বাংলাদেশ ভ্রমণ
পর্ব – ৪
রোশেনারা খান
ঝর্ণা দেখে যেই ফেরার জন্য মুখ ফিরিয়েছি, ২টি ১০/১২ বছরের মেয়ে আমাকে ঘিরে ধরে, তারা ঝিনুকের মালা বিক্রি করছে, আমাকে একটা নিতেই হবে। এদিকে সাকিল এগিয়ে গিয়ে আমাকে ডাকছে, আমি নিতে রাজি না হলে আমার হাতে জোর করে একটি মালা দিয়ে বলে, দাম দিতে হবে না। সাকিল ডাকছিল আনারস খাওয়ার জন্য। আমি ঠোঙাটি হাতে নিয়ে আবার মেয়েদুটির কাছে ফিরে গিয়ে ৫০ টাকার একটা নোট দিলাম। ওরা তো কিছুতেই নেবে না। আমি বললাম, বড়রা কিছু দিলে, না বলতে নেই। ওদের দুজনের ছবি তুলে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
শুনলাম এখানে ৫ টি বিচ আছে। কক্সবাজারের এই বিচের দৈর্ঘ ১২০ কি.মি. এটি একটি পৃথিবীর দীর্ঘতম সি বিচ। বিচের প্রধান বৈশিষ্ট হল সম্পূর্ণ বিচটাই বালির, কোনরকম নুড়ি বা কাদা নেই। আটলান্টিকে (ডেভন) দেখেছি, পাশাপাশি দুটি বিচের একটিতে বালি আর একটিতে স্লেট পাথরের কুচি ও ছোট ছোট পাথরের দানায় ভরা।
আমরা যেখানে উঠেছি সেখানের সেই চত্বরটির নাম, কবিতা চত্তর। আর বিচের নাম কবিতাসরণী বিচ।এই জায়গাটিকে ডলফিন মোড়ও বলা হয়। এই শ্রুতি মধুর নামগুলি দিয়েছেন এখানকার ভূমিপুত্র স্বনামধন্য কবি কামরুল হাসান।আমার ছাতা দেখে শ্রাবন্তী ছাতা কিনেছে দেখছি।আমি একটা ব্যাগও কিনেছি, ওটা দেখে মায়াদি ও সরস্বতীদি ব্যাগ কিনতে গেলেন। আসলে আমাদের হাতে সময়ও কম, তার ওপর প্রচণ্ড গরম। শুনলাম এখানে বার্মিজ মার্কেট আছে, সেখানে থায়ল্যান্ড, মায়ানমার ও চিনের বিভিন্ন ধরণের জিনিস পাওয়া যায়।এছাড়া একটি ঝিনুক মার্কেট আছে। সেখানে ঝিনুক দিয়ে তৈরি সৌখিন ঘর সাজানোর জিনিস, ঝিনুকের গহনা ইত্যাদি পাওয়া যায়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
আবার এতখানি রাস্তা পার হয়ে গেস্ট হাউসে ফিরলাম।খুব ক্লান্ত লাগছিল, আমি আর ব্রেকফাস্ট করলাম না। স্নান করে শুয়ে পড়লাম। আজ বিকেলে বঙ্গবন্ধু কবিতা পরিষদের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান রয়েছে। আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। এই গরমে ড্রেস বদলাতেই বিরক্ত লাগে। তবুও দুপুরে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের জন্য যেতে হল। লাঞ্চের পর সাকিল আর গৌতমবাবু ঢাকা যাওয়ার জন্য টিকিটের খোঁজে গেলেন, আমরা গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম।
‘এনা’ কোম্পানির বাসের টিকিট পাওয়া গেছে, বাস ছাড়বে আগামিকাল দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিটে। আমরা সবাই সন্ধ্যার সময় কবিতা সরণী বেড়াতে গিয়ে শেষ বারের মত সমুদ্রের জল ছুঁয়ে এলাম। রাতেই সব গুছিয়ে রাখলাম। সকালে সরস্বতীদি চায়ের জন্য নিচে নেমেছিলেন, আমাকে চা নিয়ে এসে দিলেন। স্নান করে রেডি হলাম। গতকাল রাতে যে রেস্টুরেন্টে ডিনার করেছিলাম আজ ১০টার সময় সেখানেই লাঞ্চ করতে যাওয়া হবে। গতকালই বলে রাখা হয়েছে ১০টায় লাঞ্চ রেডি রাখার জন্য।
১৮ এপ্রিলের কবিতা উৎসবে আলাপ হয়েছিল কবি ও প্রাবন্ধিক হুমায়ুন সিদ্দিকীর সঙ্গে। উনি ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’বইটির আর কপি আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন। থাকলে উনি এককপি কিনে নেবেন। আমার কাছে দুটি কপিই ছিল।আমি ওনাকে ফোনে জানিয়ে সেই কপিটি গেস্ট হাউসের রিসেপ্সনে রেখে লাঞ্চের জন্য বের হলাম। সবাই চলে গেছেন, একজনকেই কিছুটা দূরে দেখতে পাচ্ছি। তাঁকেই ফলো করে একটু স্পিডেই হাঁটছিলাম, আপা আপা ডাক শুনে পিছন ফিরে দেখি কবি কামরুল হাসান আমার দিকে আসছেন। দাঁড়াতেই হল। ওনার হাতে হুমায়ুনের জন্য রেখে আসা বইটি রয়েছে।আরও একবার ফোন নাম্বার নিলেন। কিছু ব্যক্তিগত কথা হল।
না চিনতে পেরে রেস্টুরেন্ট পার হয়ে চলে গিয়েছিলাম। পিছন থেকে সাকিল ডাক দিল। যাইহোক, এত সকালে বেশি কিছু রান্না হয়নি।মাছভাত আর স্যালাড খেয়ে গেস্ট হাউসে ফিরেই লাগেজ নিয়ে নামতে হল। গেস্ট হাউস ছেড়ে টোটোতে চড়ে বাসস্ট্যান্ড পৌঁছালাম। ওয়েটিংরুমে কিছুক্ষণ বসলাম।তারপর এদিক ওদিক করে কোনরকমে বাসে চড়ে পিছনের দিকে সিট পেলাম।এখুনি ১২টা বেজে গেছে, শুধু ঘড়িতে নয়, আমাদেরও, অত্যধিক গরমে। এসি বাস, এটাই রক্ষে।বন্ধ কাচের ভিতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। একসময় নদীর দেখা পেলাম।বাস ছুটছে। আধোঘুমে মনও ছুটছে। সেইসঙ্গে টুকটাক খাওয়াও চলছে।ধিরে ধিরে সন্ধ্যা নামল। অন্ধকার ঘন হচ্ছে, মানে রাত বাড়ছে।এক জায়গায় বাস দাঁড়ালে আমরা ডিনার করলাম।এখন ঘড়িতে ৯ টা ২০ বাজে,৩ ঘণ্টার পথ এখনো বাকি।মায়াদি অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, বার বার আমার কাছে সময় জানতে চাইছেন।আমি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সময় জানাচ্ছি ওনাকে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। একসময় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।সাকিলের ডাকে হতচকিত হয়ে উঠে পড়েছি।এবার আমাদের নামতে হবে। আমরা বাস থেকে নামার পর কয়েক জন মাত্র প্যাসেঞ্জার ছিল।বাস থেকে নেমে লাগেজ নেওয়ার জন্য সাইড ব্যাগ থেকে টোকেন বের করে সাকিলের হাতে দিয়ে নিজের লাগেজ চেনার চেষ্টা করছি। অভ্যাস বশে ব্যাগটা ছুঁয়ে দেখি সাইডের চেন খোলা।ব্যাগে ফোন নেই। সবাই তাড়াহুড়ো করছেন। কাকে কী বলব? ওখান থেকে আমাদের থাকার জায়গায় যাওয়ার জন্য আমারা টোটোতে চড়লম।আমরা এখানেও একটি গেস্ট হাউসে উঠলাম। সবাই জানলেন আমার ফোন খোয়া গেছে। ওনাদের ধারণা ফোন বাসের সিট থেকে গেছে। সাকিল ফোনে ড্রাইভার ও বাস কোম্পানির অফিসে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন, কিন্তু কেউ ফোন তুল্লেন না। সকালে সাকিলের পরিচিত কয়েকজন দেখা করতে এলেন। তাঁদের মধ্যে পারভেজ চৌধুরীও ছিলেন। আর ছিলেন কবি হুমায়ুন কবির। দুজনেই খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি।ওপরমহলে যোগাযোগ করে বাসে রেড করিয়েছিলেন, কিন্তু ফোন পাওয়া গেলনা। আমার মনে হচ্ছে লাগেজ নেওয়ার সময় কোন ওস্তাদ চোর হাতসাফাই করেছে।
মন ভীষণ খারাপ, বেড়ানোর মুডটা নষ্ট হয়ে গেল।দামি ফোন ছিল, সেটা নিয়ে ভাবছি না। আজকাল যে ফোনেই সব থাকে। ফোনে OTP আসে, ছবি, ভিডও, দরকারি নাম্বার ছিল।কত ডকমেন্টস ছিল। What’s App এ অনেক লেখা ছিল।বিভিন্ন স্মরণীয় মুহূর্তের ভিডিও ছাড়াও আমার সম্পূর্ণ আত্মকাহিনী ছিল। আরও অনেক কিছুই ছিল যা উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কী আর করব? কিছু করার নেই। একটা ফোন কিনব ভাবছি।
জানিনা সাকিল তার কোন বন্ধুকে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করতে বলেছিল, শুনছি আগামিকাল ১২ টার মধ্যে আমাদের রুম খালি করে দিতে হবে।এ এক বাড়তি ঝামেলা। যাইহোক আবার অন্য যায়গায় থাকার ব্যবস্থা করা হল। সাকিল ও শ্রাবন্তীর পরিচিত একটি মেয়ে এসেছে। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কয়েক মিনিটে আমরা এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল যে আমাকে সালাম করে, বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’ বইটির একটিই কপি ছিল, সেটা ওকে দিলাম। শ্রাবন্তী ওর সঙ্গে চলে গেল। আগামিকাল ঢাকায় পদক্ষেপ এর কবিতা পাঠের ও আলোচনার অনুষ্ঠান আছে, সেখানে ও আসবে।
0 Comments