বাইশে শ্রাবণ
পুলক কান্তি কর
সেই সকাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টিধারায় ঝাপসা হয়ে আছে চারপাশ। বোধহয় আবার নিম্নচাপ হয়েছে কোথাও। বর্ষার দিন হলেই কোনও কিছু করতে ইচ্ছে করে না নৈঋতের। বিশেষ করে সকাল সকালই আকাশ আঁধার করে এলে মন কেমন করে ওঠে তার। কত কথা, অকথা ভিড় করে মনে। আগে হলে এমন দিনে কিছু না কিছু অবশ্যই লিখতে বসত সে। বছর সাতেক হল, ওসব লেখাজোখার পাট ঢুকে গেছে। তবু কবির মন হয়তো কোথাও বেঁচে আছে বলে এখনও বর্ষা দেখলে আনমনা হয় সে। অভ্যেস মতো রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান লাগিয়ে ব্রাশ করতে গেল সে আজ। আজকে সকালবেলার তাড়াহুড়ো নেই। সরকার বাইশে শ্রাবণে এবছর ছুটি দিয়েছে৷
চা খেতে খেতে গানের চেনা সুরগুলোয় হঠাৎ হঠাৎ মন স্থির হয়ে যচ্ছিল তার। কী দ্রুত কেটে যাচ্ছে দিন। লোকে বলে সুখের সময় দ্রুত ফুরোয়। সত্যি কি তাই? একটা ফোন আসছে বুঝতে পেরে টিউন বাজার আগেই মোবাইলটা ধরে ফেলল সে, কী ব্যাপার মণি, এত সকাল সকাল ?
-- না, ছুটির দিন তো। ঘুম থেকে উঠেছ কিনা দেখছিলাম।
-- তাই কী? তা তুমি এত সকালে উঠে গেছ যে বড়! মাসিমার তাড়া নাকি?
-- না, না৷ ভোরবেলায় জলের ছাঁট গায়ে লাগতে উঠে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। জানালাটা লাগিয়ে শুয়েও পড়েছিলাম আবার, তবে ঘুম এল না। ভাবলাম বৃষ্টি দেখি। মা সাড়াশব্দ পেয়ে এমন চেঁচামেচি শুরু করল যে জানালা বন্ধ করে বসে রইলাম।
-- মাসিমা চেঁচামেচি শুরু করলেন কেন?
-- ওই কাল থেকে একটু কাশি হচ্ছিল তো। মা বলল, এই বর্ষার হাওয়া নাকি খুব খারাপ। ঠান্ডা লেগে যাবে। আমিও ভাবলাম, সত্যি তো, সামনের মঙ্গলবার আমার একটা প্রোগ্রাম আছে; তাই রিস্ক নিলাম না। তা তুমি এত সকাল সকাল উঠে কী করছ?
-- চা খেতে খেতে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছি।
-- কোন গানটা চলছে? শোনা যাচ্ছে না। একটু জোর করে দাও না।
-- না মণি, এসব গান জোরে শোনার নয়৷
-- কি গান হচ্ছে, সেটা তো বলতে পারো?
-- রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা।
-- কার গলায়?
-- দেবব্রত। এই গানটা ওঁর গলাতেই শুনতে ভালো লাগে।
-- রীতুদা, একটা গান শোনাও না!
-- কোন গান?
-- ধর এটাই।
-- না মণি, আজ থাক। অন্য দিন শোনাব।
-- তাহলে চল না, আজ একটু আ্যাকাডেমিতে যাই। আজ ওখানে বাইশে শ্রাবণের একটা অনুষ্ঠান আছে।
-- আজ মনে হয় সময় হবে না। দুপুর বেলা একটু মিশনে যাব।
-- এই সোমবারে যাবে কেন? কাল যাওনি?
-- না, কাল বুবুন যেতে বারণ করল। বলল ওর কী সব আছে৷ তবে রাতেই ওদের সুপার ফোন করে জানালেন ওর নাকি হঠাৎ শরীরটা খারাপ করেছে৷
-- কখন যাবে ভাবছ?
-- এই এগারোটা, সওয়া এগারোটা নাগাদ।
-- খাবে কোথায়? রাঁধবে নাকি?
-- না, আজ আর রান্নাটান্না করার ইচ্ছে নেই। হোটেলে খেয়েই বেরোব।
-- আমি কি সাথে যাব?
-- আজ থাক।
-- তবে ফেরার সময় ফোন করো; আমি তোমার ওখানে আসব।
-- আজ না মণি। তাছাড়া বুবুনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয় কিনা ঠিক নেই। কখন ফিরব কে জানে! তুমি বরং কাল এসো
-- না, না, আমি বরং অফিস ফেরৎ রবীন্দ্র সদন চলে যাব। ছটা নাগাদ। তুমি ওখানেই এসো।
আজ আর কাউকে কাছে পেতে চায় না নৈঋত। ভেবেছিল সারাদিন শুয়ে শুয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনে কাটাবে। কিন্তু কী করবে? ছেলেটার শরীর ভালো নেই শুনে তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। হস্টেলে যদিও ডাক্তারবাবু রয়েছেন, তবু…
ফোন শেষ হতে নৈঋত আবার গানে মন দিল। বাঁশরির ডাকে কুঁড়ি ধরে শাখে/ ফুল যবে ফোটে নাই দেখা/ তোমার লগন যায় যে কখন/ মালা গেঁথে আমি রই একা -- কী সুন্দর! গায়ে রোমাঞ্চ হল তার। কত মৃত্যু দেখেছেন কবি। কই, তাঁর সৃষ্টি তো থেমে থাকেনি তাতে! হয়তো এজন্যই আজ দেড়শ বছর বাদেও লোকে তাঁকে পুজো করে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফাতেই একটু লম্বা হয়ে নিল সে। পাশেই টিভিটার উপর খেয়ার একটা ছবির দিকে চোখ গেল তার। বিয়ের আগে তোলা। চুলের উপর স্কার্ফ বাঁধা, অনেকটা কাবেরী বসুর মতো দেখতে। অনেকবারই ছবিটা সরিয়ে তাদের দুজনের ছবি লাগাতে চেয়েছে খেয়া, তবে ও রাজি হয়নি। এই ছবিটাই ভালো লাগে তার। উঠে গিয়ে নিয়ে এল ফটোস্ট্যান্ডটা। ইস, কত ধূলো পড়ে আছে ছবিটায়! ফতুয়ার তলাটা দিয়ে মুছতে গেল ছবিটা। “কী গো, ঘেন্নাপিত্তি নেই নাকি তোমার? গায়ের জামা দিয়ে নোংরা মুছছো!” ফটোর ভেতর থেকে ধমকে উঠল খেয়া। একটু হাসল সে। উঠে গিয়ে একটা ডাস্টার নিয়ে এল। পরিস্কার হতেই ঝকঝক করে হেসে উঠল খেয়া। মুক্তোর মতো দাঁত। কী সুন্দর! বোধহয় তার সাথে যখন আলাপ, ছবিটা তখনকার। ছিপছিপে চেহারা। মোটামুটি ফর্সা। নৈঋত তখন ছোটখাটো কিছু প্রোগ্রাম করে। খুব কিছু নামডাক ছিল না তখন। বিভিন্ন কলেজের সোস্যাল, আ্যানুয়েল ফেস্ট, ফ্রেশারস-- এসবেই ডাক পেত তখন। নিজের লেখা গানই গাইত বেশীর ভাগ, তরে রবি ঠাকুরও থাকতেন। একদিন এমনি এক বর্ষার দিনে প্রোগ্রাম শেষ করে বেরোতে যাবে, হঠাৎ শুনল, দাদা, একটা অটোগ্রাফ দেবেন? চমকে গেল সে। এমন অনুরোধ তো কেউ আগে করেনি৷ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, আমায় কিছু বলছেন?
-- হ্যা। এই খাতায় একটা অটোগ্রাফ দিন না!
-- কিন্তু পেন নেই যে! বলেই হাত বাড়াল সে।
-- এবার থেকে সঙ্গে পেন নিয়েই বেরোবেন। যা ফাটাফাটি গান করেন, আপনাকে এরপর থেকে তো সই এর জন্যে মেয়েরা ছেঁকে ধরবে ! কলকলিয়ে উঠল একজন।
-- আমার গান ভালো লেগেছে আপনাদের?
-- খুউ-ব। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত। অন্যজন বলল।
-- কেন, আমার নিজের গানগুলি বুঝি ভালো লাগেনি বিশেষ? একটু আহত হল নৈঋত। রবি ঠাকুরকে প্রতিপক্ষ খাড়া করে অসম যুদ্ধে যেন লড়তে নামল সে।
-- না, না, ওগুলোও ভালো। তবে কিনা বর্ষার দিন তো! ড্রামের সাথে এমন করে বর্ষার গান আগে কখনও শুনিনি৷
ক্ষতে যেন কিছুটা প্রলেপ পড়ল তার। মনটা খুব খুশি খুশি বোধ হল। হেসে বলল, তাহলে সব ক্রেডিট আমাদের ভোলার প্রাপ্য। ইশারায় ভোলাকে দেখিয়ে দিল সে। ভোলা ওদের ড্রাম বাজায়। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। ড্রামে একটা বিট দিয়ে এমন করে মাথা ঝাঁকায় সে, পাবলিক ওতেই মজে যায়।
-- উনি তো ভালো বাজিয়েছেনই। তবে, আপনার ওই নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায় -- অনুপ্রাসগুলোকে এমন করে ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন আপনি -- ভাবতে এখনও কাঁটা দিচ্ছে গায়ে!
মোহিত হয়ে গেল নৈঋত। প্রশংসা সে শুনেছে। তরে সুন্দরী কলেজ বালিকার মুখের প্রশংসার আলাদা দাম। বলল, কী নাম আপনার?
-- খেয়া।
-- বাঃ সুন্দর নাম তো! কে রেখেছিলেন?
-- আমি নিজে।
-- নিজে কেউ নিজের নাম দেয়? অবাক হয়ে গেল সে। বলল, সেটা কিভাবে সম্ভব?
-- খুবই সোজা। কেউ আমার নাম জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি, “খেয়া”। তারাও আমায় এই নামে ডাকে।
-- বাঃ, অভিনব ব্যাপার। এমনটা জীবনে শুনিনি কখনও। আর কোন গান ভালো লাগল আপনার?
-- মোটামুটি সবই। তবে, ‘গহন ঘন ছাইল’ আর ‘বাদল বাউল’ টা বেশী ভালো লেগেছে।
-- আপনি রবীন্দ্র সংগীত খুব ভালোবাসেন বুঝি? গান শেখেন?
-- শিখি না৷ তবে আপনার গলায় গান শুনে মনে হল, আজই হারমোনিয়াম কিনে শিখব। আপনি শেখাবেন?
হাসল নৈঋত।-- আমি তো গান শেখাই না।
-- এ ভারি অন্যায়। যা আপনি এত ভালো পারেন, তাকে তো ছড়িয়ে দেওয়া উচিৎ।
-- কোনওদিন শেখাইনি তো!
-- কোনও জিনিস কোনও না কোনও সময়ে প্রথমবারই হয়। ধরুন আমিই আপনার প্রথম ছাত্রী। কবে থেকে শেখাবেন বলুন?
-- আমার তো বিশেষ সময় হয় না। আমার এক বন্ধু ভালো গান শেখায়। ওর কাছেই শিখুন না!
-- শুনুন, শিখলে আপনার থেকেই শিখব। যদি আপত্তি না থাকে, তবে ফোন নাম্বারটা দিন। খেয়া হাতের খাতাটা বাড়িয়ে দিল।
সেই শুরু। না, গান শেখা আর হয়নি খেয়ার। তরে সারা কলকাতার যেখানে গান, কবিতা, নাটকের অনুষ্ঠান হত, শনি-রবিবারে নৈঋতের কোনও শো না থাকলে দেখত তারা। খেয়ার বাবা-মা বেশ ভালো মানুষ। কোনও দিন মেয়ের সাথে ওর মেলামেশায় আপত্তি করেননি। কলেজ শেষ করে এম.এস.সি পড়তে পড়তেই বিয়ের প্রস্তাব দিল খেয়া। ইউনিভার্সিটি শেষ হতে বুবুন। তবে, যখন বুবুন হল, দু'জনের মাথায় হাত। কী হবে? ছেলের নাম তো ভাবেনি তারা! আসলে নৈঋত আর খেয়া উভয়েই যেন জানতো, ওদের মেয়ে হবে। বহুদিন থেকে নামও ঠিক করে রেখেছিল তারা৷ পূরবী। রবি ঠাকুর থেকেই নেওয়া। ওদের জীবনে উনিই কমন ফ্যাক্টর। আবার রবীন্দ্র রচনাবলী খুলে বসল নৈঋত। ভেবেটেবে ঠিক করল, রাজর্ষি হলে কেমন হয়?
-- ওটা খুব কমন৷ বরং নাম দাও, নক্ষত্র। নক্ষত্র চট্টোপাধ্যায়। তোমার নামের সাথেও মিল হবে।
--কী করে?
-- দু'জনেই ‘ন'।
ছেলের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ল নৈঋতের। ছেলেটা কেমন আছে কে জানে? তেমন হলে সুপারকে বলে কয়ে না হয় ক’দিন ওকে কাছে এনে রাখবে সে। হঠাৎ শুনল, ওর গলায় “আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে” কোথায় যেন বাজছে৷। ওর মনে পড়ল, দু'দিন আগে মণি ওর মোবাইলের রিং টোনটা বদলে দিয়েছে। এখনও অভ্যেস হয়নি নতুন টোনে। চিনুর ফোন।
-- কী খবর চিনু?
-- সকালের পেপারটা দেখেছ?
-- না, এখনও দেখিনি।
-- দু'নম্বর পাতার “স্মৃতির উদ্দেশ্যে"টা দেখো।
-- গত ছ’বছর ধরেই তো দেখছি। সেই একই কথা৷ নতুন করে আর কী দেখব?
-- না, না, এবারেরটা অন্য রকম। একই ছবি দিয়ে দু'বার দু'রকম বক্তব্য। একটা মামা-মামীর। ওই আগের বছরের মতই – ‘মামণি, তুই যেখানে আছিস শান্তিতে থাক, প্রবঞ্চকদের থেকে দূরে। তোর মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, ঈশ্বর তাদের ক্ষমা করবেন না।‘ আর অন্যটায় এবার রমেনদা আর বৌদি লিখেছে, ‘বোন, পৃথিবীর আদালতে হয়তো তুই সুবিচার পেলি না, কিন্তু ঈশ্বরের আদালতে খুনীদের সাজা হবেই’।
-- হঠাৎ এবার রমেনদারা আসরে নামল?
-- এইটা তোমায় জানাব বলেই তো ফোনটা করলাম। মনে হচ্ছে, ঈশ্বরের আদালতে ভরসা করছে মানে আপার কোর্টে আর আপিল করবে না।
-- তাই যেন হয় চিনু। এই লড়াই আর নিতে পারছি না আমি। এই ছ'বছর ধরে ঘরে বাইরে যুদ্ধ করতে করতে বড় ক্লান্ত হয়ে গেছি রে!
-- একটা কথা জিজ্ঞাসা করব রীতুদা? অবশ্য সত্যি উত্তরটা তুমি নাও দিতে পারো।
-- বল, কী জানতে চাস।
-- তোমার পক্ষে রায় বেরিয়েছে বলেই জানতে চাইছি। নইলে হয়তো...
-- আরে বলই না কী?
-- প্রতি বছর এই বিজ্ঞাপনটা পড়তে পড়তে ভাবি, সত্যিই ঈশ্বরের আদালত হলে কি তুমি বেকসুর পেতে?
-- দ্যাখ চিনু, তুই আমার পক্ষে এই কেসটা এতদিন লড়লি, আমি তো তোকে কিছুই গোপন করিনি।
-- রীতুদা, আমরা যখন কেস লড়ি, সত্যি-মিথ্যে দেখি না। আমরা বিপক্ষের উকিলের সাথে বুদ্ধির লড়াই করি৷ শুধু দেখি, আইন দিয়ে আমাদের মক্কেলকে বাঁচাতে পারব কিনা। তোমার ক্ষেত্রেও আইনের ফাঁক-ফোঁকর আর তার সাপোর্টটাই কেবল দেখেছি। তুমি জিতেও গেছ। কিন্তু খেয়া আমার বোন ছিল, প্রিয়ও ছিল খুব। সেজন্যেই শুধু জানতে চাই, আমি কি সত্যের পক্ষে লড়েছি?
-- তোর মনে যদি দ্বিধা ছিল, তবে তোর মামা-মামীর পক্ষ নিয়েই দাঁড়ালি না কেন? তাতে তো তোদের দুই পরিবারের মধ্যে ফাটল ধরত না !
-- সেটা অন্য ইস্যু। সমস্ত কেস এভিডেন্স যে সত্য ছিল এবং তোমার পক্ষে ছিল, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু খেয়ার আত্মহত্যার পেছনে তোমার প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কোনও ভূমিকাই নেই বলতে চাও?
-- তুই কি মণির দিকে ইঙ্গিত করছিস?
-- মামা এবং মামী দুজনেই তাঁদের সাক্ষ্যে তোমার সাথে মণির পরকীয়া সম্পর্ককেই এই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন৷ তুমি কি এই সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারো?
-- দ্যাখ চিনু, আজ সাত বছর পরে আমার আজকের অনুভূতি দিয়ে তখনকার সম্পর্ককে বিচার করলে হয়তো সত্যের প্রতি সুবিচার করা হবে না। তবু, যতটা নিরপেক্ষ থাকা যায়, সেই জায়গা থেকে বলি, আমার সাথে মণির তখন কোনও প্রকার শারীরিক বা মানসিক সম্পর্ক ছিল না।
-- কিন্তু মামা-মামী তো বিচক্ষণ মানুষ, বিচার বুদ্ধিহীন নন। তাঁরা এটাকেই এতটা সত্যি বলে বিশ্বাস করলেন কেন?
-- মানুষ যে কোনও ঘটনার পেছনে কোনও কারণ খুঁজে পেতে পারলেই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করে। তাছাড়া সন্তান স্নেহও একটা ফ্যাক্টর। প্রিয় সন্তানের মৃত্যু যেকোনও স্থিতধী মানুষকেও বুদ্ধিহীন করে দেয়। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র এত বিচক্ষণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সন্তানদের কৃতকর্মকে অনেক সময়েই সজ্ঞানে প্রশ্রয় দিয়েছেন।
-- তোমার কী মনে হয় না, খেয়া তার বাবা-মাকে মণির সাথে তোমার রিলেশন নিয়ে কিছু বলতে পারে?
-- হয়তো বলেছে। তবে আমি কোনওদিন আঁচ পাইনি।
-- মণির সাথে সময় কাটানো নিয়ে খেয়া কোনওদিন কিছু বলেছে?
-- না৷ আসলে ও খুব চাপা স্বভাবের ছিল তো! মনের কথা মুখে আনতো না।
-- মণির কথা বাড়িতে আলোচনা হত না?
-- হত। আমার দলে ও ফিমেল সিঙ্গার ছিল। গান নিয়ে বা কোনও প্রোগ্রাম নিয়ে কোনও কথা উঠলে ওর কথাও উঠতো।
-- খেয়া কি মণিকে সহ্য করতে পারছিল না বা তার প্রতি জেলাস হয়ে উঠছিল?
