বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩২
কচু
ভাস্করব্রত পতি
'রতনে রতন চেনে,
শুয়োরে চেনে কচু'!
সম্প্রতি বাংলাদেশের গণভবন লুঠপাট করার দৃশ্য সমাজ মাধ্যমে দেখতে দেখতে একটা ছবি চোখে পড়ল। গণভবন থেকে সবাই যে যাঁর সাধ্যমতো জিনিস চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে। কেউ হাস, কেউ মুরগি, কেউ বা সোফা, ফ্যান, এসি, ফ্রিজ, আলমারি, শাড়ি, পোশাক আরও কত কি বগলদাবা করে বাড়ির পথে। হঠাৎই দেখলাম, এক সুবেশা মহিলা শাড়ির বদলে গণভবনের কচুর বাগান থেকে কচু শাক 'কচুকাটা' করে কেটে, উপড়ে চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে! এ তো সেই প্রবাদের 'কচু কাটতে কাটতেই ডাকাত' এর সার্থক রূপকার! অন্যভাবে বলতে পারি --
'চুল নেই মাগী চুলেরে কাঁদে,
কচু পাতায় ঢিপলা দিয়ে ডাগর খোঁপা বাঁধে।'
খাদ্যরসিক সেই চোর রাঁধুনিকে দেখে মনে হল কচুশাক তবে মোটেও ফেলনা নয়।
'একতোলো কচুশাক, একতোলো পানি
কচু
আমরাও ছোটবেলায় এভাবেই লুঠ করতাম রাস্তার পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা কচুর জঙ্গল থেকে তাবড় তাবড় কচুপাতা। সেসময় তো আমাদের ছাতা ছিল না, তাই ঐ কচুপাতা মাথায় দিয়েই স্কুলে যেতাম বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে। বইপত্তর ঢাকা দিতাম ঐ কচুপাতা দিয়েই। আর বাড়িতে ফিরে বাঁশকঞ্চি দিয়ে যে খেলার ঘর বানাতাম, সেই ঘরের ছাউনি হত কচুপাতা দিয়ে। আমাদের কাছে যা কিনা ছিল বুর্জ খলিফার চেয়েও দামি বাড়ি। প্রবাদের মাধ্যমে বলতে পারি --
'সে কাল গেছে বেয়ে
এঁটো কচু খেয়ে'।
বাজারে এখন মাছ কিনতে গেলে কচুপাতায় মুড়ে মাছ দেওয়ার রীতি রয়েছে।
'ছেঁড়া কচুর পাত
এক মাগকে ভাত দেয়না
আরেক মাগের সাধ'।
ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়ির উঠোনে পটি করে দিলে বাড়ির মায়েরা সেসব কচুপাতায় মুড়ে তুলে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতেন!
ধানজমির আইলে কচুগাছের বন
আমরা কথায় কথায় বলি 'তোর ঘেঁচু হবে'। অর্থাৎ কিছুই হবে না। আর কিছু না মিললে বলে থাকি 'কচুপোড়া খা'। স্বয়ং সুকুমার রায়ও তাঁর 'খাই খাই' কবিতায় লিখেছেন --
'ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ো নাকো; যেয়ো নাকো ভড়কে, খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়কে।
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা,
খাও তবে কচুপোড়া খাও তবে ঘণ্টা।'
'আলালের ঘরে দুলাল'তে আছে -- 'কচুপোড়া খাও, উঠছি অমনি পেছু ডাকছ'। দাশু রায়ের লেখাতেও আছে কচুপোড়ার কথা -- 'আরে খেলে কচুপোড়া, ভাল সময় ভাল পোড়া'। দেবেন্দ্র সেন 'দগ্ধ কচু'তে লিখেছেন, 'সব রকম কচু কেবল কচুপোড়া বাকি'!
কচুর উৎপত্তি ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ সহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। জলে এবং স্থলে কচুগাছ জন্মায়। তবে স্থলেই বেশি জন্মায়। কচুগাছকে কেন্দ্র করে চলনবিল এলাকায় একটি ছড়া রয়েছে --
'গাছের নাম হোগল মাথা
এক এক ডালে এক এক পাতা'।
অনেকেই ব্যবসায়িকভাবে চাষ করছেন কচু। ভেষজ উদ্ভিদটির বাজারে চাহিদা ভালোই। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কচু উৎপাদনকারী দেশ হল নাইজেরিয়া। এখানে প্রতি বছর প্রায় ৩৩ লক্ষ মেট্রিক টন কচু উৎপাদিত হয়। আমাদের দেশেও ভালোই কচু উৎপাদিত হয়। একসময়ে অতি সাধারণ মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তির কচু এখন উচ্চমার্গীয় মানুষজনেরও প্রিয় সব্জি!
'তোমার নাম রামদাস
আমার নাম পাঁচু।
কিনতে দিলাম গোঁসাইয়ের কলা
কিনে এনেছো কচু'।
কচু বা কচরিকে সংস্কৃতে কচু'র, ওড়িয়াতে সার্, তামিলে করুনাইকিঝাংগু, তেলেগুতে দূরাদাকান্ডাগাড্ডা, মালয়লামে চেনা বলে। কচু হল একপ্রকার কন্দবিশেষ। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Colocasia antiquorum, Colocasia esculenta, Typhonium trilobatum (linn) ইত্যাদি। এটি Araceae পরিবারের অন্তর্গত। । কচুর নানা প্রকারভেদ রয়েছে। (১) বনকচু, ঘেটকচু, ঘণ্টাকর্ণ কচু, Typhonium trilobatum, (২) সারকচু তেলিয়া সার্, C. nymphacifolia, (৩) কাঁটা কচু, Lassia heterophylla, (৪) মানকচু, C. indica, (৫) গুড়িকচু, (৬) কালোকচু, (৭) আতকচু। এছাড়াও রয়েছে
পানিকচু বা জলকচু, পঞ্চমুখী কচু, পাইদনাইল, দুধকচু, শোলাকচু ইত্যাদি। বনে যেসব কচু আপনা আপনি জন্মায় সেগুলোকে বলে বনকচু। এগুলো খাওয়া যায়না। ঘেঁটকচুর সংস্কৃত নাম ঘেঞ্চুলিকা। বাংলায় বলে ঘেঁটকচু বা ঘেঁচু। চলতি ভাষায় বলা হয় ঘেঁটকল। ভারতে মোট ১৬ ধরনের ঘেঁটকচুর দেখা মেলে। ছড়ায় আছে --
'কচুর বেটা ঘেঁচু
বাংলাদেশের গণভবনে লুটপাটের সময় বাগানের কচুগাছ চুরি করলেন এক মহিলা
মুখীকচু পরিচিত দুলি কচু, গুঁড়া কচু, ছড়া কচু, বিন্নি কচু, কুড়ি কচু ইত্যাদি নামে।
'মামীর মা বড় সুখী
পান্তা ভাতে কচুর মুখী'।
পানি কচু বা জল কচু পরিচিত বাঁশকচু, নারিকেল কচু, জাত কচু ইত্যাদি নামেও। কচু গাছ কখন চাষ করা উচিত, তা নিয়ে নানা নির্দেশ রয়েছে। খনার বচনেও মেলে সেসব। মাঘ মাসে মুখীকচু লাগালে ফলন সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু ফাল্গুনে লাগালে চুখি অর্থাৎ ছোটো ছোটো চোখা চোখা কচু হয়। চৈত্রমাসে লাগালে লতা হবে। আর বৈশাখে লাগালে কচু নয়, পাতা বেশি করে হবে। তাই কথায় বলে --
'মাঘে মুখী।
ফাল্গুনে চুখি।
চৈতে লতা।
বৈশাখে পাতা।'
কচু গাছে পাতা বেশি হলে কচুর উৎপাদন পরিমাণ কম হয়। পাতা ও ডোগা কেবল সব্জিরূপে খাওয়া যাবে। কিন্তু কৃষকের লাভ কম হবে। তাই বলা হয় --
'যদি উথাল কচুর পাত।
পাতে রইলো চাষার ভাত'।
কচুগাছ লাগানোর পদ্ধতি সম্পর্কে নবযুগ পঞ্জিকায় আছে --
'কচু বনে যদি ছড়াস ছাই।
খনা বলে তার সংখ্যা নাই।'
ওড়িয়া ছড়াতেও আছে --
'অলুরে খত ছারুরে ছাই।
এহি রূপ ক্রসি করহে ভাই।'
অর্থাৎ কচুজমিতে ছাই ছড়ালে ফলন খুব ভালো হয়। নবযুগ পঞ্জিকায় আরেকটি ছড়া --
'নদীর ধারে পুঁতিলে কচু।
কচু হয় তিন হাত নীচু।'
ওড়িয়া ছড়ায় --
'নদী কুলরে সারু গছঅ। ।
রুপন্তে তিন হাত উচ্চ।'
কচুপাতায় জল পড়লেও পাতা কিন্তু ভেজেনা। তা নিয়ে সুন্দর ছড়া সিলেটের মানুষের --
'তাগ ধিনা ধিন
তাগ ধিনা ধিন
কেউ তো চিনবায় না
রনশার বেটায় গোছল করে
গা ভিজে না'
কুষ্ঠিয়ার লোকেরা কচুপাতার এহেন গুণকে সামনে রেখে বলে --
'ছোট একটি ছেলে ঘাপুর ঘুপুর ডুব পারে
তার নেংটি ভেজে না'।
ময়মনসিংহে শোনা যায় --
'রাজার ব্যাটা ডুব মারে,
গামছা লাগে না।'
কচুর মুল, শিকড় বা লতি, পাতা এবং ডাঁটা দিয়ে অদ্ভুত সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়। কচু গাছের পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। তাই কচুশাককে নিয়ে সিলেটের লোককবির ছড়ায় মেলে --
'ঘরের পাছে কেচকি লতা,
এক একটা ডালে এক একটা পাতা।'
কচুর ডাঁটাও খাবার হিসেবে উপাদেয় সব্জি। সিলেটের লোকজনের মুখে শোনা যায় --
'আকলি করিয়া কও
আকোল বন্দর বেটা
মাথাত তকি দি উবায়
কোন গাছোর ডেটা'।
ভণ্ড ব্যক্তিদের অপমান করতে এই কচুর ডাঁটার প্রসঙ্গ টেনে বলা হয় --
'বিদ্যাশূন্য ভট্টাচার্যের পূজায় বড় ঘটা
বাঁশের পাতা নৈবেদ্য, কচুর ডাঁটা পাঁঠা'।
কচুর লতি দিয়ে চচ্চড়ি এক অন্যতম উপাদেয় খাদ্য।
'ভাদ্র মাসে কচুর লতি
বুড়া হলে সবাই সতী'।
কচু দিয়ে কোরমা, ইলিশ, সরিষা বাটা, চিংড়ির নানা পদ রসুই ঘরে বানানো হয়। তবে গ্রামের মেয়েদের মুখে শোনা যায় --
'পুঁই কচু ঘেসো
তিন আমাশার মেসো।' (ঘেসো -- ঘুঁসো চিংড়ি)
কচু জঙ্গল
কচু শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং আয়রন থাকে। রাতকানা রোগের অন্যতম দাওয়াই। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, হাড় শক্তিশালী করতে, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা মেটাতে, চুল ওঠা আটকাতে ব্যবহৃত হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে আলুর পরিবর্তে কচু খাওয়া যায়।
কচু নিয়ে অসংখ্য প্রবাদ বাংলা ভাষায় উচ্চারিত হয়। যেমন -- অকালে খেয়েছো কচু, মনে রেখো কিছু কিছু; ওল কচু মান, তিনই সমান; কচুর নামেই গলা চুলকায়; পারে না কচু কুটতে, ছুটে যায় এঁটো বাসন ধুইতে; মানুষ হলে বোঝে, কচু হলে সেজে (সেজে -- সেদ্ধ হয়); যেমন আদাড়ে কচু, তেমনি বাঘাটে তেঁতুল; লুভল বামুন কচু খেয়ে, আবার এলো কোদাল লয়ে; কচুবনে খটাশ বাঘ; কচুবনের কালাচাঁদ ইত্যাদি। অমৃতলাল বসু 'যাদুকরী'তে লিখেছেন, 'আমি কচুবনের কালাচাঁদ, ক্যায়সে আমার প্রেমের ফাঁদ'!
🍂
0 Comments