জ্বলদর্চি

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র/অষ্টম পর্ব /প্রসূন কাঞ্জিলাল


মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র
অষ্টম  পর্ব 

প্রসূন কাঞ্জিলাল

যক্ষপ্রশ্ন 

যক্ষ নিজেকে মৃত্যুর দেবতা যম অথবা ধর্ম হিসাবে প্রকাশ করেছিলেন যিনি যুধিষ্ঠিরের পিতাও ছিলেন। তিনি জানালেন যে তিনিই হরিণের ছদ্মবেশে অরণি চুরি করেছিলেন।

এখানে ‘যক্ষপ্রশ্ন’ অংশটি মহাভারত এর বনপর্ব এর অন্তর্গত। এটি ছদ্মবেশী যমের সঙ্গে পাণ্ডবাগ্রজ যুধিষ্ঠিরের একটি কথোপকথন। যম যক্ষের রূপ ধরে এসে যুধিষ্ঠিরকে কতগুলি অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির খুব সংক্ষেপে ধর্মের কয়েকটি গূঢ় তত্ত্ব বর্ণনা করেন।

যক্ষ বললেন –

 ১) কিভাবে কোনো ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে পারে ? 
২) কিভাবে সে মহৎ হতে পারে ? 
৩) কিভাবে সে অদ্বিতীয় হতে পারে ? এবং, হে রাজা, 
৪) কিভাবে সে বুদ্ধিমান হতে পারে ?

যুধিষ্ঠির বললেন –

১) বেদ অধ্যয়ন করে একজন ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
২)সাধুসুলভ ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে সে মহৎ হতে পারে। 
৩)সাহস অবলম্বন করে সে অদ্বিতীয় হতে পারে। এবং
 ৪) গুরুজনের সেবা করে সে বুদ্ধিমান হতে পারে।

(শ্লোকসংখ্যা ৪৭-৪৮)

যক্ষ বললেন–

৫) ব্রাহ্মণদের দেবত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় কিসে ?
 ৬)ব্রাহ্মণের গুণ কী ?
৭) ব্রাহ্মণদের মানুষ-সুলভ বৈশিষ্ট্য কী ?
৮) এবং ব্রাহ্মণদের দোষ কী ?

যুধিষ্ঠির বললেন–

৫) বেদ অধ্যয়ন ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেবত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
৬) ব্রহ্মচর্য ব্রাহ্মণের গুণ। 
৭) নশ্বরতা ব্রাহ্মণের মানুষ-সুলভ বৈশিষ্ট্য।
৮) নিন্দাবাদ করা ব্রাহ্মণের দোষ।

(শ্লোকসংখ্যা ৪৯-৫০)


যক্ষ বললেন–

৯);কে পৃথিবীর চেয়েও ভারী ?
১০);কে স্বর্গের চেয়েও উঁচু ? 
১১) কে বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী ? 
১২) ঘাসের চেয়েও সংখ্যায় বেশি কী ?

যুধিষ্ঠির বললেন –

৯) মা পৃথিবীর চেয়েও ভারী। 
১০) বাবা স্বর্গের চেয়েও উঁচু। 
১১) মন বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী। 
১২) দুশ্চিন্তা ঘাসের চেয়েও সংখ্যায় বেশি।

(শ্লোকসংখ্যা ৫৯-৬০)


যক্ষ বললেন–

১৩) ধর্মের সর্বোচ্চ আশ্রয় কী ?
১৪) খ্যাতির সর্বোচ্চ আশ্রয় কী ? 
১৫) স্বর্গের সর্বোচ্চ আশ্রয় কী ? 
১৬) সুখের সর্বোচ্চ আশ্রয় কী ?


যুধিষ্ঠির বললেন–

১৩) ঔদার্য ধর্মের সর্বোচ্চ আশ্রয়। 
১৪) উপহার খ্যাতির সর্বোচ্চ আশ্রয়।
১৫) সত্য স্বর্গের সর্বোচ্চ আশ্রয়। 
১৬) সৎ কাজ সুখের সর্বোচ্চ আশ্রয়।

(শ্লোকসংখ্যা ৬৯-৭০)


যক্ষ বললেন–

১৭) সকল প্রশংসনীয় বস্তুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রশংসনীয় কোনটি ?
 ১৮);সকল ধনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধন কোনটি ?
১৯); সকল প্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি কোনটি ?
২০)  সকল সুখের শ্রেষ্ঠ সুখ কোনটি ?


যুধিষ্ঠির বললেন–

১৭) দক্ষতা সকল প্রশংসনীয় বস্তুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রশংসনীয়।
 ১৮) বিদ্যা সকল ধনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধন।
 ১৯) সুস্বাস্থ্য সকল প্রাপ্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
২০)  সন্তুষ্টি সকল সুখের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুখ।

(শ্লোকসংখ্যা ৭৩-৭৪)


যক্ষ বললেন–

২১) পৃথিবীতে পরম ধর্ম কী ?
কোন গুণটি সর্বদাই ২২) ফল দেয় ? 
২৩) কাকে নিয়ন্ত্রণ করলে অনুশোচনা করতে হয় না ?
২৪) এবং কার সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হয় না ?


যুধিষ্ঠির বললেন–

২১) আঘাত না করাই পরম ধর্ম। 
২২) তিন বেদে উক্ত ক্রিয়াকর্ম সর্বদাই
ফল দেয়। 
২৩) মনকে নিয়ন্ত্রণ করলে অনুশোচনা করতে হয় না। এবং 
২৪) ভাল লোকের সঙ্গ কখনও ত্যাগ করতে হয় না।

(শ্লোকসংখ্যা ৭৫-৭৬)


যক্ষ বললেন–

২৫) কোন শত্রু অপরাজেয় ? 
২৬) কী মানুষের মধ্যে দুরারোগ্য রোগের জন্ম দেয় ? 
২৭) কাকে সৎ ও কাকে অসৎ মানুষ বলা হয় ?


যুধিষ্ঠির বললেন–

২৫) রাগ হল অপরাজেয় শত্রু। 
২৬) কামুকতা মানুষের মধ্যে দুরারোগ্য
রোগ স্থাপন করে। 
২৭) যে লোক সকলের মঙ্গল চায়, সেই সৎ; যে নির্দয় সেই অসৎ।

(শ্লোকসংখ্যা ৯১-৯২)


যক্ষ বললেন–

২৮) হে রাজা, মোহ কী ? 
২৯);গর্ব কী ? 
৩০) আলস্যের থেকে কী জানা যায় ?
৩১) শোকের থেকে কী প্রকাশ পায় ?


যুধিষ্ঠির বললেন–

২৮)  নিজের কর্তব্যকে না জানার নাম মোহ।
 ২৯) নিজের কথা বেশি ভাবাই গর্ব। 
৩০) নিজের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন না করাই আলস্য। 
৩১) অজ্ঞানই শোক।


(শ্লোকসংখ্যা ৯৩-৯৪)


যক্ষ বললেন–


৩২) ঋষিরা কাকে স্থৈর্য বলেছেন ? 
৩৩) সাহস কী ? 
৩৪) স্নান কোনটি ? 
৩৫) কী দান নামে পরিচিত ?


যুধিষ্ঠির বললেন–

৩২) নিজ কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করার নামই স্থৈর্য।
৩৩) ইন্দ্রিয়জয়ই সত্যকারের সাহস।
৩৪) মন থেকে সব কলুষ ধুয়ে ফেলার নামই স্নান। 
৩৫) সকল জীবকে রক্ষা করাই দান।

(শ্লোকসংখ্যা ৯৫-৯৬)


যক্ষ বললেন–

৩৬) হে রাজা, জন্ম, কাজ, অধ্যয়ন বা শাস্ত্রপাঠ - শ্রবণ–এর মধ্যে কোনটির দ্বারা কোনো ব্যক্তি ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করতে পারে ?


যুধিষ্ঠির বললেন–


৩৬) হে যক্ষ, শোনো! জন্ম, অধ্যয়ন বা শাস্ত্রপাঠ - শ্রবণ–কোনোটিই ব্রাহ্মণত্ব লাভের পন্থা নয়।

নিঃসন্দেহে বলা চলে, কাজের মাধ্যমেই মানুষ ব্রাহ্মণ হতে পারে।

(শ্লোকসংখ্যা ১০৭ - ১০৮)

তর্কের মাধ্যমে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না শ্রুতিশাস্ত্রগুলিও পরস্পরবিরোধী। এমন একজন ঋষিও নেই যাঁর কথা সবাই মেনে নেয়। ধর্মের তত্ত্ব গুহায় নিহিত। তাই মহান ব্যক্তিগণ যে পথে চলেন, সেই পথই ধর্মের পথ ।।

( ক্রমশ) 
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments