জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়/ বত্রিশ পরিচ্ছেদ /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
বত্রিশ পরিচ্ছেদ 
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 


বিরজার তো এখন সময়ের তাল জ্ঞান নেই, কখন যে সকাল হয়, অথবা বিকেল,তা অনেক সময়েই খেয়াল থাকে না আজকাল তাঁর। শুধু যখন ও পাড়ার মালেদের বোষ্টুমীবৌ এসে বেডপ্যান দেয়,প্রাত্যকৃত্য মিটিয়ে কাপড় ছাড়িয়ে গা-হাত-পা মুছিয়ে, মাথা ধুইয়ে দেয়, তিনি বুঝতে পারেন সকাল হয়েছে।
এমনিতে গ্রামে ঘরে এখনও এসব কাজ করার মানুষ বিশেষ পাওয়া যায়না, ভাগ্যিস বোষ্টুমী বৌ কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়ার কাজ পেয়েছে, বেশি পয়সার বিনিময়ে ভাইপোয়েরা তাকে ব্যবস্থা করতে পেরেছে, প্রতি সকালে কাজে যাওয়ার আগে এই কাজটি সে করে যায়।তা নইলে তা বড়ো লজ্জার ব্যাপার হতো বিরজার নিজের কাছে, খানিক চেতনায় ফিরলেই এমনটাই ভাবেন বিরজা।
তো আজও পরিচ্ছন্ন করে বাইরের দাওয়ায় তাঁকে পৌঁছে দিতেই ঘোলাটে চোখে চেয়ে দেখেন,উঠোন জুড়ে মেয়ে বৌরা জটলা করে কি যেন সব করছে।
অস্পষ্ট গলায় নতুন বৌমার কাছে কিছু জানতে চাইতেই জবাব আসে,
-’মনে নেই পিসিমা,আজ যে জয় মঙ্গলবার! এক্ষুনি দিদিভাই তো আপনার গুছিয়ে দেওয়া তল্পি খুলেই সব বার করে দিলো।আপনাকে খাইয়ে দিয়েই স্নান সেরে আমি কাঁঠাল পাতার খিলি বানাবো সবার জন্য। আমি তো বাকি সব জানিনা এখনও, দিদিভাই দেখিয়ে দেবে বলেছে।’
তারপরেই সকালবেলার আলোর মতো হাসিমুখের নতুন বৌ,চায়ের বাটি আর বিস্কুটের টুকরো চামচ দিয়ে খাবার তোড়জোড় করে।মিষ্টি মিষ্টি গরম জল,তার সঙ্গে ভেজানো নরম মতোন কিছু…ইদানিং দিন শুরুর আবছা ছায়া এভাবেই এসে পৌঁছায় তাঁর মনে, কখনও আবার তাও পৌঁছায় না।চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি কোন একটি জায়গায় আটকে থাকে শরীর,মন। ভালো থাকলে মনে পড়ে এপারের কথা, কখনো বা মনেই পড়ে না চারপাশের ঘটনাবলীর কথা…
সেদিনও যেমন হঠাৎ মনে পড়ে গেল,জীবনের প্রথম ভ্রমণ,থুড়ি তীর্থভ্রমণ শেষে বিরজা বাড়ি ফিরলেন যে বিকেলবেলা, জষ্টিমাসের জ্বালাপোড়া ধরা সেই বিকেলের কথা। যাওয়ার সময় যেমন তেমন, ফেরার সময় বাড়িটি যেন খুব টানছিল তাঁকে।জষ্টিমাস পড়ে গেছিল,সামনেই চাষের মরসুম,গোয়ালে ভরা গাভীন…বাড়িতে মেজদাদা ছাড়া আর কেউ নেই; এই সব দুশ্চিন্তা বড়ো উতলা করেছিল তাঁকে।তাই হয়তো কলকাতায় ছোট দাদার বাচ্চাগুলির কাছে একটি দিনও না কাটিয়ে সরাসরি পিসিমাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছেছিলেন বিরজা;বড় ভাইপো এসেছিল দিদিমা ও পিসিমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।

🍂

মনে আছে,সেদিনও ছিল সোমবার। পাঁশকুড়ার আগ পর্যন্ত ট্রেনে এসে, নৌকা পেরিয়ে হতক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ঢুকলেন,জষ্টিবিকেলের আলো তখনও মরেনি। অনেকদিন পরে,প্রিয় পরিবেশ দেখা,সবাই যেন তার পথ চেয়েই বসেছিল।আসতে না আসতেই বৌদিদির হাসিমুখ,
-’ভালোয় ভালোয় ফিরেছ সবাই,এই আমার সুখ!ভালো আছো তো?’
মন ভালো করে দিয়েছিল তাঁর। তবে পরমুহুর্তেই  মেজবৌদিদির গলা এখনও কানে বাজে,
-’এলে ঠাকুরঝি!উফ্!বাবা!বাঁচলুম’
-’কেন গো! তুমি মরেছিলে এমন খপর তো আমার কাছে ছিলনি…’
-’আহা!রাগ করো কেন ঠাকুরঝি!কাল মঙ্গলবার, সামনেই আসছে আবার বিপত্তারিনী, তুমি না থাকলে চলে,বলো! আমরা বুঝি কখনো এসব করেছি!’
শুনে খানিক রাগ হয়েছিল প্রথমে, চিরকালের প্রতিবাদী মেয়েটির মন বলতে চেয়েছিল…কেন করোনি?কে করতে বারণ করেছে? আমিই বা করতে বাধ্য কেন?’
তারপরেই নিজেকে সংযত করেছিলেন,একে তো বৌদিদির মাকে নিয়ে  এসেছেন,যতই হোক,তিনি এবাড়ির কুটুম। তাছাড়া সবাই কি আর এক হয়!হাতের পাঁচটি আঙ্গুলও তো সমান হয়না,কাজে বা গুণে…জ্যাঠাইমা তো তাঁকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন!জীবনেও তাঁর অমর্যাদা করা অসম্ভব বিরজার পক্ষে…
তাছাড়া মেজবৌদিদি চিরকালের অবুঝ,তার বিবেচনা বোধ নেহাতই কম;কি আর করা যাবে!
তা নাহলে,একই বাড়িতে থাকা দুই বধূ দুই চরিত্রের হয় কি করে!
যাহোক,তাৎক্ষণিক মনখারাপ ঝেড়ে ফেলে স্নান সেরে খানিক খাওয়া দাওয়া সেরে তিনি আবার নিত্য কর্মে ফিরেছিলেন।গরু দোয়া, সন্ধ্যা দেওয়া,বড়ো ভাইপোর পছন্দের রান্নাবান্না ইত্যাদি ইত্যাদি…
উনুনধারের আঁচে পুড়তে পুড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল ক’য়দিন আগেই ফেলে আসা রূপকথার মতো সেইসব ধর্মশালার হিমেল সন্ধ্যাগুলির কথা…
তবে,বাড়ির কেউ জানতেও চায়নি এতদিন কেমন ছিলেন,কি রকম ঘুরলেন,কোন কোন মন্দির…
শুধু রাতের বেলা সবার খাওয়া হলে বৌদিদি এসেছিল বিরজার ঘরে,
-’তারা?কেমন ঘুরলে গো, তীর্থ!’
বিরজার মন তো আকুলি বিকুলি করছিল, সবকথা বলার জন্য, সুযোগ পেয়েই বন্যাধারার মতো কথার স্রোত উথলিয়ে উঠেছিল। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী,যমুনোত্রী, হরিদ্বার…
ক্রমে রাত বাড়ে,মাটির চার দেওয়াল ঘেঁসে জমে ওঠে থোকা থোকা অন্ধকার,লন্ঠনের বাতিতে তেল কমে আসে,জানলার বাইরে খন্ড খন্ড মেঘের ছায়া,কাল পেঁচা ডেকে উঠে দূরে…দুটি অসমবয়সী নারীর পারস্পরিক কথোপকথন তবু শেষ হয়না। স্বপ্নদ্রষ্টার মতো একজন বলে চলে তার বদলে যাওয়া নতুন চোখে দেখা নতুন পৃথিবীর গল্পের কথা, অনাস্বাদিত সম্পর্ক বন্ধনের কথা… অন্যজন শোনে, কিছু বোঝে, কিছু বা বোঝেনা।
শুনতে শুনতে বৌদিদির প্রশ্ন,
-’পাহাড় কেমন দেখতে গো! বর্ষা আকাশে পরপর সাজিয়ে তোলা মেঘের মতো?’
-’না,না বৌদিদি;পাহাড় হলো গিয়ে,হলো গিয়ে…’
কথা হারিয়ে ফেলেছিল বিরজা;দেখার আগে সেও তো জানতো পাহাড় বুঝি মেঘের মতো, কিন্তু এখন দেখার পরে সে ভাবে,মেঘ নয়,হাতিও নয়,পাহাড় তো এক বিস্ময়ের নাম;এক স্বপ্নের নাম;যার টানে ঘর ছাড়া যায় বারংবার ,যার পায়ে অক্লেশে উৎসর্গ করা যায় আমাদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবনভার …(ক্রমশঃ)
প্রকাশিতব্য...

Post a Comment

0 Comments