জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়/নবতিবিংশ পরিচ্ছেদ/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
নবতিবিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী


গুপ্ত কাশী জায়গাটির স্হান মাহাত্ম্য এমনই যে এখান থেকে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ দুই শৈবক্ষেত্রই অনায়াসে দর্শন করা যায়। তাই দাদা হয়তো তড়িঘড়ি ওখানে পৌঁছেই তিনদিনের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। অন্যান্য জায়গার মতো ছোটোখাটো ধর্মশালা ছিলনা সেটি, বেশ অনেক খানি জায়গা জুড়ে গাছপালা ছাওয়া ঢালু ছাদের সারি সারি ঘর। একদিকে ছেলেদের, একদিকে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা, খাওয়ার ঘর দূরে। রাতে বুঝতে পারেননি,সকালে বুঝেছিলেন, ধর্মশালাটির অবস্থান অনেকটাই হরিদ্বারের মতো। জলের সমস্যাও তেমন নেই। যদিও ঠান্ডা ভীষণ। কিন্তু মানুষ তো অভ্যাসের দাস,সব মানিয়ে নেয়। সুতরাং যে পিসিমার এতো ছুৎমার্গ, তিনিও কিন্তু সব ভুলেছেন, সবার সঙ্গে মিলে চলছেন, যে বিরজার সংসারে কেউ নেই, সেও সই পাতিয়ে আত্মীয় সন্ধানে ব্যস্ত! 
যাহোক, ভাব বিলাস ছেড়ে দ্রুত বিছানা করে সবাই সেরাতে শুয়ে পড়েছিলেন, অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, খাবার পাওয়া যায়নি। সবাই ছিলেন তুমুল ক্লান্ত।মুড়ি চিবোবার ইচ্ছেটুকু অবধি নেই।তায় অতো রাতে গরম জল পাওয়ার আশা করাও অন্যায়।অগত্যা সঙ্গে থাকা ছাতু, নাড়ু দিয়েই রাত কাটাতে হয়েছিল। পরের দিনে কেদারনাথ মন্দির দর্শন সৌভাগ্যে তারা তখন বিভোর. .. 
ক্রমে রাত কাটে, ভোর হওয়ার আগেই সবাই প্রস্তুত হয়ে যাত্রা শুরু করেন বাবা কেদারনাথ দর্শন আকাঙ্ক্ষায়। গাড়ি করে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার রাস্তা, নেমেই হাঁটাপথ। সে পথ সঙ্কীর্ণ,সে পথ দুর্গম। একদিকে আকাশচুম্বী পাহাড়,অন্যদিকে অতলস্পর্শী খাদ।সাবধানে পথ চলতে হচ্ছিল,পথশ্রমে সঙ্গী ছিল উদ্দাত্ত এবং বেসুরো কন্ঠে দাদার গান, সঙ্গতে সইয়ের বর।চারিদিকে ঘন ঠান্ডার আবরণ,ধোঁয়া ধোঁয়া প্রকৃতি, সঙ্গে বরফের মতো ঝোড়ো হাওয়া চোখেমুখে এসে বিঁধছে।এরই মধ্যে পাশ দিয়ে চলেছে টাট্টু ঘোড়ার দল সওয়ারী নিয়ে।পিসিমা এবং কাকীমার জন্যে ডুলির ব্যবস্থা হলেও বাকী সবাই গিয়েছিলেন হেঁটেই,পথে অজস্র বাঁক। পথ হয়তো কিলোমিটার হিসেবে ষোলো বা আঠারো, কিন্তু সমতলের পথের হিসাব পাহাড়ে মেলেনা।ধীরেসুস্থে থেমে থেমে যেতে হয়, সঙ্গে গভীর শ্বাস। দাদার নির্দেশমতো যাচ্ছিলেনও সবাই সেভাবেই।
তারপরেই ওমা! হঠাৎ পরিবেশে আমূল পরিবর্তন,একটু আগের সেই ধূসর বিষন্নতা আর নেই,বাঁক পেরোতেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ! আকাশগঙ্গা মন্দাকিনীর তীরের চারিদিকে ঝলমলে রোদ,শেষ দুপুরের। তুষারমৌলি শৃঙ্গদল ঘিরে হাজার মানুষের মেলা…সবাই চলেছে হাজার বছরেরও প্রাচীন,মাটি থেকে  প্রায় বারো হাজার ফুট উঁচু সেই কালো পাথরের অনন্য মন্দিরটির অভিমুখে, কন্ঠে জয়ধ্বনি,”বাবা কি জয়!” খানিক থমকে দুই সখী পরস্পরের হাত ধরে যেন যুদ্ধ জয়ের আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন,’আমরা এসে গিয়েছি,আমরা পেরেছি…’
তাঁরা জানতেও পারলেন না, দাদা এবং সেই ভদ্রলোক পিছনে দাঁড়িয়ে দুটি সাধারণ বাঙালিনীর এই স্বতস্ফূর্ত উল্লাসকে দুচোখ ভরে অনুভব করলেন। হয়তো আপন আত্মীয়াদের জন্য দেওয়া হয়নি উন্নত জীবন, তবু কিছু অন্তত তো… , হয়তো সেকথা ভেবেই খুশি হয়েছিলেন পুরুষেরা হঠাৎ চলকে ওঠা রোদের মতো। 
তারপরে যথাবিহিত পূজা, অর্চনা, জগৎ বিখ্যাত সেই বরফ লিঙ্গ দর্শন ইত্যাদি ইত্যাদি পূণ্য অর্জন নিরুপদ্রবেই সমাধা হোল সবাই মিলে। এমনকি যথেষ্ট বিপদের সম্ভাবনা সত্ত্বেও তিনটি বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যও পিচ্ছিল পথে নিরাপদে দেবদর্শনের সৌভাগ্য পেয়েছিলেন। 
🍂
তবে প্রতীক্ষা থাকলেও উত্তর কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনের মতো অনন্য কোন ঘটনা-ঘনঘটার সাক্ষী হতে পারেনি মন। ফেরার পথে বরঞ্চ গৌরীকুন্ড দর্শনের স্মৃতি এখনও জাগরুক, সেই গৌরীকুন্ড,যে স্হান সম্বন্ধে স্বামী রামানন্দ ভারতী কবেই লিখেছিলেন, 

'গৌরীকুন্ডের জলভাগ হইতে তীরদেশ চারিশত হস্ত উর্দ্ধে। এই পর্বত নিখুঁত পাষাণময়, মৃত্তিকার লেশমাত্র নেই.. রুদ্রদেব যেন ভাগীরথীকে মস্তকে ধারণ করিয়া,সবেগে মুহুর্মুহু জল নিক্ষেপ করিয়া তীরস্থ বৃক্ষরাজিকে আকুলিত করিয়া তুলিতেছেন'। 

            ভারতের অন্যতম ভ্রমণকাহিণী-লেখকের এই বর্ণনা অভিযান যখন পড়েছিলেন ভাইপোর এনে দেওয়া ‘হিমারন্য’ নামের বইটিতে,মনে মনে যেন শুনেছিলেন পাহাড়ের আকুল আহ্বান; স্বপ্নে যেন দেখতেন সেই স্বর্গীয় দৃশ্যাবলী, যদিও কখনও কল্পনাও করেননি চাক্ষুষ দেখার।তবে কখনো কখনো স্বপ্ন তো সত্যি হয়।গৌরী কুন্ডের জলরাশির দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলেন হয়তো।মনে মনে যেন শুনেছিলেন পাহাড়ের আকুল আহ্বান; স্বপ্নে যেন দেখতেন সেই স্বর্গীয় দৃশ্যাবলী, ঝরো ঝরো ঝর্ণা, উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণী,আলোময় আকাশ ভরা অযুত মাধুরী সুধা….যদিও কখনও কল্পনাও করেননি সেসব চাক্ষুষ দেখার।তবে কখনো কখনো স্বপ্নও তো সত্যি হয়।গৌরী কুন্ডের জলরাশির দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলেন হয়তো।কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন দাদা, খেয়াল করেননি।চমক ভাঙলো তাঁর ডাকে,
-’কি ভাবছো বোন?’
-’না দাদা।তেমন কিছু নয়। শুধু ভাবছি,জীবন কি অবাক খেলা খেলে কখনো কখনো।তার নাহলে, আমার মতো এক অভাগিনীরও কি সৌভাগ্য হয় এসব দেখার?’
-’নিজেকে সম্মান করো।ভালোবাসো বোন। বাড়ি ছেড়ে পথে পথে ঘুরে আমি এটাই শিখেছি।তাই বলি,তুমি অভাগী না সুভগা তা কে বলবে বলো? তাকিয়ে দেখ,ঐ অসীম জলরাশির দিকে,দিগন্তস্পর্শী ঐ পর্বতশ্রেণীর দিকে,শোন কান পেতে কি গভীর সুরেলা সঙ্কেত ভেসে আসছে…ঐ তো জীবনের সুর, পথের গান।ঐ সুরে মন বাঁধো, লৌকিক দুঃখ আঘাত সব মুছে যাবে মন থেকে।’

চমকে তাকালেন বিরজা,তাঁর বৌদিদির দাদা, গ্রামবাংলার এক সাধারণ মানুষের মুখে এ কী শুনলেন তিনি!এমন কথা তো শাস্ত্রে লেখা বলে জেঠামশাই বলতেন,এসব কথা দাদা কি করে শিখলেন?তবে কি ঘর থেকে বাইরে পা বাড়ালেই মানুষ উন্মুক্ত হয়!’
মনে মনে ভাবলেন,হতেই পারেন তিনি জন্মলগ্নেই মাতৃহারা, ঊষালগ্নেই অকালবিধবা,তবু তিনিও তো মানুষ! সুযোগ যখন তিনি একবার পেয়েছন, চেষ্টা করবেন নিজের মতো করে জীবনকে উপভোগ করবেন, নিজেকে হতভাগিনী ভাববেন না।
দূরে তখন সূর্য পাটে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে, গৌরীকুন্ডের জলে সোনালী ঝিলমিল, গঙ্গাজল ডাকতে এসেছে ফেরার জন্য,তার হাত ধরে এগোনো গেল গাড়ির দিকে। 
যেতে যেতে পথের বাঁকে দেখা হয়েছিল এক ছোট্ট দিদি এবং তার ভাইয়ের সঙ্গে।মা নেই,বাবা কাজে যায় ভরনপোষনের তাগিদে। অগত্যা বাড়ির বাইরে সারাদিন ভাইকে নিয়ে বসে থাকে জননীর প্রতিনিধি স্বরূপা দিদি…দেখে কেন যেন মনে পড়ে গেল সব্বাইয়েরই মনে পড়ে গেল আপন ঘরের কথা,আপন মা ভাই বোন গাছ গাছালি ছাওয়া মায়ার কথা,ভালোবাসার কথা… ক্ষণিকের উন্মাদনা ভুলে ফিরতে ইচ্ছে হোল চিরাচরিত সেই মায়ার টানে…(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments