জ্বলদর্চি

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র /সপ্তম পর্ব /প্রসূন কাঞ্জিলাল

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র
সপ্তম  পর্ব 
প্রসূন কাঞ্জিলাল

দুঃশলা

ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর একমাত্র কন্যা দুঃশলা। দুর্যোধনের কনিষ্ঠা বোন সিন্ধুরাজ বৃদ্ধক্ষেত্রের পুত্র জয়দ্রথের সঙ্গে দুঃশলার বিয়ে হয়। দুঃশলা ছাড়াও জয়দ্রথের আরও পত্নী ছিল। জয়দ্রথের ঔরসে ও দুঃশলার গর্ভে এক পুত্রের জন্ম, নাম সুরথ এবং এক মেয়েরও জন্ম, নাম ছিল রোশনি।

দুঃশলা কৌরববংশের রাজকন্যা কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বা দুর্যোধনদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়নি কোথাও। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে দুঃশলা জয়দ্রথের পাণিপ্রার্থী হতে না চাইলেও তাকে জোর করেই অনেকটা জয়দ্রথের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়।

দুঃশলার শেষ পরিণতি ভয়াবহ। কারণ জয়দ্রথের চরিত্র-আচার-আচরণ কোনোটাই সুবিধাজনক ছিল না। বনপর্বে পাণ্ডবরা যখন কাম্যক বনে অবস্থান করছিল, তখন বিয়ের উদ্দেশ্যে সেই বনের মধ্যে দিয়ে জয়দ্রথ শাল্বরাজ্যে গমনরত অবস্থায় দ্রৌপদীকে দেখে। জয়দ্রথের কামনা জাগে। পাণ্ডবরাও আশ্রমে অনুপস্থিত ছিল। সে সুযোগেই জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করার চেষ্টা করে। জয়দ্রথের এরূপ অশুভ আচরণে দ্রৌপদী ক্ষিপ্ত হলেও জয়দ্রথের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায় না। বরং দ্বিগুণ বেগে দ্রৌপদীকে টেনেহিঁচড়ে রথে তুলতে চেষ্টা করে। এই সময় পাণ্ডরা সব ঘটনা জেনে আশ্রমে ফিরে আসে। জয়দ্রথের পশ্চাদ্ধাবন করে। জয়দ্রথের সৈন্যরা পরাস্ত ও নিহত হওয়ার পর দ্রৌপদীকে রথ থেকে নামিয়ে দিয়ে স্থান পরিত্যাগের চেষ্টা করে জয়দ্রথ। ভীম ও অর্জুন তার পশ্চাদ্ধাবন করে তাকে ধরে ফেলে। যেহেতু দুঃশলা পাণ্ডবদের বোন, সেহেতু যুধিষ্ঠির তাকে ক্ষমা করে দেয়। দাসত্ব থেকেও মুক্তি দেয়।

জয়দ্রথের এমন হীনকর্মেও নিষ্ক্রিয় দুঃশলা। তবে মহাভারতের নারী চরিত্রগুলো দেখলে মনে হয়, প্রত্যেকটি চরিত্র একেকটি পুতুল। চরিত্রগুলোকে যতটুকু উপস্থিত করা উচিত, তার বাইরে একচুলও বিস্তৃত করেননি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। তবে এই যতটুকুর মধ্যেও যথেষ্ট ঘাটতি। কারণ এর আগেও মহাভারতের কিছু বিশেষ চরিত্র দেখানো হয়েছে, সেখানে রাজদরবারে তাদের কিছু কিছু বিচরণ দেখা যায়। কিন্তু দুঃশলা কৌরবব বংশের একমাত্র রাজকন্যা হওয়া সত্ত্বেও তাকে নীরব থাকতে দেখা যায়।

আবার জয়দ্রথের এমন অশোভন আচরণে দুঃশলা কতটা মনক্ষুণ্ন বা আসলেই পক্ষে না বিপক্ষে, তারও ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। দুঃশলা যেহেতু হস্তিনাপুরের একমাত্র রাজকন্যা, সেহেতু তার বেড়ে ওঠা এবং রাজদরবারে,পিতা ধৃতরাষ্ট্র, মাতা গান্ধারীর কাছে আলাদা সম্মান-মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়া কথা। 

যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে দুঃশলার স্বামী জয়দ্রথ মহাদেবের তপস্যায় রত হয়। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেবের কাছে বর চায়। অর্জুন ভিন্ন সমস্ত পাণ্ডবকে অন্তত একদিনের জন্যও জয় করতে পারার বর লাভ করে। ফলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রোণাচার্য যে চক্রব্যূহ নির্মাণ করে, তার ব্যূহদ্বার রক্ষকরূপে চার পাণ্ডবকে সে পরাজিত করে। ওই ঘটনায় অভিমন্যু নিহত হয়। অর্জুন শিবিরে প্রস্থান করে জয়দ্রথকে মুণ্ডচ্ছেদ করেন। জয়দ্রথের নিহত হওয়ায় দুঃশলার মনের অবস্থা কী হয়েছিল, সে-সম্পর্কে তেমন কোনো ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়নি। পিতা ধৃতরাষ্ট্র, মাতা গান্ধারীর পক্ষ থেকেও মেয়ের দুর্দশাকে কেন্দ্র কোনোরূপ বিকার দেখা যায়নি। বরং শতপুত্রের মৃত্যুতে গান্ধারীকে দেখা গেছে কৃষ্ণকে অভিশাপ দিতে। তবে দুঃশলাকে নিয়ে স্বয়ং লেখকও কোনো সহানুভূতি সৃষ্টি করেননি। 

দুঃশলার পুত্র সুরথও মহাভারতের যুদ্ধে নিহত হয়। সুরথের নাবালক পুত্র তখন রাজ্যাভিষিক্ত হয়।অপর মতে আবার , অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়, পাণ্ডবদের ঘোড়া সিন্ধুতে এসেছিল, যা তখন শাসিত হচ্ছিল দুঃশলা পুত্র সুরথ কর্তৃক। অর্জুনের সাথে লড়াই করার সম্ভাবনা দেখে আতঙ্কিত সুরথ আত্মহত্যা করে। দুঃশলা এরপর যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন, এবং সুরথের শিশু পুত্রকে নিয়ে কাঁদছিলেন, যা অর্জুনের হৃদয় ভেঙে দেয়। অর্জুন শিশুটিকে সিন্ধুর রাজা ঘোষণা করলেন।

মহাভারত জাত মহাকাব্যের কলেবর যত বেড়েছে, পুরুষ চরিত্রের পরাক্রমশালী বর্ণনাও তত বেড়েছে। কিন্তু নারীদের হাহাকার, মর্যাদা, সম্মান; কোনো কিছুরই যে শেষ রক্ষা হয়নি, তা মহাভারতের পাতায় পাতায় প্রমাণিত হয়েছে। দ্রৌপদীর অপমান, গান্ধারীকে আজীবন অন্ধত্ব বরণ, মাদ্রীর মৃত্যু, সত্যবতীর দুর্ভাগ্য, কুন্তীর হাহাকার, দুঃশলা, রাধা, সত্যভামা প্রভৃতি সব চরিত্র যেন তলিয়ে গেছে পুরুষের তর্জন-গর্জনে।নারীদের হৃদয়কেও যেন লুটিয়ে দেওয়া হয়েছে যুদ্ধের আবহ তৈরি করতে! দুঃশলাও ভাগ্যের সেই নির্মম পরিণতির শিকার ।।

কৌরব 

রাজা কুরুর বংশধর, বিশেষভাবে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ কৌরব নামে পরিচিত হতেন।
 
মহারাজ সংবরণ ও সূর্যকন্যা তপতীর পুত্র ছিলেন কুরু। রাজা কুরুর বংশধরদের কৌরব বলা হয় । কিন্তু মহাভারতে বিশেষভাবে দুর্যোধন এবং তার একশত ভাইকে কৌরব আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাদের পক্ষকে কৌরবপক্ষ বলা হয়েছে।