-- তুইই তো বহুদিন আমার বাড়িতে মণিকে আসতে দেখেছিস। তোর কখনও এমনটা মনে হয়েছে কী?
-- না। বরং খেয়ার সাথে ওর বেশ বন্ধুত্ব ছিল বলেই মনে হতো। আচ্ছা, শেষ দিকে তোমার সাথে খেয়ার সম্পর্ক কেমন ছিল?
-- দ্যাখ, আমাদের দুজনের ভালোবাসার কমন জায়গাটা ছিল গান আর কবিতা। বুবুন হওয়ার পর অবশ্য এসব নিয়ে দুজনের মত বিনিময় হতো না। তবে সব সম্পর্কের মধ্যেই নতুন নতুন সম্পর্কের জায়গা তৈরি হয়। আমাদের মধ্যেও তাই হয়েছিল। কোনও অসদ্ভাব তো ছিলই না, বরং বেশ একটা সুখি সুখি হাওয়া ছিল আমাদের ঘরে।
-- হ্যাঁ, সেটা তো আমরাও টের পেতাম। আমরাও নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম, তোমাদের মতো জুড়ি কোথাও দেখা যায় না। তবে, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ওকে বেশ বিষণ্ণ দেখাত।
-- আসলে আমার ব্যস্ততাও বোধহয় একটা বড় কারণ ছিল। অফিস শেষ হলে রিহার্সাল। কোনও কোনও দিন প্রোগ্রাম থাকলে দেরি করে বাড়ি ফেরা – ও খুব বোর হয়ে যেত।
-- ও কি বাড়ি থেকে বার হত না?
-- খুবই কম। আগে আমরা নিয়ম করে উইক এন্ডে কোনও প্রোগ্রাম দেখতাম। মাঝে মাঝেই ছোটখাটো ট্যুর করতাম। বুবুন হওয়ার পর সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
-- তুমি যখন ওর বোর হওয়াটা ফিল করতে, সঙ্গ দেওয়ার কথা ভাবোনি কেন?
-- দ্যাখ চিনু, প্রতিটি পেশা এবং খ্যাতি জীবন থেকে সময় দাবী করে। তুই নিজেও বুঝিস। আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। যেদিন পারতাম, সেদিন ও খুব খুশি থাকত। কোনও করণে দেরি হলে, মুখে কিছু বলত না বটে, তবে মুখ ভারি করে রাখত। ওকে সব সময় খুশি রাখতে হলে আমাকে প্রোগাম করা ছেড়ে দিতে হত।
-- তোমরা রিহার্সাল কোথায় করতে?
-- আগে ভোলার বাড়িতে হত। ওখানে তুইও গেছিস। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মণির বাড়িতে ব্যবস্থা হয়েছিল।
-- সপ্তাহে ক’দিন তুমি মণির বাড়ি যেতে?
-- মাঝে প্রোগ্রাম না থাকলে, ধর দু'দিন।
-- মণির বাড়ি যাওয়া নিয়ে খেয়া কখনও কিছু বলেনি?
-- একবারই বলেছিল। সেদিন বাড়ি ফিরতে প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছিল। গিয়ে দেখি, বুবুন ঘুমিয়ে পড়েছে। খেয়া গম্ভীর। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু হয়েছে? মুখ ভার কেন?’ ওকে চুপ দেখে আবার বললাম, ‘খেয়া, সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফিরে রোজ রোজ মুখ ভার দেখতে ভালো লাগে না।‘ তখন ও বলেছিল, ‘কাজ মানে তো মণির সাথে আড্ডা মারা!’
-- তুমি কী বললে তখন?
-- আমি শুধু বলেছিলাম, ‘ছি, খেয়া, এ কথা তোমার মুখে মানায় না।‘
-- আর কিছু বলোনি?
-- না।
-- এই শুনে খেয়া কী বলল?
-- কিছু বলেনি। এই নিয়ে দ্বিতীয় কোনও দিনও কোনও কথা তোলেনি।
-- তুমি কখনও খেয়াকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছ ?
