জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ -পর্ব- ২৩/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ২৩
স্বপন কুমার দে

মল্লিকা এই প্রথম জানতে পারল, সৃজা অর্থাৎ মন্টির কাকু ও তার ঠাকুমা পুরুলিয়ায় চলে গেছেন। জানতে পারল, কেনই বা তার কাকু ট্রান্সফার নিয়ে অতদূরে চলে গেল।

অন্যান্য দিনের মত আজও মল্লিকা এ বাড়িতে পড়াতে এসেছে। কিন্তু মন্টির আজ পড়ায় মন নেই। থেকে থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। যে অংকগুলো অনায়াসে করতে পারত সেগুলো ভুল করছে। বিজ্ঞান পড়াতে গিয়েও দেখল একই অবস্থা।  সহজ সূত্র, সমাধান সবেতেই ভুল। কিছু বললেই মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। মল্লিকা বুঝতে পারল, মেয়েটির মন খারাপ, কিন্তু কেন খারাপ বুঝতে পারল না। দু'একবার জিজ্ঞেস করে দেখল, তেমন কিছু না বললেও এইটুকু জানা গেল, কাকু ও ঠাম্মার জন্যই তার মন খারাপ। যাই হোক, এক আধ দিন এরকম হতেই পারে। বেশি কৌতূহল ভালো নয়।