কৌরবদের তালিকা -- 

এখানে কৌরবদের নামের তালিকা সর্বাগ্রজ থেকে সর্বানুজ অনুযায়ী সাজানো হলো। 


১) দুর্যোধন ২) যুযুৎসু (গান্ধারীর দাসী সুগদার পুত্র) ৩) দুঃশাসন ৪) দুঃসহ ৫) দুঃশলা ৬) জলসন্ধ ৭) সাম ৮) সহ ৯) বিন্দ ১০) অনুবিন্দ ১১) দুর্ধর্ষ ১২) সুবাহু ১৩) দুষ্প্রদর্শন ১৪) দুর্মর্ষণ ১৫) দুর্মুখ ১৬) দুষ্কর্ম ১৭) বিম্ব ২৮) বিভিমশতি ১৯) বিকর্ণ ২০) সুলোচন ২১) চিত্রা ২২) উপচিত্রা ২৩) চিত্রাক্ষ ২৪) চারুচিত্র ২৫) শরাসন ২৬) দুর্মদা ২৭) দুষ্প্রগাহ ২৮) বিভিৎসু ২৯) বিকাত ৩০) উর্ণনাভ ৩১) সুনাভ ৩২) নন্দ ৩৩) উপনন্দক ৩৪) সেনাপতি ৩৫) সুশেনা ৩৬) কুন্দোদর ৩৭) মহোদর ৩৮) চিত্রবন ৩৯) চিত্রবর্মা ৪০) সুবর্মা ৪১) দুর্বিমোচন ৪২) অয়োবাহু ৪৩) মহাবাহু ৪৪) চিত্রাঙ্গ ৪৫) চিত্রকুণ্ডলা ৪৬) ভীমবেগ ৪৭) ভীমবালা ৪৮) বলাকি ৪৯) বলবর্ধন ৫০) উগ্রায়ুধ ৫১) ভীমকর্মা ৫২) কনাকায়ু ৫৩) দ্রিধায়ুধ ৫৪) দ্রিধাবর্মা ৫৫) দ্রিধাক্ষত্র ৫৬) সোমকীর্তি ৫৭) অনুদর ৫৮) দ্রিধাসন্ধ ৫৯) চিত্রসেন ৬০) সত্যসন্ধ ৬১) সাধঃসুবক ৬২) উগ্রশ্রব ৬৩) অশ্বসেন ৬৪) সেনানী ৬৫) দুষ্পরাজয় ৬৬) অপরাজিত ৬৭) পণ্ডিতকে ৬৮) বিশালাক্ষ ৬৯) দুর্বর ৭০) দ্রিধাহস্ত ৭১) সুহস্ত ৭২) বটবেগ ৭৩) সুবর্চ ৭৪) আদিত্যকেতু ৭৫) বাহঃবশী ৭৬) নাগদন্ত ৭৭) উগ্রায়ি ৭৮) কবাচি ৭৯) নিশাঙ্গী ৮০) পাশী ৮১) দণ্ডধারা ৮২) ধনুর্গ্রহ ৮৩) উগ্র ৮৪) ভীমরথ ৮৫) বীর ৮৬) বীরবাহু ৮৭) অলোলুপা ৮৮) অভয় ৮৯) রৌদ্রকর্ম ৯০) দ্রিধারথ ৯১) অনাদৃশ্য ৯২) কুণ্ডভেদী ৯৩) ভৈরবী ৯৪) দীর্ঘলোচন ৯৫) দীর্ঘবাহু ৯৬) মহাবাহু ৯৭) ভূধোরু ৯৮) কনকধ্বজা ৯৯) কুন্ডশী ১০০) বিরাজ ১০১) দীর্ঘরোম  ও ১০২) প্রমতি

একটি মজার তথ্য --- 

যুধিষ্ঠির একান্তে সবসময়  দুর্যোধনকে  "সুযোধন"  এই নামেই ডাকতেন।।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments