শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬১ / সালেহা খাতুন
১৯৯৯ এর শেষের দিকে ওড়িশার সুপার সাইক্লোনের সঙ্গে সঙ্গেই ঝড় উঠলো আমাদের জীবনেও। শুনেছি ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির কোনো অভাব নেই। এক চাকরি ছেড়ে অন্য আর এক চাকরিতে জয়েন করা খুবই সহজ এবং সাধারণ ব্যাপার। অতএব বিমিংয়ের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় কাজ করতে না পেরে গৌরীশঙ্কর জুটমিলের চাকরিতে রিজাইন দিলেন সালাউদ্দিন। ব্যানার্জি সাহেব- মুখার্জি সাহেবের মতো সুবিবেচক-সহৃদয় ম্যানেজাররাও নেই, যাঁরা এ যাত্রায় রক্ষকের ভূমিকা নেবেন।
চাকরি হারানোর সাথে সাথে আমাদের বাসস্থানও গেল হারিয়ে। কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হলো। ফার্নিশড কোয়ার্টার। অতএব বড়ো কোনো আসবাব নেই। সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্তর একটা অ্যাম্বাসাডারে ভরে নিয়ে ফেরার পালা। ফিরবো কোথায়? বাপের বাড়ি না শ্বশুরবাড়ি? দু’বাড়ির সঙ্গেই তো গভীর যোগাযোগ। আবেগান্বিত হয়ে ভাই চলে এসেছে আমাদের নিতে। কদিনের তো ব্যাপার, আর একটা জুটমিলে শুধু ঢোকার অপেক্ষা। শরীর একটু সেরে গেলেই উদ্যোগ শুরু হবে।
কয়েকদিন পর শ্বশুরবাড়ি গেলাম। চাকরি হারা ছেলে বউ নিয়ে ঘরে ফিরেছে। শ্বশুরমশাই অস্থির হয়ে উঠলেন। বললেন, "লোকে লোকারণ্য, বাড়িতে পা ফেলার জায়গা নেই। তোমরা বাইরে থাকলেই আমার প্রেস্টিজ বাড়ে”। ইঙ্গিত বুঝে চোখের জল ফেলতে ফেলতে অগত্যা দুজনের সাহাপুরে ফিরে আসা। কারণ কলেজে তখনও পার্টটাইম পড়াচ্ছি। কলেজটা অন্তত কাছাকাছি হবে। এম.ফিল.-এর ডিসার্টেশান পেপারের কাজ তখনও চলছে।
ঘরে ফিরে নতুন অভিজ্ঞতা। দোতলায় ব্যালকনিসহ একটি ঘর অনার্স পড়াকালীন বাবা বানিয়ে দেন আমার পড়াশোনার জন্য। পড়তাম আমি। আর রাতে দু’বোনে ঘুমাতাম। নতুন বাড়িতে ক্লাস এইট থেকেই আমাদের দুইবোনের একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থা। সালাউদ্দিন জীবনে যুক্ত হওয়ায় বদলে গেল ব্যবস্থাটা। বিয়ের পর বাড়িতে গেলে দোতলার ঐ ব্যালকনিযুক্ত ঘরেই আমি-সালাউদ্দিন থাকতাম। কিন্তু এবার ফিরে দেখলাম আমাদের একতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জিনিসপত্তর নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোনের নাকি পড়াশোনায় অসুবিধা হচ্ছে। ধাক্কা খেলাম। অনুভব করলাম জীবনের রঙ রূপ কীভাবে বদলে যাচ্ছে!
বিবাহিত মেয়ে বরকে নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছি, কিছুটা কনট্রিবিউশনের চেষ্টায় সকাল বিকালের জলখাবারের ভার নিলাম কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। দু’একটা জায়গা ছাড়া সালাউদ্দিন নিজে নিজে চাকরির জন্য আর সেভাবে ছোটাছুটি করছিলেন না দেখে, আমার বাবা-ই আমার গ্রামের ভোলাকাকুর মাধ্যমে তাঁর কর্মস্থল হাওড়ার শিবপুরের ফোর্ট উইলিয়াম জুটমিলে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন। সেখানে বেশ ভালো পদে, ওভারসিয়ার রূপে সালাউদ্দিন জয়েন করেন। কিন্তু ফ্যামিলি কোয়ার্টার পেলেন না, থাকার জায়গা হলো ব্যাচেলার কোয়ার্টারে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
আমি পড়ে রইলাম সাহাপুরে। মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম। আর ঐ গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতায় কিছুটা ঘোরাঘুরি করে ঘরে ফিরে আসতাম। দাম্পত্য নির্মাণ-বিনির্মাণের চেষ্টা করতাম। কখনো কখনো এক আধদিন ছুটি পেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে সারাদিন কাটিয়ে আসতাম। অস্বস্তি হতো বাড়িতে থাকতে। তাই সবুজ গাছপালাকে সঙ্গী করে দুজন মিলে দুঃসময় অতিক্রমণের স্বপ্ন দেখতাম। সে সময় তেমন আর্থিক সংগতিও ছিল না যে আলাদা করে নিজেদের নিভৃতাবাসের ব্যবস্থা করা যাবে।
দু’হাজার সালের ষোলো মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী হলে কনভোকেশনে এম. ফিল. অ্যাওয়ার্ডেড হলাম। মাননীয় রাজ্যপাল বীরেন জে শাহ কৃতীদের হাতে সম্মান তুলে দিলেন। আমাদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দিলেন আর্টসের ডীন। সার্টিফিকেট নিয়ে সালাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করলাম। দোলের সময় কয়েকটা দিন একসঙ্গে কাটালাম ফোর্ট উইলিয়াম জুটমিলে। মাত্র তিনমাস স্থায়িত্ব লাভ করে ফোর্ট উইলিয়াম জুটমিলের চাকরি। এরই মাঝে একদিন একটি লেটার হাতে পেলেন সালাউদ্দিন। আশা করেছিলেন ইনক্রিমেন্ট অথবা প্রোমোশন লেটার হবে হয়তো। কিন্তু তাতে লেখা ছিল ‘ইয়োর সার্ভিস ইজ নো মোর লঙ্গার’। তাহলে চাকরি যেমন নিজের ইচ্ছায় ছেড়ে দেওয়া যায়, তেমনি ইচ্ছে থাকলেও চাকরি টিকিয়ে রাখাও যায় না। আবার ফিরে আসা। ঠোক্কর খাওয়া।
মেজোমেসো ও বাবা
ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বরের গরবে মাটিতে পা পড়ে না যে বড়ো ননদের সেই সুহৃদও একদিন নিজের দাদাকে উদ্দেশ্য করে বললে, “দেখ মেজোভাই, তোরা একজন ইঞ্জিনিয়ার আর একজন এম.ফিল. পাশ হয়ে যে রোজগার করতে পারিস না আমি বাড়িতে বসেই কতো উপার্জন করি দেখ”। কেননা সে সময় বরের পয়সায় সে একটি বাস কিনেছে আর বারাসাত-বাদুড়িয়া রোডে তা চলছে এবং তার হিসেবনিকেশের জন্য নিজের বয়স্ক বাবাকে দিনরাত ছোটাচ্ছে। এদিকে বিদেশ থেকে বর বলে পাঠিয়েছেন যে বাসে করে কলেজে যাতায়াত করলে পরপুরুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলতে পারবে না, তাই কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের পড়া শুরু করেই ইতি টানতে হয়েছে তাকে। ননদাই সালাউদ্দিনেরই ছোটোবেলার বন্ধু। তবুও মানসিকতার অনেক ফারাক থেকে গেছে।
কথায় আছে না ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’, যত মানসিক যন্ত্রণাই থাক না কেন ফিরে এলাম সাহাপুরের বাড়িতেই। মাঝে মাঝে ভাবি আমার চরিত্রের বুঝি তেমন গভীরতা নেই। আবার নিজেকে প্রবোধ দিই বারেক হালকা চালে চলি নাহলে জগত সংসারে টিকে থাকাই ভারী কঠিন হয়ে যেতো।
এবার মেজোমেসোর কাছে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের চাকরির উমেদারি নিয়ে পৌঁছলাম। বেশ কিছু দিন অপেক্ষার পর ঢুকে পড়লাম বিখ্যাত কানোরিয়া জুট মিলে। খুব ছোটোবেলায় নকাকার সঙ্গে কানোরিয়া জুটমিলের মালিকের কলকাতার বাড়িতে গিয়েছিলাম। মালিক কন্যার সুদৃশ্য ঘর দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। কানোরিয়া জুটমিল পর্বটা আমার জীবন ইতিহাসের এক অনন্য সময়।
(ক্রমশ)
প্রকাশিতব্য...
0 Comments