একটু পরেই মন্টির মা দিদিমণির জন্য চা টিফিন নিয়ে ঘরে ঢুকল। একটুক্ষণ মেয়ের দিকে চেয়ে রইল, তারপর বেরিয়ে যেতে গিয়েও কী মনে করে পিছু ফিরল।
" দিদিমণি, আজ বোধহয় মন্টির পড়ায় মন নেই। তাই না?"
" হ্যাঁ, আমিও সেটা লক্ষ্য করেছি। কেন, আপনারা কি বকেছেন?"
" না, আসলে ঠিক তা নয়। ওর ঠাম্মা আর কাকুর জন্য মন খারাপ। ওরা ওকে খুব ভালোবাসে তো। সেই কাকু আর ঠাম্মা এখন পুরুলিয়া চলে গেছে, তাই মন খারাপ।"
" ওমা! তাতে মন খারাপের কী আছে সৃজা? চাকরির প্রয়োজনে কাকুকে তো বাইরে যেতেই হবে। আর কাকুর দেখাশোনার জন্য ঠাম্মাকেও যেতে হবে। তুমি যখন চাকরি করবে, তখন তোমাকেও বাইরে যেতে হবে।"
" ওই পাজি আন্টিটার জন্যই তো কাকু চলে গেল। নাহলে কি আর যেত?"
মন্টির কথা শুনে মল্লিকা অবাক হয়ে গেল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ওর মা বলল," দিদিমণি, মন্টিকে ছেড়ে দিন। আজ ওর পড়ায় মন নেই।"
" ঠিক আছে।" বলে মন্টিকে ছুটি দিয়ে দিল। মন্টি মায়ের ঘরে ঢুকল।
সুদেষ্ণা ইতস্তত করে বলল," মন্টি কী বলে গেল, বুঝতে পারলেন?"
" না বৌদি, আপনাদের পার্সোনাল ব্যাপারে আমার কোনো কৌতূহল নেই। চা-টা খুব সুন্দর বানিয়েছেন।"
" আর একটা পাঁপড় ভাজা দিই?"
" না,না, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি আর খাবো না।"
সুদেষ্ণা নিজে থেকেই বলতে শুরু করে, " সমু মানে সম্পূরক একটি মেয়েকে ভালোবাসত।আমরা সকলেই জানতাম, সমুর সাথেই তার বিয়ে হবে। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু দু'তিনদিন আগে জানা গেল, অন্য একজনের সঙ্গে তার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। তারপর থেকেই ভাই কেমন যেন হয়ে গেল।" সুদেষ্ণা একে একে সব ঘটনাই মল্লিকাকে বলে চলল। মল্লিকা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো শুনছিল আর শুনতে শুনতে সুদেষ্ণার চোখ মুখের এক্সপ্রেশনগুলি মন দিয়ে লক্ষ্য করছিল। দীর্ঘ কথাবার্তার সময় যে কত রকমের শারীরিক ভঙ্গি করে তা বক্তা হয়তো নিজেও জানে না। তবে প্রয়োজনের সাপেক্ষে মানুষ জেনে শুনেই ভঙ্গি করে।
🍂
" আমি জানিনা রূপসা কেন এমন করল। ওদের মধ্যে কখনও ঝগড়া বা সম্পর্কে অবিশ্বাস ছিল বলে মনে হয়নি। অন্তত কোনও দিন সমুর আচরণে সেটা বুঝতে পারিনি। আমি এটাও বুঝি না হঠাৎই কেন সে সিদ্ধান্ত বদল করল।"
সৃজার মা যে এত কথা বলতে পারে, তা আগে জানা ছিল না মল্লিকার। নীরব শ্রোতা হয়ে সে কথাগুলোকে গিলছিল।
" আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি বলতে পারেন, এরা এতটা বদলাতে পারে কীভাবে? এ কি শুধুমাত্র সিদ্ধান্তহীনতা নাকি স্বার্থপরতা? আজ একে পছন্দ তো কাল ওকে! নিজের জীবন নিয়ে অন্যের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার কারণ কী?"
" কারণ, ওর  নিজের ওপরই বিশ্বাস নেই।" কথাটা বলেই মল্লিকা দেখল, সৃজার মা মুগ্ধ শ্রোতার মত ওর মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। সাময়িক জড়তা কাটিয়ে সে নিজের উপলব্ধির কথা বলল," কারণ, ওদের সম্পর্কের ভিতটাই আলগা ছিল। হয়তো কিছু কিছু ঘটনায় রূপসা সম্পূরকবাবুর ওপর দুর্বলতা দেখিয়েছিলেন, আর সেটাকেই প্রেম বলে ভুল করেছিলেন সম্পূরকবাবু। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ অর্পণ করেছিলেন রূপসার ওপর। তিনি সম্পর্কটাকে তলিয়ে দেখেননি, নিরপেক্ষভাবে এই সুখ সম্পর্ককে বিচার করতে যাননি। শুধুমাত্র নিজের আবেগ আর বিশ্বাসকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। কখনও ভাবেননি উল্টো দিকটাও সমান সত্য।"
মল্লিকার কথার সমর্থন করে সুদেষ্ণা," তাই হবে মনে হয়। তবে আমার কী মনে হয় জানো, শুধুমাত্র সারল্য দিয়ে প্রেম হয় না। সম্পূরক চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত ও পথ মাড়ায়নি। ওই ধরনের বন্ধুদের সাথে মেলামেশাও করেনি। তাই প্রথম বার প্রেমের আকর্ষণে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। আসল নকল যাচাই করতে পারেনি।"
" বৌদি, আরেকটা কথা বলতে চাই, সম্পূরকবাবু কিন্তু ঠকেননি, ঠকেছে রূপসাকে যে বিয়ে করেছে সে। তার মনে একটা ভয় সবসময়ই থাকবে যে একইভাবে রূপসা না আবার তার কাছ থেকেও চলে যায়। এই অবিশ্বাস থেকেই যাবে। এই বিয়ে সুখের হবে না বৌদি।" কথাগুলো বলতে বলতেই মল্লিকা দেখতে পেল, বৃদ্ধ অমরেশবাবু খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। লজ্জা পেয়ে গেল মল্লিকা।
" যদি তোমাদের আপত্তি না থাকে, তাহলে এই বুড়োটা কি তোমাদের আলোচনায় ঢুকতে পারে?"
" ওমা! তা কেন নয় বাবা। দাঁড়ান, আমি আপনার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে আসি।"
" না বৌদি, আপনারা বসে গল্প করুন। আমি বরং আজ আসি।" মল্লিকা ইতস্তত করে।
তাকে থামিয়ে দেন অমরেশবাবু," তোমার যদি তাড়া না থাকে তাহলে একটু বসে যাও। আর যদি..."
" না জেঠু, আমার কোনও ব্যস্ততা নেই। আপনি বলতে পারেন।"
ইতিমধ্যে শ্বশুরের জন্য একটা চেয়ার এনে দেয় সুদেষ্ণা। তাতে বসে পড়েন অমরেশবাবু। ইঙ্গিতে সুদেষ্ণাকে খাটটায় বসতে বলেন।
" তোমরা দু'জনেই আমার মেয়ের মত। মত কেন বলি, মেয়েই। তোমাদের সঙ্গে রূপসা আর সম্পূরকের বিষয়ে বলতে গেলে একটু কিন্তু কিন্তু হয় আর তোমাদেরও লজ্জা লাগবে। তোমার শাশুড়িমাকে আমি এ ব্যাপারে যা বলার বলেছি। একটা সম্পর্কের ভেতর অনেক বাধা আসবে, জটিলতা আসবে। সেটা অবশ্যম্ভাবী। অল্প আঘাতে সে সম্পর্ক যদি ভেঙে যায় তো সেরকম সম্পর্কের মূল্য কী? আমার মনে হয় বিয়ে হয়নি, আমাদের পক্ষে মঙ্গল হয়েছে। হলে, প্রতি মুহূর্তে এদের সম্পর্ক ভাঙত আর আমাদের তা জোড়াতালি দিয়ে রাখতে হত। বিয়ে এমন একটা সামাজিক, পারিবারিক ও মানসিক বন্ধন যেটার সঙ্গে আরও অনেকগুলো মানুষ জড়িয়ে থাকে। তাই অনেক ক্ষেত্রে সমঝোতা করতে হয়। কখনও কখনও পিছিয়ে আসতে হয়।"
তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দেয় মল্লিকা," কিন্তু কতটা পিছাবো বলতে পারেন? বিশেষত, আমরা মেয়েরা? রাস্তাঘাটে, প্রতিষ্ঠানে এমনকি নিজের বাড়িতেও আমাদের কতটা কম্প্রোমাইজ করতে হবে বলতে পারেন?" কথা বলেই নিজের আচরণে লজ্জিত হয় মল্লিকা।
" ততটা পিছুবে বা সমঝোতা করবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তোমার আত্মসম্মানকে আঘাত করে। আমি কিন্তু কাউকেই আত্মসম্মান খোয়াতে বলছি না। তোমার ভদ্রতা হোক তোমার শিক্ষা ও রুচির পরিচয়। তুমি ততক্ষণ ভদ্র থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের অন্যায় সীমার মধ্যে থাকবে। তোমার ভদ্রতাকে যেন লোকে দুর্বলতা না ভাবে।"
" কিন্তু জেঠু, ওরা তো তাই ভাবে। আমি যত ভাবি ভদ্রতা বজায় রাখব, ততই ওরা উগ্র হয়। আমার বাবা নেই, মা নেই, বাড়িতে একা থাকি।অপরাধীরা তো সুযোগ খুঁজবেই। আমার পক্ষে কতখানি সহ্য করা সম্ভব।"
অমরেশ মল্লিকার দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। তাঁর খুব গর্ব ছিল যে তিনি গরিব পরিবার থেকে কঠোর পরিশ্রম করে আজকের অবস্থায় উঠে এসেছেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা সেই স্ট্রাগলটাই করতে জানে না। এদের মুখের সামনে সব সাজিয়ে দেওয়া হয়। এখন মল্লিকার কথা শুনে তাঁর সেই অহংকারে ঘা পড়ল।
" দেখো মা, তুমি এতদিন এ বাড়িতে পড়াতে আসছো, আমি কখনও তোমার কাছে জানতে চাইনি, তুমি কোথা থেকে আসছো? মা বাবা কে কী করেন? কিন্তু আজ প্রথম তোমার চোখে আমি আগুন দেখতে পেলাম। মনে হয়, দুঃখ কষ্টের অনেক জ্বালা যন্ত্রণা তুমি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছো। তোমার যদি কোনও আপত্তি না থাকে বলতে পারো। কিছু হোক আর নাই হোক কিছুটা স্বস্তি পাবে।"
মল্লিকা খুব সংক্ষেপে নিজের জীবনের কথা, নিজের লড়াইয়ের কথা, - সব বলল।
বড় দুঃখ হল অমরেশবাবুর, সুদেষ্ণার চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। ওরা তখন ভুলেই গেল কোন দুঃখের কথা তারা মল্লিকার সামনে বলতে গিয়েছিল। এ যে যন্ত্রণার পাহাড়। তারপর সেই সব কথা থেকে বেরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে কখন যে রাত দশটা বেজে গেল বুঝতেই পারল না।
সুদেষ্ণা বলল," দিদিমণি, আজ আমাদের বাড়িতে খেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।" অমরেশবাবু বৌমার কথায় সম্মতি দিলেন। মল্লিকা আপত্তি জালাল," না, না বৌদি, আমি বাড়ি গিয়ে খাব। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। "
সুদেষ্ণা একপ্রকার জোর করে তাকে খাওয়ার টেবিলে বসিয়ে খাওয়াল। উদ্দালক ততক্ষণে বাড়ি ফিরেছে। বাবা হুকুম দিলেন," দালু, তুই যা, মল্লিকাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়। অনেক রাত হয়ে গেছে।"
মল্লিকা মৃদু আপত্তি করলেও সুদেষ্ণা তার স্বামীকে মল্লিকার সাথে পাঠাল।
 

Post a Comment

0 Comments