মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১৬
রামকুমার মান্না (টেরাকোটা শিল্পী, খেজুরী)
ভাস্করব্রত পতি
১৯৬০ সালে খেজুরীর কামারদা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রাধাশ্যাম মান্না এবং কাত্যায়নী মান্নার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। বাড়িতে দারিদ্র্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই সবকিছুই তখন এলোমেলো। স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি হলেন গ্রামের স্কুলে। এরপর কামারদা জুনিয়র হাইস্কুলে পঠনপাঠন শুরু। কিন্তু বিধি বাম। নবম শ্রেণীর দোরগোড়া থেকে পড়াশোনায় টানলেন ইতি। কিন্তু এই গেঁয়ো ছেলের সখ্যতা যে মাটির সাথে। একদিকে জঠরানল, অন্যদিকে মাটি নিয়ে মাতামাতি।
পেটের তাগিদে খেজুরী ছাড়লেন। চললেন কল্লোলিনী কলকাতা। লক্ষ্য একটা কাজের জোগাড় করা। সেখানে গিয়ে আলাপ হল এক পরিচালকের সঙ্গে। সেখানেই নিযুক্ত হলেন বাড়ির ফাইফরমাস খাটার জন্য। যৎসামান্য বেতন। আর বাড়ির কাজের ফাঁকে তাঁর 'অন্যরকম কাজ'। আসলে রামকুমার তাঁর সুদূর শৈশবে মাটিকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে তোলার যে কাজ শুরু করেছিলেন তাইই তাঁকে ধীরে ধীরে একজন অসাধারণ শিল্পীতে পরিণত করে তুলেছে। এককথায় শিল্পের রূপায়নের লৌকিক রীতিতে তাঁর স্বচ্ছন্দ অধিকার তৈরি হয়েছে।
রামকুমার মান্নার হাতের কাজ
সেখানেই আলাপ হল বহু দিকপালের সঙ্গে। তাঁর শিল্পসুষমামণ্ডিত কাজের রকমফের দেখতে পেয়ে যৎপরোনাস্তি অবাক সবাই। তাঁদের মনে হল, উচ্চশিক্ষাহীন এহেন ছোকরার যদি শিল্পের ব্যকরণ সম্পর্কে ধারণা থাকতো, তবে তাঁর কাজের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেতো বহুগুণ। এজন্য দরকার সঠিক শিক্ষা। সেইসব শহুরে বাবুরা ছোট্ট রামকুমারকে ভর্তি করে দিলেন স্থানীয় এক শিল্পকলা চর্চাকেন্দ্র 'গান্ধর্বী'তে। যদিও এই একঘেঁয়েমি শিক্ষা তাঁর ভালো লাগেনি। বন্ধ করলেন যাওয়া। কেউ কেউ তাঁকে ট্র্যাডিশনাল ফর্মের জিনিস গড়তে উৎসাহিত করল। কিন্তু তিনি তা চাননা। নিজের সৃষ্টির ইচ্ছেডানা কে চাগিয়ে রাখতে পরিচারকের কাজ ছেড়ে দিয়ে বেছে নিলেন অনিশ্চিত জীবন।
সস্ত্রীক রামকুমার মান্না
কখনো ফুটপাতে, কখনো অন্য কোথাও কাটাতে লাগলেন রাত। শুরু করলেন গৃহ সাজানোর টেরাকোটা সামগ্রী হিসেবে নানা জীবজন্তু, প্যাঁচা, ফুলদানি তৈরি করে কালীঘাটের কুমোরপাড়ায় সেসব পুড়িয়ে বিক্রি করা। যদিও এসবের খদ্দের তেমন জোটেনি। টেরাকোটার সামগ্রীর চাহিদা তেমন তৈরি হয়নি তখন। ধীরে ধীরে পায়ের তলায় একটু মাটি পেতেই ছেড়ে দিলেন এই কাজ। শুরু করলেন নতুন ধারার কাজ।
নিজেকে সঁপে দিলেন নতুন নতুন সৃষ্টির কাজে। এলো সাফল্য, এলো যশ। টেরাকোটা শিল্পের অঢেল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেল তাঁর জীবনে। নিজের শিল্পকলা নিয়ে হাজির হলেন বিভিন্ন প্রদর্শন শালায়। সেখানে অচিরেই নজর কেড়ে নিলেন শিল্প বোদ্ধাদের। ১৯৮৫ সালে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে প্রথম একক প্রদর্শনী করলেন। বিষয় ছিল ২০ টি শিশু। পেলেন সাফল্য। এরপর একাধিক প্রদর্শন করতে লাগলেন দেশে ও বিদেশে।
খেজুরীর গবেষক ড. প্রবালকান্তি হাজরার সাথে রামকুমার মান্না
রামকুমার মান্নার বাবা পাঁজি ধরে শুভক্ষন মানতেন। ছেলেকেও বলতেন তা মেনে চলার জন্য। তাই আজও শিল্পী রামকুমার মান্না যখন নতুন কাজে হাত দেন, তখন তিনি এই মহেন্দ্রযোগ, অমৃতযোগ মেনে কাজ শুরু করেন। এই সংস্কার মেনে চলেন তিনি। শুধু তিনি নন, তাঁর স্ত্রীর টেরাকোটা ভাস্কর্যও দেখার মতো। লোকায়ত ভঙ্গিতে মা মেয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছে। গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবনের অনবদ্য রূপ ফুটিয়ে তোলেন তিনি। কোথাও কুলো নিয়ে চাল পাছড়ানো, আবার কোথাও দুহাত গালে দিয়ে বসে থাকা ঘোমটার বৌটি।
১৯৮৬ তে চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে পরপর দুটি প্রদর্শনী করলেন গনেশ (ইমেজেস অব লর্ড গনেশ) এবং বন্য ও গৃহপালিত জীবজন্তু নিয়ে। এখানে বসন্ত চৌধুরী, ইন্দ্রাণী সেনরা এসে কিনেছিলেন তাঁর টেরাকোটার গনেশ। ১৯৮৮ তে মুম্বাইয়ের জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে করলেন ৫৫ টি গনেশ নিয়ে। ফের কলকাতার চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে ১৯৮৯ তে বিষয় বাছলেন নানারূপে বিষ্ণু। এভাবেই চলতে থাকলো তাঁর লাগাতর টেরাকোটা শিল্প প্রদর্শনী। কখনো লৌকিক দেবদেবী, রূপসী বাংলা, জীবনের পৃষ্ঠা, আকন্দ শিব, আবার কখনও মানুষ ও জীবজন্তু নিয়ে তাঁর কাজ। ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁর এই প্রদর্শনী শিল্প বোদ্ধাদের হৃদয় জিতে নিয়েছে বলা যায়। আজ কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সামান্য মাটি দিয়ে কি অপূর্ব কেরামতি দেখানো সম্ভব।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রামকুমার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, "সদ্য কলকাতায় আসা এক তরুণ শিল্পীর টেরাকোটার প্রথম প্রদর্শনী মুগ্ধ করেছিল অনেককে। সেই রামকুমার মান্না এখন অনেক পরিণত। কিন্তু মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের সজল স্নিগ্ধতা ও বিস্ময় এখনও তাঁর প্রকাশের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। জীবনের সংঘাত ও জটিলতা আরও বেশি আত্মস্থ হয়েছে। স্নিগ্ধতাকে তা অন্বিত করেছে আরও গভীরতায়। সহজ জীবনের সরল ছন্দটি তাঁর হাতে ধরা পড়ে খুব সুন্দর।"
নিজের কাজ দেখছেন রামকুমার মান্না
তিনি মাটি নিয়ে নানা রকম কাজের এক্সপেরিমেন্ট করেন। গ্রামার মেনে নয়, বরং কিছু আর্কিটাইপাল ও প্রাগৈতিহাসিক ইমেজ ব্যবহার করেন কাজের মধ্যে। সহজ সরল নিষ্পাপ মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তাঁর হাতের কেরামতিতে। তাঁর ফর্মে ধরা দেয় বাইবেলের চাইল্ড এফেক্ট। তিনি টেরাকোটার কাজ করলেও প্রকরণের দিক থেকে উন্নততর শৈলী ব্যবহার করে বিশেষ এক অভিঘাত এনেছেন নিজের প্রতিটি কাজে। মাটির সাথে সুরকি এবং পাথরের গুঁড়ো মিশিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি করেন নানা শিল্পসমৃদ্ধ উপাদান। এরফলে এগুলো ফার্নেসে পোড়াতে সুবিধা হয়। অত্যধিক তাপে পোড়ালে সমস্যা হয়না, বরং সেরামিকসের আদলে কাঠিন্য চলে আসে।
তাঁর প্রতিটি উৎপাদনে নিসর্গের নানা অনুষঙ্গ। আজ ৪১ বছর ধরে এই কাজ করে চলেছেন। ললিত কলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পীদের নিয়ে ক্যাম্প করছেন। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। রাজ্য চারুকলা সহ অন্যান্য নানা ক্ষেত্র থেকে পেয়েছেন ৮-১০ টি পুরস্কার। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স তাঁকে দিয়েছে সম্মান। ভোপাল থেকেও পেয়েছেন পুরস্কার। ২০০৯ তে টেরাকোটার কাজের একক প্রদর্শনী করেছেন খোদ লণ্ডনে গিয়ে।
গ্রামের বাড়িতে রামকুমার
আজ কলকাতায় রামকুমার মান্নার বাড়িটিও দেখবার মতো। সম্পূর্ণ টেরাকোটা সামগ্রী দিয়ে সজ্জিত। স্ত্রী মিনু এবং কন্যা সুনয়নী ছিলেন সেই বাড়ির অলঙ্কার। ২০২১ এ মারা গিয়েছেন স্ত্রী। নিঃসঙ্গ জীবন। তাই কাজের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকেন সবসময়। রামকুমার মান্না সম্পর্কে ড. প্রবালকান্তি হাজরার উপলব্ধি, "রামকুমার মান্না প্রখ্যাত টেরাকোটা ভাস্কর। কিন্তু তিনি যে যথার্থ জীবনশিল্পী তা তাঁর কাজ দেখলেই অনুভব করা যায়। সারা বাড়িময় যে সব শিল্পকৰ্ম্ম সাজানো ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাতে তাঁর মানবিক অনুভব ও অনুভূতি সামাজিক দায়বদ্ধতা, প্রকৃতি রুদ্ররূপের কাছে মানুষের অসহায়তা যেমন ধরা পড়ে, তেমনি প্রকৃতি ও জীবজন্তু ও মানুষের সহাবস্থান এবং জীবন যে চলমান তার যে এগিয়ে চলার ছন্দে কোন ছেদ পড়ে না, সেটাও স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। এখানেই তাঁর শিল্পকর্ম্মের সার্থকতা ও শিল্পের ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়ার দক্ষতা বিদ্যমান"।
🍂
0 Comments