জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় / নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় 
    
নির্মল বর্মন 

কথা সাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় কলকাতার ভবানীপুরে ২রা নভেম্বর ১৯১০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ভবানীপুরের বিখ্যাত অনাথনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঘর আলো করে দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য কালীকানন্দ অবধূত নামে যথেষ্ট বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। স্ত্রী বিয়োগের পর উজ্জয়িনের মহাকালেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ মন্দিরে সাধু হয়েছিলেন। পরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চিনসুরায় রুদ্রচন্ডী মঠ প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। কালীকানন্দ অবধূত ১৩ই এপ্রিল ১৯৭৮ এ চিনসুরায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একদা সমাজ  কল্যাণের জন্য বিপ্লবী দলের নাম লিখেছিলেন । প্রায় দু দশক আত্মগোপন করতে দ্বিধাবোধ করেননি।। বস্তুত বাংলাদেশের ফরিদপুর , মায়ানমার, মধ্যপ্রাচ্যে আত্মগোপন করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের কাশিপুর কালী মন্দিরে কিছুদিন পূজারী ও ছিলেন। এমনকি পাকিস্তানের বেলুচিস্থানের হিংলাজ মাতার সুরম্য মন্দির পরিভ্রমণ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
             কথাসাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর ''মরুতীর্থ হিংলাজ'' উপন্যাসের এককালে জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। 
কথাসাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর রচিত উপন্যাস গ্রন্থ :--  ''মরুতীর্থ হিংলাজ'' (১৯৫৫), ''উদ্ধারণপুরের ঘাট'' (১৯৫৬), ''তাহার দুই তারা'' (১৯৫৯), ''ক্রীম'' (১৯৬০) , ''দুর্গম পন্থা'' (১৯৬১), ''ভূমিকালিপি পূর্ববৎ'' (১৯৬৩), ''টয়াঠুংরি'', ''কলিতীর্থ কালিঘাট'', ''উত্তর রামচরিত'', ''পিয়ারী'' (গল্পগ্রন্থ) ইত্যাদি।
             কালীকানন্দ অবধূত এর  ধর্মচর্চার জটিল রহস্য  'বীভৎস ও উদ্ভট রসের অবতারণায়'  অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর  আজও হৃদয় কে টানে। অবধূত সাহেবের 'উদ্ধারণপুরের ঘাট' উপন্যাসটিতে মনস্তাত্ত্বিক রহস্যময় ভাবনা কাজ করছে। " উদ্ধারণ পুরের ঘাট " উপন্যাস টি ''কথাসাহিত্য'' পত্রিকার পাতায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ ঘটেছিল।এই উপন্যাসে সারস্বত 'বাংলার সমাজে হিন্দুদের শ্মশান সম্পর্কিত নানান সংস্কার'  ও  নানা ঘটনা ও চরিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপিত করে সামাজিক মাধ্যমে সচেতন করার প্রবনতা  নজর কাড়ে।, বস্তুতঃ শ্মশান অধিপতি গোঁসাই বাবা বা শিবানন্দ নির্বিকার উদাসীন ও কালজয়ী চরিত্র। এই উপন্যাসে "নিতাই বৈষ্ণবীও চরণ দাসের দেহসম্পর্কহীন ভাবসর্বস্ব ভালবাসা, আগমবাগীশের  ভয়ংকর কি সব  উপাচারে শক্তি আরাধনা, " শ্মশানের স্থায়ী অধিবাসী ডোম- মড়াপোড়ার দল", ও "শবের সঙ্গে আসা আত্মীয়-স্বজনের ক্রিয়াকলাপ" উপন্যাসে বাস্তব রূপ সুচিত্রিত।
🍂
        কথা সাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়  ওরফে অবধূত এর "উদ্ধারণ পুরের ঘাট"   উপন্যাসের বিষয়বস্তু -- কাটোয়া শহর  ছাড়িয়ে গঙ্গার উজানে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এখনোও স্পষ্ট। ঐ স্থান শ্রীচৈতন্যদেবের পার্ষদ উদ্ধারণ দত্ত এর  নামাঙ্কিত। সুতরাং ঘাটটি'  ঐতিহাসিক তথ্য ও মিথ বিশ্লেষণে ভরপুর। সাহিত্যিকের উপন্যাস টানটান উত্তেজনা, ভৌতিক শ্মশান,  জটিল তান্ত্রিকতা বুজরুকি'র  সঙ্গে তান্ত্রিক মহাপুরুষদের যৌনাচার দৃঢ়তার সঙ্গে প্রস্ফুটিত। শক্তিপুজার রীতিনীতি, হাল হকিকত নানা ক্রিয়াকলাপ ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসের পাতায়  নিষ্ঠা ভরে স্থান দিয়েছেন।আরোও তাৎপর্যপূর্ণ চিতার আগুন ও  গৃহজীবনে আগুনের  পার্থক্যটিও সুকৌশলে প্রকাশিত ।
             অবধূত সাহেবের ''মরুতীর্থ হিংলাজ'' উপন্যাস  কালজয়ী  ভ্রমণ কাহিনির প্রেক্ষিত প্রতিষ্ঠিত। একদা উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছিল এবং জনগণের হৃদয় হরণ করেছিল । ভ্রমণ পিপাসুদের  অন্তরের খবর, গোপন‌ রহস্যময়  পাপবোধ ও প্রতি  ব্যক্তির নানাবিধ কার্যকলাপের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা ভ্রমণ ভাবনা কে মনোরঞ্জন করেছে । আসলে উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদ্বয় কুন্তী ও থিরুমল ।  মনুষ্য হৃদযয়ের অন্তর্নিহিত রূপের চিত্রণ ,  অন্তর্দৃষ্টির সত্ত্বায় মানবজীবনের রূপায়ণ এবং নাটকীয় প্রেক্ষিত বিন্যাসে  উপন্যাসটি কালজয়ী ভ্রমণসাহিত্য রূপে চিরস্মরণীয় । 
অবধূত সাহিত্য চর্চায় পরিবেশ ও উদ্ভট ঘটনার সমাবেশে প্রায়ই দেখা মেলে। কথাসাহিত্যিকের ''দুর্গম পন্থা'' উপন্যাসটি আলাদা ভাবনায় রসাস্বাদী। কক্সবাজারের অয়স্কান্ত বকসী'র অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য জীবন কাহিনি, তার গৃহস্থালীর রোমাঞ্চকর পরিবেশ, তার অভাবনীয় ভাগ্য পরিবর্তন, তার মানবিক সম্পর্কের উদ্ভটত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে অবধূত উপস্থাপিত করেছেন।
কথাসাহিত্যিক  দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর "কলিতীর্থ কালিঘাট'' অন্যতম বহুপঠিত  উপন্যাস। কথাসাহিত্যিক উক্ত উপন্যাস  সম্পর্কে নিজেরই মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :-
                       "জীবিত বা মৃত কাউকে এই গ্রন্থে কোনও ঈঙ্গিত করা হয়নি, তীর্থস্থানের এতটুকু অমর্যাদা করার বাসনায় এ গ্রন্থ লেখা হয়নি, শুধু মানুষের গান গাওয়া হয়েছে। সুখে দুঃখে গড়া মানুষ, যে মানুষ তীর্থের চেয়ে বড়, ধর্মের চেয়ে বড়, জীবন ও মরণের চেয়ে ঢের বড়। এ হল সেই মানুষের গাথা।" 
কংসারি হালদার ও  কবনমালী চক্রবর্তী এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। আর শশী ওরফে শশে খাড়া এই উপন্যাসের উপকাহীনী আশ্চর্য ধরনের-অমিত শক্তির অধিকারী।
কথাসাহিত্যিক অবধূত এর "টপ্পাঠুংরি'' উপন্যাসে সাম্প্রতিক সময় ও সমাজের তথাকথিত ভদ্রলোকের মুখ ও মুখোশ খুলে দিয়েছেন। সুপার হিটের মতোই গোপেশ্বর বাবু'র চরিত্র চিত্রন এমনই এক চরিত্র। গোপেশ্বর 'দিনের বেলায় চাকরি'  আর  রাতের বেলায়  ''যোগাভ্যাস'' করে সমাজে  ভালো মানুষই সেজে ছিলেন। হঠাৎ ছন্দপতন কারন‌ একদা "তিনি গুরু ভগ্নী'র ঘরে রাতে ধরা পড়ে গেলেন"- সেদিনই  গোপেশ্বরের মুখ ও মুখোশ জনগণের কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেলো।
      অবধূত এর   ‌"উত্তর রামচরিত'' উপন্যাসে মহানগর  কলকাতা'র চঞ্চলতা ও অস্থির সময়ের ছক ও ছবি ধরা পড়েছে । বস্তুতঃ স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাঙালি জাতি প্রায়ই  শোষিত ও লাঞ্ছিত , তারই সফল চিত্র অঙ্কন করেছেন।
          ছোটগল্পকার দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর ছোটগল্প গ্ৰন্থ "পিয়ারী"  তে   দুটি সুপার হিটগল্প ''পিয়ারী'' ও ''দাবানল''। "পিয়ারী" গল্পে সাধু মোহান্তর জীবানালেখ্য ও কীর্তিকলাপ স্থান পেয়েছে।। 
অপরদিকে ''দাবানল'' এর‌ মতোই। " একান্ত আচারনিষ্ঠ নিত্যবিগ্রহ পূজায় নিবিষ্ট-চিত্ত ও নিয়মিত গঙ্গাস্নানে পবিত্র ত্রিবেদী মহাশয়ের মনোজগতের ভয়াবহ ছবি তুলে ধরেছেন লেখক"
কথা সাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখনীর গুণী বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে একসময় বহু চর্চিত ও সম্মানিত নাম। এ প্রসঙ্গে হংসনারায়ন ভট্টাচার্য এর মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ:-
"উদ্ভট কাহিনী কল্পনা বীভৎস রস তান্ত্রিক ধর্ম সাধনার  গুহ্য রহস্য ও উৎকট যৌনাচার অবধূতের রচনার বৈশিষ্ট্য।"
অবধূ ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছোট গল্প উপন্যাস লেখালেখির ক্ষেত্রে সমাজ ব্যবস্থা জটিল চিন্তা ভাবনাকে তুলে ধরেছে। এ প্রসঙ্গে শিশির কুমার দাসের মন্তব্য প্রদানযোগ্য ,:--
"তার রচনার বৈশিষ্ট্য ভয়াবহ ও বীভৎস রসের আধিক্য প্রবল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কোন কোন সমালোচক তার বিষয়নির্বাচক ও প্রয়োগরীতির প্রতি সংশয়ী ছিলেন"।
কথাসাহিত্যিক দুলাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় একসময় বিরাট জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কালের অমক নিয়মে বর্তমান সময়ের সমাজে বিস্তৃতপ্রায় সাহিত্যিকে পরিণত হয়েছেন।
প্রকাশিতব্য...

Post a Comment

1 Comments

  1. বিস্মৃত প্রায় কথা সাহিত্য পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি, খুব ভালো রকমের লেখা উপহার দিচ্ছেন ড. নির্মল বর্মন।

    ReplyDelete