পর্ব ৫
রোশেনারা খান
ঢাকাতে কয়েকটা দিন থাকার কথা ছিল, কিন্তু আগে থেকে হোটেল বুক না করার জন্য আর অত্যধিক গরমের কারণে সবাই সময় সংক্ষেপ করতে চাইছেন।তাই আমরা আগামিকাল রাতে লঞ্চে ঢাকা থেকে বরিশাল যাত্রা করব।আমাদের সঙ্গে হুমায়ুন সাহেবও যাবেন। ওনার আদি বাড়ি বরিসালে। আমরা ঢাকা শহর বেড়াতে বের হলাম। চারটে রিক্সাতে আমরা প্রথমেই গেলাম রমনার মাঠে, যেখানে ভাষা শহিদদের স্মৃতিস্থম্ভ রয়েছে। তখন আমার সঙ্গে অঙ্কনা ছিল।আমরা এক রিক্সায় এসেছি বলে। আমরা শহিদ বেদীর দিকে এগিয়ে গেলাম।মনে মনে ভাবছি, সত্যিই এখানে এসেছি তো? নাকি স্বপ্ন দেখছি? স্যান্ডেল পরে বেদীর সিঁড়িতে পা রাখতে কুণ্ঠা বোধ করছিলাম।সবাই দেখছি জুতো পরেই বেদীর ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদেরও স্যান্ডেল খোলার সাহস হলনা। ফোনের মত স্যান্ডেলও যদি চুরি হয়ে যায়! ভাবনা থেকে বেরিয়ে শহিদ বেদীতে পা রাখলাম। ফোন নেই কীসে ছবি তুলব? ইতিমধ্যে সাহাদাতদা, সেরিনা, গৌতম মণ্ডল এসে পৌঁছেছেন। এর ওর ক্যামেরা থেকে কিছু ছবি তুললাম। আমার পছন্দের ছবি হলনা। এদিকে মায়াদি আর সরস্বতীদিদের নিয়ে রিক্সা অন্য কোথায় চলে গেছে। সবাই চিন্তায় পড়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ওনারা এসে পৌঁছালেন।
এখান থেকে বেরিয়ে আমরা বাংলা একাডেমী গেলাম।অনেকক্ষণ সন্ধ্যা নেমেছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্তরে মসজিদের পাশে নজরুলের সমাধিটি দেখতে গেলাম। ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’। কবির এই ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মসজিদের পাশে যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।কোন একটি ঘটনার কারণে নজরুলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিষেধ ছিল। মরণের পরে সেখানেই তাঁর শেষ শয্যা পাতা হয়।দুর্ভাগ্যবশত সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়াতে আমরা ভিতরে ঢুকতে পারিনি। গেটে তালা পড়ে গেছল। বাইরে থেকেই আমরা ছবি তুললাম। আগামিকাল আর আসার সুযোগ হবে বলে মনে হয় না।আমরা আরও কিছু জায়গা ঘুরে পাঠক সমাবেশে ঢুকলাম। বই দেখে মনটা ভরে গেল। আনেক বই কিনতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বহন করা মুশকিল, তাই দু’খানা মাত্র বই কিনলাম। ওঁরা আমাদের চা পরিবেশন করে আপ্যায়ন করলেন। ওখান থেকে বেরিয়ে মেট্রো ধরলাম।আসার সময়ও মেট্রোতে এসে ছিলাম।এঁদের শিষ্টাচার সব যায়গাতেই মুগ্ধ করেছে।আসার সময়ও মেট্রোতে কয়েকজন তরুণ সিট ছেড়ে দিয়েছিল্, এখনও কয়েকজন সিট ছেড়ে দিল। কলকাতায় আমার অন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
আমরা মেট্রো থেকে নেমে এক জায়গায় ডিনারের জন্য ঢুকলাম। কিন্তু খাবার বিশেষ কিছু ছিলনা। গেস্ট হাউসে ফিরে ভেবেছিলাম শান্তিতে ঘুমাব।কিন্তু তা হলনা। এঁদের একটিমাত্র AC রুম ছিল,অতিরিক্ত চার্জ দিয়ে আমি সেটি নিয়ে ছিলাম।কিন্তু রুম ঠাণ্ডা হচ্ছে না। কী আর করা যাবে? কোন ভাবে রাত টা কাটালাম।সকালে হুমায়ুন সাহেব এলেন। উনি আমাদের শাড়ির মার্কেটে নিয়ে গেলেন।কম বেশি আমরা সবাই শাড়ি কিনলাম। গেস্ট হাউসে ফিরে স্নান করে নিছে লাঞ্চ করতে নামলাম। এখনে আমাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে। খুব ভাল খেলাম। সব যায়গাতেই দেখছি ভাতের সঙ্গে একটা ভর্তা থাকছেই।আজ আছে ঢ্যাঁড়শ ভর্তা, খেতে মন্দ লাগল না। আসলে ভাত, বিরিয়ানি, পোলাও যাই হোক না কেন, কাঁচা পেঁয়াজ ছাড়া খাওয়া জমে না। ভর্তাতে তো কাঁচা পেঁয়াজ ছিলই। পাতেও কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে ছিল।
খাওয়ার পর একটু রেস্ট নিয়ে লাগেজ গুছিয়ে ‘পরিবাগ’ যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম, ওখানে ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’ তে ‘পদক্ষেপ’ এর বৈশাখী কবিতা পাঠ ও আলোচনা সভা রয়েছে। আমরা সেখানে আমন্ত্রিত।এখান থেকেই আমরা ফেরিঘাট চলে যাব।তাই লাগেজ সঙ্গে নিয়েই বের হতে হল। ওখানে পৌঁছে কোন একটা কারণে হল চেঞ্চ করতে হল। এখান নামী কয়েকজন মানুষের সঙ্গে সাকিল আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।মাফিদা আকবর নামে এক গুণী ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল।একটু পরে এসে হাজির হলেন শেখ সাইদ ফারসী,ইনি একাধারে নজরুল গবেষক, ‘অগ্নিবীণা’সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সদস্য। ‘কবি সংসদ বাংলাদে্শ’এর প্রকাশনা সম্পাদক ও মানবাধিকার সংস্থার সক্রিয় কর্মী। এছাড়াও তিনি বেতার ও টিভির সুরকার ও গীতিকার।গোলাম কিব্রিয়া পিনা(Phd) একজন লেখক ও কবি।বিমল গুহ(Phd),ইনি প্রিন্টিং ও পাবলিকেশনের সঙ্গে যুক্ত একজন পণ্ডিত মানুষ। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আমিনা ও শ্রাবন্তী এল সঙ্গে আরও দুজন ভদ্রমহিলা। আমার পাশে বসে আমিনা ওঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। একজন বললেন, ‘এতক্ষণ গাড়িতে আমিনার কাছে আপনার কথাই শুনছিলাম’।আমিনা আমার জন্য একটি খদ্দরের শাড়ি নিয়ে এসেছে যার আঁচল জুড়ে রয়েছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ছবি।ও বলল, আপনি পরবেন কিনা জানিনা,আপনাকে দেবার জন্য এটাই আমার সঠিক উপহার মনে হল।আমি এত খুশি হয়েছি যে কি বলব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।ও শারিটি আমার গলায় পরিয়ে দিল। আমি ওকে কথা দিলাম, শাড়িটি আমি স্বাধীনতা দিবসের দিন পরব।
আমাকে কিছু বলতে বলা হলে আমার পরিচয় দিয়ে কিছু কথা বললাম এবং দুটি স্বরচিত কবিতা পরলাম।সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন। অনেক ছবি তোলা হল।সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আমার কার্ড নিলেন এবং নিজেদের কার্ড দিলেন।মাহফিদা আকবর কাছে এসে বললেন, আপনার ফোন নাম্বারটা দিন, আপনার সঙ্গে আমার জীবনের অনেক মিল আছে। বিমল গুহ মহাশয় বক্তব্য রাখার সময় বললেন, ‘রোশেনারার কবিতা শুনতে শুনতে চোখে জল এসে গেছল। আমরাও লিখি কিন্তু এত আবেগ থাকে না সে লেখায়’।যাইহোক, আমাদের ফেরার তাড়া ছিল, অল্প সময়ের মধ্যে এক সাহিত্যপ্রেমী ভদ্রলোক আমাদের সকলের জন্য টিফিনের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং পদক্ষেপ এর পক্ষ থেকে আমাদের সবার হাতে স্বারক তুলে দেওয়া হয়। আমিনা ওর গাড়িতে করে আমাদের লঞ্চঘাটে পৌঁছে দেয়। মনে একটা আফসোস থেকে গেল, ঢাকার তেমন কিছুই দেখা হল না। পরের বার বাংলাদেশ আসব শুধু ঢাকা দেখার জন্য। বিশেষভাবে উল্লেক্ষিত দ্রষ্টব্যগুলির কিছুই দেখা হল না। পরে আবার আসার আশা রেখে একখানা ব্যগ আমিনার কাছে রেখে যাচ্ছি। আমার স্যুটকেশে আর জায়গা নেই। আমিনাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। অন্তত ব্যাগের সুত্রে আরও একবর দেখা হওয়ার সুযোগ জিইয়ে রাখলাম। এখানে প্রত্যেকের ব্যবহার খুবই আন্তরিকতা পূর্ণ, যা ভোলার নয়।
ক্রমশ
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments