জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব-২৪/স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব-২৪


স্বপন কুমার দে

ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ। প্রেমের উৎসব চলেছে সপ্তাহ জুড়ে। প্রনয় উদযাপনের এই সপ্তাহের এক একটি দিন এক একটি আলাদা তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় উৎসাহী তরুণ তরুণীদের মনে। প্রতিদিনই নিত্য নতুন উপহারে ভরিয়ে দিয়ে প্রনয়িনীদের মন পাওয়ার চেষ্টা করে যায় প্রনয় পিপাসুরা। বিশ্বায়নের বিজ্ঞাপনে বিপনন সংস্থাগুলি সুন্দর সুন্দর পসরা নিয়ে হাজির হয় ক্রেতাদের সামনে। এখন থেকে পনের কুড়ি বছর পিছিয়ে গেলে এ সবের নামগন্ধও ছিল না। অথচ,প্রেম ছিল,প্রেমের আবেগ ছিল। আড়ম্বর ছিল না, কিন্তু মনের আকুতি ছিল। আগেকার দিনে সরস্বতী পুজো এবং দোল উৎসবে তা প্রকাশ পেত, অনেক লুকানো প্রেম অনাবৃত হত। সময় পাল্টেছে, অবস্থা পাল্টেছে  এখন তাই অল্পবয়সি থেকে আরম্ভ করে বেশিবয়সিদের মধ্যেও '  ভ্যালেন্টাইনস ডে ' নিয়ে হুল্লোড় আবেগ দেখতে পাওয়া যায়। ছোট খাটো উপহার থেকে শুরু করে দামী হীরের গহনাও উপহার হিসেবে বিক্রি হয়।

স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে যারা কলেজে পড়ছে, তারা অনেকটাই স্বাধীন। এই সময় প্রেম আসে,প্রেম যায়। কিন্তু উৎসবের আড়ম্বর ফিকে হয় না।ক্ষমতা অনুযায়ী উপহার দেওয়া নেওয়া, পার্কে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, সবই হয়। ইউনিভার্সিটির প্রেম অনেকটা পরিণত। এই সময় আবেগটা কমে আসে, ভবিষ্যতের আর্থিক স্বচ্ছলতার নিশ্চয়তার দিকটি মুখ্য হয়। তাই অনেক পুরানো সম্পর্ক ভেঙে যায়, আবার নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এই ক'দিন মল্লিকা ক্লাসে এসে দেখছে এখন ক্লাসের চেয়ে হই হুল্লোড়ই বেশি হচ্ছে। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে মন দেওয়া নেওয়া চলছে। কে, কাকে, কী উপহার দিচ্ছে তার আলোচনা চলছে। ক্লাস করার চেয়ে, ক্লাস কেটে ঘুরে বেড়ানো চলছে। বারান্দায়, সিঁড়িতে, গাছের তলায়, লাইব্রেরির আনাচে কানাচে প্রেম ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুগলেরা কাছাকাছি আসছে। দেখতে দেখতে সপ্তাহটি প্রায় শেষের দিকে। টেডি ডে, চকোলেট ডে, হাগ ডে,  প্রমিস ডে পেরিয়ে অবশেষে এল বহু প্রতীক্ষিত ভ্যালেন্টাইনস ডে। আজ পাখা মেলে উড়বার দিন।

শীত যাব যাব করেও এখনও যায়নি। আত্মীয় বাড়িতে বাড়তি আদর আপ্যায়ণ পেলে যেমন মনে হয় ক'টা থেকে গেলেই ভালো। শীতেরও সেই অবস্থা। আমাদের চাদর, সোয়েটার, টুপি, কোট ইত্যাদি গরম পোশাকের বাহার দেখে শীতেরও বোধহয় ইচ্ছা যায়, 'এসেছি যখন আর কিছুদিন এখানে কাটিয়ে দিয়েই যাই।' সকালটা বেশ শীত শীত ভাব। চাদর অথবা ফুলহাতা সোয়েটার পরতেই হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাপ বাড়ে, তখন মনে হয়না শীত আছে। আবার রাত থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত শীত বিরাজমান।
🍂
মল্লিকা প্রথমে ভেবেছিল, আজ ইউনিভার্সিটি যাবে না। এমনিতেই ক'দিন ধরে ভালো ক্লাস হচ্ছে না, আজ তো একেবারেই হবে না। অন্তত এই ক'দিনের অভিজ্ঞতা তাই বলে দিচ্ছে। এর আগে উইমেন্স কলেজে পড়ার সময় তার এই অভিজ্ঞতা হয়নি। কিন্তু ইউনিভার্সিটি যেহেতু কো-এড্ ,তাই তার ব্যাপার স্যাপার আলাদা। স্টুডেন্টরা যথেষ্ট ম্যাচুয়ের্ড। তাদের জন্য গার্জেনদের সতর্ক দৃষ্টি সজাগ থাকে না। অনেকটা ফ্রি ভাবেই ছেলেমেয়েরা নিজেদের চাওয়া পাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং সাহসও দেখাতে পারে।

মল্লিকা ভাবে নিজের কথা, নিজের ক্যারিয়ারের কথা।জীবনে প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে চায় না। একজন ছাড়া তার অন্য কোনো বন্ধু নেই। আর সেই বন্ধু অভিরূপকে নিয়ে বাড়তি কোনও আবেগ আকর্ষণ নেই। বন্ধুর প্রতি দায়িত্ববোধ আছে কিন্তু আসক্তি নেই। তার ভালোমন্দের সঙ্গী হতে চায়, কিন্তু হিসেবের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই।

মল্লিকার রান্না করা, খাওয়া সকাল দশটার মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। যাবো না, যাবো না করেও কী মনে করে যাওয়ার জন্য তৈরি হল। প্রথমতঃ, সে ভাবল, বাড়িতে বসে, ঘুমিয়ে না থেকে যদি দু'একটা ক্লাসও করা যায় তাও ভালো। তাছাড়া অভির সঙ্গে ফিফথ্ পেপারের কিছু কিছু অংশ একটু আলোচনা করে নিলে ভালোই হত। অন্যেরা হুল্লোড় করুক, ওরা সেই ফাঁকে নিজের টাস্কগুলো বুঝে নিতে পারবে।

মেন গেট দিয়ে ঢোকার পরেই মল্লিকা বুঝতে পারল, আজ ব্যাপারটা অন্যরকম। সেলফি জোনের মত এক একটি গাছতলায় ফটোশ্যুট চলছে। কখনও দু'জনে কখনও গ্রুপের সকলে একসঙ্গে ফটো সেশন। তারমধ্যে দুটি ছেলেমেয়ে গেয়ে উঠল,
" বাতাসে বহিছে প্রেম,..."
এইসব দেখতে দেখতে মল্লিকা ডিপার্টমেন্টে ঢুকে গেল। প্রায় সব স্টুডেন্ট আজ হাজির,তবে এলোমেলো। পারস্পরিক কথাবার্তায় গম্ গম্ করছে চারদিক। সব জটলার টপিক একই, তবে প্রেজেন্টেশন আলাদা আলাদা। মাঝে মাঝে দমকা হাসির আওয়াজ যেন ঘরের দেওয়ালগুলো কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে প্রায় সব গ্রূপেই ঢুঁ মেরে যাচ্ছে, ক্লাসের কথা ভুলেই গেছে।

প্রথম পিরিয়ডটা এভাবেই কাটল। আজ ডি,কে স্যার আসেননি, তাই ফার্স্ট পিরিয়ড হয়নি, পরে শোনা গেল বি এম ম্যাডামও আসেননি। টানা দু'পিরিয়ড ক্লাস চলল। তারই ফাঁকে জানা গেল কে, কাকে প্রপোজ করেছে, কে একসেপ্ট করেছে ইত্যাদি।যাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তারা একই রঙের পোশাক পরে এসেছে। বাকিদের উৎসাহ দিচ্ছে। প্রেমিকের দেওয়া লাল গোলাপ প্রেমিকার খোঁপায় শোভা পাচ্ছে।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার জন্য মল্লিকা বেরিয়ে পড়ল। বাকি সকলে বিভিন্নভাবে সেলিব্রেট করার জন্য তৈরি হল। হয়তো বা পরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মল্লিকা দেখল অভিরূপ তার পিছু নিল। ডাকল," মল্লিকা! দাঁড়া, আমিও যাবো।" মল্লিকা দাঁড়াল, অভিরূপ কাছে আসতেই বলল," কেন, তোর কাউকে পছন্দ হয় না? ওরা কত হই হুল্লোড় করছে। তুইও তো ওদের সাথে যেতে পারতিস।"
" না, আমার ভালো লাগছে না  আমি তোর সঙ্গেই যাবো।"
" আমার সঙ্গে? আয়! তবে আজ আর টিফিন খেতে পারবো না। আমার হাতে সময় নেই। ভাবছি একটা টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরব।"
সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে ওরা দু'জন একসঙ্গেই বেরোল।কিছুটা যাওয়ার পর অভিরূপ ডাকল,' মল্লিকা, শোন।"
" কী "
" তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।"
" কী কথা? বল্।"
দু'জনে সাইকেল থেকে নেমেছে।অভিরূপ নিজের ব্যাগ হাতড়ে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা লাল গোলাপ বের করলো, তারপর মল্লিকার হাতে দিয়ে বলল, " মল্লিকা, আমি তোকে ভালোবাসি।"
অভিরূপের হাত থেকে গোলাপটা নিয়ে নিজের খোঁপায় গুঁজে নিল মল্লিকা। তারপর মৃদু হেসে বলল," তুই যে আমাকে বন্ধু মনে করে আমাকে গোলাপ উপহার দিলি, তাতে আমি খুব খুশি। তবে, আই অলসো লাভ ইউ অ্যাজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। এর বেশি কিছু আশা করিস না অভি,কেননা আমার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমার মধ্যে কোনো প্রেম নেই, আবেগ নেই, রঙিন স্বপ্ন নেই। আমার লড়াই শুধু বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে। আমার ভেতর যে আগুন আমাকে দিন রাত পুড়িয়ে দিচ্ছে তার তাপে গোলাপের পাঁপড়ি শুকিয়ে যাবে। আমার ভেতরের দানবটা আমাকে ঘুমোতে দেয় না, শুধু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।"
অভি অবাক হয়, নিজের অসংযত আচরণের জন্য লজ্জিত হয়। মুখটা নামিয়ে নেয়। ঠিক এই ভয়টাই সে এতদিন করত। কিন্তু এই ক'দিনের চারপাশের ঘটনা তাকে উৎসাহিত করেছিল। তার মনে হয়েছিল মল্লিকাও হয়তো তাকে ভালোবাসে, লজ্জায় কিছু বলতে পারে না। তাই ছেলে হয়ে তারই তো উচিত আগে হাতটা বাড়িয়ে দেওয়া। তাই সে এগিয়েছিল। অনেক লজ্জা, ভয়কে চেপে রেখে দুরু দুরু বুকে মনের কথাটা বলেই ফেলেছিল। কিন্তু এখন মনে হল, না বললেই ভালো হত। কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হয় অভি।
" অভি, আমাকে ভুল বুঝিস না। তুই আগেও যেমন আমার বন্ধু ছিলি, তেমনই বন্ধু থাকবি।" বলে সাইকেলে উঠে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল। অভি কতক্ষণ মুখ নিচু করে তারপর উল্টো দিকের রাস্তা ধরল।

 প্রকাশিতব্য...

Post a Comment

0 Comments