মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১৭
ড. অর্পিতা পাত্র (ক্রিপটোগ্রাফার, বিজ্ঞানী ও ভূপর্যটক, পাঁশকুড়া)
ভাস্করব্রত পতি
সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি তিনি। অতি সাধারণ আর পাঁচটা সাদামাঠা পরিবারের মতোই একটা সাধারণ শিক্ষকের পরিবারে তাঁর জন্ম। আদিবাড়ি ময়নার তিলখোজা গ্রামে হলেও পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থানার হাউর অঞ্চলের এক গ্রামে তাঁর জন্ম। এখানকার প্রত্যন্ত এলাকার কুমরপুর হটেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। এখানেই তাঁর বাবা সাহিত্যিক অহিভূষণ পাত্র ছিলেন ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। মা সীমা পাত্র সাধারণ গৃহবধূ। মাধ্যমিকের পর গোবর্ধনপুর প্রমথনাথ বিদ্যায়তন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ড. অর্পিতা পাত্র হলদিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে বি. টেক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই মহিলা এরপর তরতর করে এগিয়ে যান উঁচু লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায় ড. অর্পিতা পাত্র
পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্ট এন্ট্রান্সে র্যাঙ্ক করে হলদিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ইউনিভার্সিটি টপার হয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আই আই টি মাদ্রাজ থেকে ক্রিপ্টোলজির উপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জিত হয় তাঁর। তারপর পোস্ট ডক্টরেট করার জন্য ২০১০ এ বিদেশ পাড়ি দেন প্রথমবারের জন্য। প্রথম বছর পোস্ট ডক্টরেট করেন ডেনমার্কের অরহুস্ ইউনিভার্সিটি থেকে। দ্বিতীয় বছর পোস্ট ডক্টরেট করেন সুইজারল্যান্ডের ই টি এইচ (জুরিখ) থেকে। আর তৃতীয় বছর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক্টরেট করেন।
তিন বোন একসাথে
অতি শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল হার না মানা মনোভাব। দৃঢ় সংকল্প, অসম সাহস, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, ধৈর্য, পরিশ্রম আর লড়াকু জেদ তাঁর জীবনের অন্যতম পাথেয়। সঙ্গে ছিল নিবিড় পড়াশোনার নেশা। প্রথম শ্রেণী থেকে কলেজ, সব জায়গাতেই তাঁর প্রথম স্থানে থাকাটা ছিল অপরিমেয় শাসন করার ক্ষমতা। বর্তমানে তিনি বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের একজন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তাঁর অন্যতম আগ্রহের ক্ষেত্র হল ক্রিপ্টোগ্রাফি, সুরক্ষিত মাল্টিপার্টি কম্পিউটেশন প্রোটোকলের তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিকগুলিতে ফোকাস করা। ড. অর্পিতা পাত্র ২০২৪ সালে সাইলেন্স ল্যাবরেটরিজ, সিঙ্গাপুরে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি এবং ২০২২ - ২০২৩ সালের মধ্যে Google রিসার্চে একজন ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন।
স্বামী অধ্যাপক ড. আশিষ চৌধুরী এবং মেয়ের সাথে ড. অর্পিতা পাত্র
ইতিমধ্যে ড. অর্পিতা পাত্র অংশ নিয়েছেন চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত 'এশিয়াক্রিপ্ট - ২০০৫' এ এবং 'ইন্ডোক্রিপ্ট - ২০০৬' এ। হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত 'আই আর আই এস এস - ২০০৭' এ অংশ নিয়ে প্রথম পুরস্কারও লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত 'মাইক্রোসফ্ট টেকভিস্টা ২০০৭' থেকে সে তুলে নেয় দ্বিতীয় পুরস্কার। নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত 'মাইক্রোসফ্ট টেকভিস্টা ২০০৭'- এ অর্জন করে প্রথম স্থান। সেসময় সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী কপিল সিব্বাল, অরুণ শৌরি প্রমুখ। ২০০৮ এ বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত সেমিনারে 'গুগল ইন্ডিয়া উইমেন ইন্ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাওয়ার্ড'ও দখল করেন অনায়াসে।
ড. অর্পিতা পাত্রের আঁকা ছবি
কম্পিউটার সায়েন্সে শীর্ষস্তরের সম্মেলন এবং জার্নালে তাঁর ১০০ টিরও বেশি প্রকাশনা রয়েছে। কম্পিউটার সায়েন্সে প্রকাশনাগুলি ডি বি এল পি নামে একটি ডাটাবেসে রেকর্ড করা হয়। তিনি তাঁর স্বামী প্রফেসর আশিস চৌধুরীর সাথে "নিষ্ক্রিয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সুরক্ষিত মাল্টিপার্টি কম্পিউটেশন" (Secure Multiparty Computation Against Passive Adversaries) শিরোনামে বহু দলীয় গণনার উপর একটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন। তিনি ইতিমধ্যে ৫ জন পিএইচডি ছাত্রকে স্নাতক করিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন ক্রিপ্টোগ্রাফির সুপরিচিত গবেষক।
তাঁর গবেষণা ভিত্তিক অবদানগুলি IISc থেকে 'অসামান্য মহিলা গবেষক' হিসেবে প্রফেসর এস কে চ্যাটার্জি পুরস্কারের (২০২৩) জন্য স্বীকৃত হয়েছে। এছাড়াও Google Privacy Research Faculty Award ২০২৩, JP Morgan Chase Faculty Award ২০২২, SONY Faculty Innovation Award ২০২১, Google Research Award ২০২০, NASI Young Scientist Platinum Jubilee Award ২০১৮, SERB Women Excellence Award 2016, INAE Young Engineer Award ২০১৬ পেয়েছেন। যা তাঁর উচ্চ পর্যায়ের কাজের অন্যতম স্বীকৃতি। সেইসাথে এখন তিনি যুক্ত রয়েছেন ভারতের বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থা যেমন Indian Academy of Sciences (IAS), National Academy of Engineering (INAE), The World Academy of Sciences (TWAS) ইত্যাদির সাথে। এখন Indian Association for Research in Computing Science (IARCS) এর কাউন্সিল সদস্যও।
ড. অর্পিতা পাত্রের ফটোগ্রাফি
২০০৮ এ যখন তিনি পিএইচডি করছিলেন, সেসময়ও তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন চিন, সিঙ্গাপুর, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াতে। আসলে তাঁর চোখে ছিল নেশা। সে নেশার মূল ভাবনা ছিল অদেখাকে দেখা। অজানাকে জানা। অচেনাকে চেনা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অলিক সাম্রাজ্যের বুকে নিজেকে পথিক রূপে রূপায়িত করা। তাই "ভ্রমণ" নামক মারাত্মক উদ্বায়ী নেশার বটিকা সেবন করে চোখ আর মনকে করে তুলেছিলেন 'নেশাতুর'।
ট্রফির সাথে
'কোহিতুর' আমের স্বাদ আস্বাদনে যেমন ভোজনরসিক এবং ভোজনবিলাসীদের চেষ্টার ত্রুটি থাকেনা, তেমনি এহেন ভ্রমণবিলাসী ভবঘুরেকে আটকে রাখতে পারেনি কেউ। অনাস্বাদিত পথের পথিক হয়ে এই ভ্রমণপাগল এবং ভ্রমণরসিক বাঙালি মেয়েটি সদর্প পদচারণা করেছেন আমেরিকা থেকে আরাবল্লী। ইজরাইল থেকে ইতালি। তাঁর ভ্রমণের মানচিত্রে বাদ যায়নি জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, গ্রিস, ভেনিস, রাশিয়াও।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল আলাদা। প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ আহরণে তিনি সদা জাগ্রত। একদিকে পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য উন্মোচন, অন্যদিকে মহাকাশের মহাবিস্ময়, ইতিহাসের প্রাচীন সভ্যতা, ভূগোলের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ইত্যাদি বিষয়ে জানার অপার আগ্রহ। তাই তাঁকে ঘুরতে দেখা গিয়েছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উদ্দাম জলরাশির কাছে। আবার প্রাচীন রোমের কলোসিয়াম, ফ্রান্সের লুভ্যর মিউজিয়াম, আইফেল টাওয়ার, প্রভু যীশুর জন্মস্থান বেথলেহেম শহর, মস্কোর রেড স্কোয়ারে শায়িত লেনিনের মৃতদেহের সামনেও তিনি গিয়েছেন অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার আগ্রহে। চিনের মহাপ্রাচীরের পাথুরে রাস্তাতেও হাঁটতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তেমনি জাপানের বুলেট ট্রেনেও উপভোগ করেছে গতিশীল জীবনের স্বাদ। খুব কাছ থেকে জাপানের ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরির দৃশ্যও চোখে সাঁটিয়ে নিয়েছেন মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে এসে। চরম অধ্যবসায়, মেধা আর কিছু করে দেখানোর মানসিকতায় জারিত এই মহিলা তাই স্বাভাবিকভাবেই 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। একজন মহিলা হয়েও তিনি কোনও অংশে পুরুষের চেয়ে কম নন। আজ তিনি মেদিনীপুরের আইডল। এরাজ্যের আইকন। এই দেশের উদিয়মান সম্পদ।
নিজেকে ফিট রাখতে তিনি সবসময় দৌড়, সাঁতার, সাইকেল, যোগব্যায়াম করেন নিয়মিত। ব্যাডমিন্টন খেলেন এবং জিমে যান পাওয়ার ট্রেনিংয়ের জন্য। সম্প্রতি আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ৫৮৯৫ মিটার উঁচু মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো জয় করেছেন মেদিনীপুরের এই বিজ্ঞানী। এই অভিযানের নাম দিয়েছিলেন 'এক্সপিডিশন অপরাজিতা'। পৃথিবীর যে সমস্ত মেয়েরা যাঁরা তাঁদের জীবন, অধিকার, সম্মান, স্বপ্ন এবং আবেগ থেকে বঞ্চিত, তাঁদের পাশে থাকার বার্তা দিতেই এই অভিযান। সেইসব মহিলাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন এই জয়। তাঁর কথায়, "আমার কিলিমাঞ্জারো সামিট হল চ্যালেঞ্জিং অভিযানের একটি সিরিজের অধীনে প্রথম অভিযান। যা আমি 'এক্সপিডিশন অপরাজিতা' নামে করলাম। এই 'অপরাজিতা'র অর্থ হল অপরাজেয়। এটি এমন একটি শব্দ যা আমার আত্মার সাথে অনুরণিত হয়। আমি আমার গল্পের খসড়া তৈরি করা শুরু করেছি এবং আমি সৌভাগ্যবান যে পর্বতারোহী সত্যরূপ সিদ্ধান্তের মতো মানুষের সাহচর্যে একটা অসাধ্যসাধন করতে পেরেছি।" সারা ভারতের যতগুলি আই আই টি এবং আই আই এস সি রয়েছে, সেগুলির মধ্যে অর্পিতাই একমাত্র ফ্যাকাল্টি অধ্যাপিকা, যিনি মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো পর্বতশৃঙ্গ জয় করলেন।
বাবা মায়ের সাথে ড. অর্পিতা পাত্র
ড. অর্পিতা পাত্র পেশায় একজন ক্রিপ্টোগ্রাফার এবং আবেগমথিত ফটোগ্রাফার একজন। ক্রিপ্টোগ্রাফার হিসাবে তিনি সুরক্ষিত গণনাতে পটিয়সী। আর একজন ফটোগ্রাফার হিসাবে তিনি প্রকৃতির সবচেয়ে নাটকীয় মুহুর্তগুলিতে তাঁর আত্মাকে বিলিয়ে দেন সাবলীলভাবে। ফটোগ্রাফের মাধ্যমে তিনি চান দর্শকদেরকে একটি গোপন জগতে নিয়ে যেতে। যেখানে রয়েছে সর্বোত্তমতা, নির্মলতা এবং শান্তি। পক্ষপাতিত্ব, বিভাজন, বৈষম্য এবং ভিন্নতার মতো নিম্নক্রম বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁর জীবনে কখনও স্থান পায়না। ছবি আঁকা তাঁর জীবনের আরেকটি সাম্প্রতিক আবেশ। তিনি ছবি তোলা এবং ছবি আঁকাকে দুটি ডানা হিসাবে দেখেন, যা তাঁকে একটি ভিন জগতে উড়তে শক্তি জোগায়।
জীবনের বহু কিছু স্বপ্নের শৃঙ্গ জয় করেও এখনও তাঁর দুই পা মাটিতেই রয়েছে। অত্যন্ত সাদামাঠা জীবনযাপন আর আটপৌরে ঘরানায় বিশ্বাসী এহেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের না আছে অহঙ্কার। না আছে গর্ব। তবে যেটা আছে, সেটা সকলের পাথেয় হওয়া উচিত। এবং তা হল -- কিছু করে দেখানোর অদম্য মানসিকতা। এককথায়, "হাম কিসিসে কম নেহি"!
🍂
0 Comments