-- আরে যদি বুঝতাম ওর ডিপ্রেশন এই জায়গায়, তবে কি আর দেখাতাম না? ভাবলাম, বুবুনটা একটু বড় হয়ে গেলেই ওর অনেক ঝামেলা কমে যাবে। বাইরে বেরোতে পারবে। হাসিখুশি হয়ে যাবে আগের মতো।
-- যখন ঘটনাটা ঘটল, তখন সত্যি তুমি বাড়ি ছিলে না, নাকি তোমার সামনেই ঘটেছে?
-- চিনু, তুই জানিস, সেদিন বাইশে শ্রাবণের তিনখানা প্রোগাম ছিল আমার। এই এভিডেন্স কোর্টেও পেশ করেছিস তুই। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে প্রোগ্রাম শেষ হতেই প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। এত রাত আর ঝড়জলের দিনে মণিকে একাই বা বাড়ি ছেড়ে দিতাম কী করে? ওকে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরি, তখন প্রায় একটা বাজে। দরজা খুলে দেখি, এই কান্ড! তখনই তো তোকে ফোন করি।
--তুমি যে মণিকে বাড়ি দিতে যাচ্ছে, সে কথা কি খেয়াকে জানিয়েছিলে?
-- হ্যাঁ। রাত অনেক হয়েছিল। ও চিন্তা করবে বলে ওকে বলেছিলাম খেয়ে শুয়ে যেতে।
-- কিন্তু খেয়া গলায় দড়ি দেওয়ার আগে দরজায় ছিটকিনি লাগাল না, এটা কী বিশ্বাসযোগ্য?
-- কেন লাগায়নি, তা তো বলতে পারব না। তবে দরজায় নাইট-ল্যাচ লাগানো ছিল। আমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকত। দেরি করে ফিরলে, তাই দিয়েই ঘরে ঢুকতাম।
-- মামা-মামীর সাথে কী এই ঘটনা নিয়ে পরে কোনও কথা হয়েছে?
-- না। কোর্টে ওঁরা আমার দিকে তাকিয়েও দেখতেন না। তবে আমি ভাবছি এবার একদিন ওঁদের বাড়ি যাব। খেয়াকে বিয়েতে যে সব গয়নাগাঁটি দিয়েছিলেন, সব ফেরৎ দিয়ে আসব।
-- কিন্তু ওঁরা তো এসব ফেরৎ চাননি?
-- চান নি ঠিক। তবে যার জন্য এই গয়নাগাঁটি, সেই যখন নেই, আমি ওসব নিয়ে কী করব?
-- যেয়ো না রীতুদা, হয়তো অপমান করবে তোমায়!
-- করলে করবে। আজকাল মান-অপমান আর আমাকে ছোঁয় না।
-- এসব জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কী আমার উপর রাগ হচ্ছে খুব?
-- কার কার উপর রাগ করব চিনু? নিজের উপর, খেয়ার উপর, মণির উপর? আজ সব প্রিয়জনও আমায় সন্দেহের চোখে দেখে। শ্বশুর-শাশুড়ীর চোখে আমি খুনী। শ্রোতাদের কাছে আর আমার কোনও ইমেজ নেই। কার কার উপর রাগ করব বল?
ফোনটা রেখে সোফায় এসে বসল নৈঋত। খেয়ার ফটোটা এখনও সোফার উপর পড়ে। আস্তে আস্তে ফটোটাকে হাতে নিল সে। তারপর প্রচণ্ড রাগে, দুঃখে, যন্ত্রনায় ঝাঁকাতে লাগল তাকে, ‘বল খেয়া, কেন, কেন এমন করলে? কেন আমায় নামিয়ে দিলে এমন কলঙ্কের পাঁকে?’ কোনও জবাব দিল না খেয়া। শুধু ফটোর মধ্যে থেকে মুক্তোর মতো দাঁতের সারি দিয়ে হাসতে থাকল, হাসতেই থাকল।
0 Comments