়ে বলে গানটা মন নিয়ে কাছাকাছি.. মুরগির খাঁচাতে নয় মাগো তুমি ভুল শুনেছ। কথাগুলো হলো, মন নিয়ে কাছাকাছি /তুমি আছ আমি আছি
আর পেয়াঁজ ফুরুলি দিন নয় ও গানটা হলো রাত ফুরোলেই দিন/হয়তো চিরদিন/তুমি যখন থাকো নাকো কাটে নাগো সিম না কাটে নাকো দিন...
তবে একথা একেবারেই ঠিক যে আকাশে ঝিনুক মা যা দেখে তা সত্যি। সত্যি? বললেই হলো? কক্ষনো তা নয়।দাদারা ভয়ানক আপত্তি জানায়। ঝিনি যাই বলে তুমি তাতে সায় দাও! সব ওর ফালতু কল্পনা।
বাবা বলে বহু বছর আগে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি হঠাৎ জেগে উঠে টানা দুদিন ধরে রোমের পম্পেই নগরকে গলন্ত লাভা,ছাই ঝামাপাথরে ডুবিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। বিষাক্ত ধোঁয়া আর গ্যাস এতদূর ওপরে উঠে গিয়েছিল শ্বাসরুদ্ধ হয়েও তৎক্ষণাৎ মারা যায় বহু মানুষ।শহরে তখন বাজার বসেছিল। কেনাকাটা করছিল লোকজন,গল্প করছিল,আড্ডা দিচ্ছিল । অতর্কিতে ভূমিকম্প,লাভাস্রোত সবকিছু মিলিয়ে জীবন্ত সমাধি হয় পম্পেই শহরের।কেউ জানত না।বহু বছর পর যখন তা আবিস্কৃত হয় দেখা যায় ছাই আর গরম কাদার স্তরে ছাপ পড়ে গেছে কঙ্কালগুলির। প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে জীবাস্ম ও কঙ্কাল ভরাট করে দিলে কিভাবে কোন ভঙ্গিতে মৃত্যুর আগে তারা ছিল ,বিপর্যয়ের আগের মুহুর্তে কী তারা করছিল জানতে পারে আজকের পৃথিবী।
যা আছে আর যা নেই তার মাঝের সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে কেবল কল্পনা।কত বিজ্ঞানের আবিষ্কার,কত ইতিহাসের সত্যতা কত দর্শন দাঁড়িয়ে আছে মানুষের প্রাথমিক কল্পনার ওপরে।আর ছবি কবিতা নাচ গান,সুর সবেতেই কল্পনাকে ছাড়া একটুও চলে না যে।
ধরো এ হলো ছবি দেখার মতো। চোখের সামনে যা দেখছো তার বাইরেও অনেক কিছু থাকে। কেউ কেউ কল্পনা দিয়ে তাকে ভরাট করে নেয়, ভাবনার তুলিতে নিজের মতো করে ফের রাঙিয়ে নেয় তাকে। শিল্পী যে মন দিয়ে এঁকেছেন আর যে দেখছে তার মনের চোখ যে আলাদা। তোমাদের দেখার সাথে না মিললেও তার অস্তিত্ব আছে ঝিনির মনে।বোন ছোটো তো তাই সে খুব সহজেই কল্পনা আর বাস্তব মিলিয়ে ফ্যালে।
মিছিমিছি আহ্লাদ দেওয়া!দাদারা খুব গজগজ করে।আর তাকে দেখলেই মুরগির খাঁচাতে বা পেঁয়াজ ফুরুলি বলে গান গেয়ে ওঠে । সেই সন্ধে রাত্তিরে কল্পনা আর বাস্তব নিয়ে বলা কথার বেশিটাই ঝিনি বুঝতে পারেনি।পম্পেই নগরীর কথায় শিউরে উঠেছিল বারবার তবু তাদের বাবা অনেক বড় কিছু বলছে যা সে ঠিক মতো না বুঝলেও বড় ইস্কুলের খেলার মস্ত মাঠের কিনারে গাছেদের ছায়া যেখানে নীলচে হয়ে আসা প্রান্তরে মিশে যায়, বাবার কথারা অমন আবছা হয়ে মিশে যায় কোথায় যেন।
দাদারা তাকে বলে বোকারাম! বলে আহ্লাদী পেল্লাদি হাঁদাই কটকটি ঝিনঝিনিয়া হাজিইইইর।
তাও ছড়া পড়তে পড়তে সে যা মনে আসে তাই মিলিয়ে মিলিয়ে বলে। বিস্কুট খেতে খেতে যেই বলেছে বিস্কুট খাই গরম গরম পিস্কুট পাই পরম পরম। আ্যই কী বললি পিস্কুট?মানে বল এক্ষুণি বলে ভুরু কুঁচকে চেঁচায় ছোড়দা। জিভ ভেংচিয়ে দৌড় লাগায় সে।
রোববার সকালে হোম টাস্ক সেরে পড়ার বইখাতা গুছিয়ে ফেলল অরু। মিতু দু'ভায়ের তক্তপোষে গুটিয়ে রাখা তোষক মেঝেতে নামিয়ে খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিল।স্টেজ রেডি।কাজেই গামছা দিয়ে ন্যাজ বানিয়ে খাটের ওপর হনুমান সেজে তারা যাত্রাপালার তাৎক্ষণিক সংলাপ এবং কাল্পনিক গদা হাতে যুদ্ধে নেমে গেল। ঝিনি একটা রোল চাইলেও সব মাটি করে দিবি।যা ভাগ ,বলে তাকে ভাগিয়ে দেয় দুজন।
অভিনয় থেকে তাড়িয়ে দিলেও একমাত্তর দর্শক হয়ে মাঝের ঘরের দোরের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে বিভোর হয়ে দাদাদের অভিনয় দেখছিল এবং তাকে না নিলেও যুদ্ধে বালি যখন সুগ্ৰীবকে পেড়ে ফেলেছে সেই চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে ঝিনি লাফিয়ে খাটে উঠে পালাগানে স্বেচ্ছায় নেমে পড়ল এবং দাদামণির ল্যাজ ধরে টান দিয়ে বলল হনুমানের লেজ তাইতে দিয়ে কেজ। এমন উদ্ভট সংলাপে এবং বালির ল্যাজ খুলে আসায় ভীষণ সিরিয়াস পালা স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে গেল এবং কান ধরে তাকে খাটের স্টেজ থেকে বার করে দেওয়া হলে তাদের বাবা মধ্যস্থতা করতে এল। চমৎকার সংলাপ দিয়েছে তো বোন। ও খালিখালি কোনো মানে নেই এমন সব বকে আর তুমি সব তাতে বলো চমৎকার। এসব চলবে না বাপি, মোটেও শুনবো না আমি তার ওপর আমার ল্যাজটাও নিয়ে গেছে ও।ক্ষেপে গিয়ে অরু ভয়ানক প্রতিবাদ জানায়।
গল্প পড়ে শোনাতে বসে কথা প্রসঙ্গে তাদের বাবা একদিন নানা জনের ছদ্মনাম নিয়ে বলছিল। ভানুসিংহ,বনফুল,যাযাবর মৌমাছি এইসব।ভারি পছন্দ হয়ে গেল ব্যাপারখানা।নিজেও তা'লে নিজের নাম রাখা যায়?
ঝিনির এখন নিজের খাতাও হয়েছে বাড়ি আর ইস্কুলে। একদিন বাড়ির অংকখাতার পাতায় সে ছড়া লিখল ঝাউতলিতে ছিল এক গভীর অরণ্য/সেখানে থাকত কত কী জন্তু বন্য... এবং তলায় লিখে রাখল কেউ জানে না আমার ছদ্ম নাম ভ্রমর। কিন্তু দাদাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াতে পারলে তো! খাতা খুলে ঠিক দেখে নিয়েছে আর হইহই করে লাফিয়ে উঠে সবাইকে জানিয়ে বেদম হাসিঠাট্টায় তাকে কাঁদিয়ে তবে ক্ষান্ত দিয়েছে।
কোনো কিছুতেই দাদাদের ক্ষ্যাপানো আর পেছনে লাগা থেকে নিস্তার নেই।এই কাজে তাদের একতার বন্ধন দেখবার মতো। এখন ঝিনি গড়গড়িয়ে পড়তে পারে যে কোনো বই।মাঝেমধ্যে সে গীতবিতান বা সঞ্চয়িতার যে কোনো পাতা খুলে আপনমনে সুর করে সেগুলো গায়। কিছু কথা না বুঝে মুখস্থ হয়ে গেছে।একদিন খেলনাবাটি ছড়িয়ে বারান্দার কোণে সে নিজের দেয়া এতোলবেতোল উদ্ভট সুরে গাইছিল " আর নাইরে বেলা নামল ছায়া ধরণীতে /এখন চল রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে " ...
ফের ছড়া বানাচ্ছিস? মোটেও বানাইনি,এটা রবি ঠাকুরের বিয়ে আছে। অসম্ভব।হতেই পারে না। দেখবি আছে কিনা বলে গীতবিতান খুলে দেখাতেই বেমালুম বলল হলোই বা রবীন্দ্র সংগীত, এটা তো একটা বাজে গান। সঙ্গে সঙ্গে পোঁ ধরল দাদামনি। ঠিক। এক্কেবারে যা তা।আর কী বিশ্রী চামচিকের মতো সুর বার করেছে ছ্যা ছ্যা ! এই নাকি গান।ওরে পেঁচো নাকি গান বলছে রে!ফলে চ্যাঁ ভ্যাঁ করে সে নালিশ করতে চলল বাবার কাছে।
সে সব খুশি আর মজার মধ্যে গলে মিশে যখন আগেকার ভয়ের দিনগুলো সে ভুলতে বসেছে একেবারে, ঠিক তখনই একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল মা-বাবার কথা শুনতে পেয়ে। বাচ্চারা যেন কিছুতেই জানতে না পারে ওরা ভয় পাবে! এমনিতেই ওদের ওপর দিয়ে একটা ঝড় গেছে; বাপির চাপা গলায় কথাগুলো শুনেই লাফ দিয়ে তার বুকে চড়ে বসল ভয়ের সেই মস্ত লাল ঝুঁটিওলা জন্তুটা,বাবাকে কি আবার নিয়ে যাবে কালো গাড়ি করে?দম বন্ধ হয়ে এলো গলার চারপাশে সেই রাগী জন্তুটার থাবার চাপে।
শুনতে পেলো বাবার অনুনয় ভরা গলা,আর একটু টেনে দাও বিনু, কিছু একটা পেয়ে যাবই।মা কাঁদছিল। সব্বোনেশে রাজনীতিই তোমায় খেলো।চাকরি চলে গেলে এ বয়সে নতুন করে আর কি সম্ভব? দেখছি তো ক'মাস ধরে কত চেষ্টা করছ। উকিলের পেছনে পি এফের লোন,সামান্য সোনাটুকুও তো গেছে। একা আমার মাইনেতে এতগুলো পেট ,বড় হচ্ছে ওরা, লেখাপড়ার খরচ, রুবির মাইনে বাকি ভাবতে পারি না আর।অত ভেবো না। ব্যবস্থা একটা হবেই। ভোলাদাকে লিখেছিলাম। উত্তর পেয়েছি আজ।দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় সুন্দরবনের কাছেই নতুন একটা কলেজ খুলেছে বছর খানেক। ওদের বাংলা বিভাগের অন্তত জনা দুই লাগবে।কিন্তু চাকরির জন্য তুমি যেখানেই যাও ফ্যাকড়া তো তুলবেই।
ফ্যাকড়া মানে কী?এসব কথাই বা ওরা বলছে কেন? তাদের বাবার চাকরি চলে গেছে? বাবা মাইনে পাচ্ছে না? মাইনে মানে তো টাকা। টাকা না হলে রেশন তোলা যায় না, বাজার করা যায় না, কিচ্ছু কেনা যায় না। মা'র কথাগুলো ছম ছম করে মশারির মধ্যে। সমাধানও বার করে,কম করে খেলেই তো হলো। দাদাদেরকেও বলে দিতে হবে।খেলনা জামা ওসব কে চায়?সে শুধু এটুকু ভেবেই নিশ্চিন্ত তাদের বাবাকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে না।
দাদারাও কীভাবে যেন বুঝে গেল।মায়ের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই ফের মুষড়ে পড়ল তাদের বাড়ি।কোনো বায়নাক্কা নেই ,হাসিঠাট্টাতেও মোটে মন নেই তার।
বিকেলে ফুটবলে পাম্প দেওয়া, ব্লাডারে লিক সারানো চলে বটে বাড়ি কিন্তু খুব চুপচাপ। তাদের বাবার ছোটাছুটিও বাড়ছিল যদিও বাড়িতে থাকলে তার গল্প পড়ে শোনানো,গাছ গাছালি,তারা চেনানো সবকিছু আগের মতোই।
সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল খুব। দিন চারেক বাবাও বাড়ি নেই। ঝুড়িতি আলু আর বাগুন ছাড়া কোনো তেউতরকারি নেই কলাম।মা খাতা দেখতে দেখতে ঠোঁট কামড়ালো।চালি ডালি খিচুড়ি রাইন্ধে দেই।কালকির জন্যি কয়ডা আলু আর বাগুন তিনডে রাখে দেবানে কী কও,পরশু সওদা করলিই হবেনে তালি।মাসুয়োওতো ফেরবে কবে কতিছো না। মা মুখ না তুলেই হ্যাঁ বলে দিল।
বাইরে মেঘ ডাকছিল। তার মধ্যেই চেনা গলার আওয়াজ শুনে ঝিনি দৌড় দিল আর দরজা খুলেই দ্যাখে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হাতে একটা গাছের চারা নিয়ে ভিজে চুপচুপে তাদের বাবা দাঁড়িয়ে হাসছে।
ভিজে গেছো তো একদম;শিগগির ভেতরে এসো। মায়ের উদ্বেগ ভরা গলা শুনে বাবা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকেই রুবি মা, আদা দিয়ে কড়া চা বলে দুহাত উঁচু করে বুকের কাছে তুলে সবাইকে দেখালো লতানো গাছটা।
ইনি হলেন চামেলি। আজ একে বারান্দায় রেখে দিই। এ বাড়ির হালচাল আবহাওয়া একটু বুঝে নিক। কাল কাঞ্চন গাছের গোড়ায় মধু মালতির পাশেই একে বসিয়ে দেবো।নিজেরাই ভাবসাব করে কেমন একখানা কুঞ্জ বানাবে দেখো। আসছে বর্ষায় হয়তো ফুটিয়ে দেবে দেদার ফুল। কাপড় জামা ছাড়বে নাকি ভিজে গোবর হয়ে ফুল নিয়ে আদিখ্যেতা চলবে আরও? মায়ের রাগী গলা শুনেও হাসি মুখে ঝোলা থেকে পলিথিন মোড়ানো ফাইলটা বের করল। হাতটা শুকনো গামছায় মুছে একখানা কাগজ বার করে মার দিকে এগিয়ে দিয়েই চান করতে চলে গেল।
কাগজটা পড়েই কেঁদে ফেলল মা। দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের দরজায় গুমগুম করে ধাক্কা দিতেই থাকল। বন থেকে বেরিয়ে এল টিয়েএএএ...সোনার টোপর মাথায় দিয়েএএএ...মাথা মুছতে মুছতে বেসুরো এক গানের সঙ্গে দরজা খুলে বেরোলো তাদের বাবা। মা তাদের বাবার বুকেই গুমগুম গোটা কয়েক কিল বসিয়ে, হেসে কেঁদে আকুল হয়ে গেল। আরে আরে বাইরে এত বৃষ্টি ভেতরেও এত জল ,গামলা বালতি না আনলে এবার তো বানে ভেসে যাব সবাই মিলে।
থামো তুমি। চাকরিটা হয়ে গেছে এতক্ষণ বলোনি কেন? ঝাঁঝিয়ে উঠল মা।হোওওও বলে চেঁচিয়ে উঠল দাদারা। অরু খাট থেকে লাফ দিয়ে মেঝেয় পড়ল। ধিনতা ধিনা বলে মিতু নাচ আর ঢ্যাং ঢ্যাং এক থালা বাজানো আরম্ভ করল।
বুঝলে বিনু এবার তা'লে সোঁদর বনের বাঘ ভাল্লুককে পড়াতে হবে। বাংলা ভাষা তারা বোঝে কিনা জানা নেই এই যা মুশকিল। প্রতি সপ্তায় আসা যাবে না আগের কলেজের মতো।বড্ড যে দূর। তাতে কি ঝিনুক মাকে,অরু মিতুকে, তাদের ছিঁচ কাঁদুনে মাকেও চিঠি লিখব।আর পনেরো দিন বাদে বাদেই হুউউউস করে চলে আসব ব্যাস!
উঠোনে কলকল করে হাসছে জল।পুবের ঘরে টিনের ওপর চালের কোণ বেয়ে জলের মোটা ধারা ধিতাং ঝম ধিতাং ঝম বোল তুলেছে।বারান্দার টালির চালে একটানা ঝিপ ঝিপ বর্ষার রাতে বাবার কোল ঘেঁষে বসে গরম খিচুড়ি আর আলু ভাজা বেগুন ভাজার সাথে অমৃতের কোনো তফাত নেই!
অজস্র জলের কুঁড়িই তো ভরে তোলে ভাতের খামার। সবাইকে নিয়ে মিলে মিশে বেঁচে ওঠার, বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে লেবু ফুলের শাদা লন্ঠন কুপ কুপে অন্ধকার আকাশও ভরে দেয় ভালবাসার মতো শান্ত জোছোনায়।
প্রকাশিতব্য...
0 Comments