ভোলগাগ্রাদের নদীবন্দর
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৫
বিজন সাহা
আবারও ভোলগাগ্রাদে
এলিস্তা থেকে আমরা আবার রওনা হলাম ভোলগাগ্রাদের পথে। ভোলগাগ্রাদ হয়েই তুলনামূলক কম সময়ে মস্কো যাওয়া যাবে, তাই এই ব্যবস্থা। তবে এই রাস্তার প্রকৃতি আস্ত্রাখান এলিস্তার পথের পাশের প্রকৃতি থেকে ভিন্ন। রাস্তার দুই দিকের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ভোলগাগ্রাদের দিকে, মস্কোর দিকে। এভাবে ফেরার প্ল্যান আমাদের আগে থেকেই করা ছিল। তাই আস্ত্রাখান যাওয়ার পথে যখন ভোলগাগ্রাদে ছিলাম তখন ইচ্ছা করেই কিছু কিছু প্রোগ্রাম বাদ দিয়েছিলাম। যেহেতু আমরা থাকতাম ভাড়া বাসায় আর আগে থেকে না বাসার ঠিকানা, না এর অবস্থা কিছুই জানা ছিল না, তাই এটাও ছিল এক ধরণের অ্যাডভেঞ্চার। দেমিদ এবার বাসা ঠিক করল খুবই নিরিবিলি এক এলাকায়। রাতে যখন খাবার কেনার জন্য গেলাম তখন সেটা টের পেলাম। যাহোক, কোন এক কারণে আমরা সরাসরি বাসায় না গিয়ে লাগেজ নিয়েই ঘুরতে গেলাম, মানে লাগেজ গাড়ির ভেতরেই ছিল। খুব সম্ভব যারা বাসা ভাড়া দেবেন তারা আগে দেখা করতে পারবেন না সে কারণে। তাই ভোলগাগ্রাদ এসে আমরা সোজা চলে গেলাম শান বাঁধানো ভোলগা তীরে।
ভোলগাগ্রাদের বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার ভিক্তর লোসেভ
ভোলগাগ্রাদের নাবেরেঝনায়া বা শান বাঁধানো তীর শহরের প্রধান পায়েচলা পথ, ঠিক যেমন আরবাত মস্কোয়। জার্মান বাহিনীর হাত থেকে স্তালিনগ্রাদ উদ্ধারকারী ২৬ আর্মি ডিভিশনের নামানুসারে নদী বন্দর থেকে নৃত্যরত সেতু পর্যন্ত বিস্তৃত এই ঘাঁটের নাম রাখা হয় ৬২ আর্মি ঘাঁট। ভোলগার উপরে ২৫১৪ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটিতে ২০১০ সালের ২০ মে বিকাল ৫.৪৭ থেকে ৭.৩০ মিনিট পর্যন্ত ৩০ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার পর্যন্ত উঁচু ঢেউ খেলে যায়। এরপর থেকেই লোকমুখে এই সেতুর নাম হয় নৃত্যরত সেতু। এই বাঁধের রয়েছে দুটি সোপান – উপরের সোপানটি আবাসিক এলাকা, বিভিন্ন পাবলিক বিল্ডিং ও পার্ক সংলগ্ন। লোকমুখে এর প্রচলিত নাম ভিক্টরি পার্ক। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত সবুজ গলি আর রেস্টুরেন্ট মাইয়াক। নীচের সোপানটি থেকে সরাসরি নদীতে নেমে যাওয়া যায়। এখানেই ভোলগাগ্রাদের নদীবন্দর যেখানে বিভিন্ন জাহাজ ও নৌযান এসে নোঙ্গর করে। এপ্রিল ও মে মাসে ভোলগাগ্রাদের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র জল ছাড়ার সময় নীচের সোপান ও আশেপাশের রাস্তা, ফেরিঘাট, বাগান সবকিছু জলের নীচে চলে যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এপ্রিল – মে মাসে রাশিয়ায় বরফ গলতে শুরু করে। ফলে ভাটি অঞ্চলে প্রায়ই বন্যা হয়। যে সমস্ত নদী দক্ষিণ সাগরে মানে কৃষ্ণ সাগর, কাস্পিয়ান সাগরে পড়ে সেখানে সময় মত স্লুইজ গেট খুলে বা বন্ধ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। আর যেসব নদী উত্তর সাগরে পড়ে সেখান বিস্ফোরক ব্যবহার করে নদীর ভাটি অঞ্চল পরিষ্কার করা হয়। উত্তরাঞ্চলে বরফ দক্ষিনাঞ্চলের চেয়ে অনেক পরে গলে বলে এই ব্যবস্থা। সেই অর্থে রাশিয়াকে শুধু বন্যার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যও একটি আলাদা বাহিনী ও প্রচুর বিস্ফোরক রাখতে হয়। ভোলগাগ্রাদের কেন্দ্রীয় ঘাঁট শহরের সবচেয়ে সুন্দর পার্কের একটি যেখানে শহরের বেশিরভাগ সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানেই অবস্থিত সেন্ট্রাল কনসার্ট হল। সামারে এখানে বিভিন্ন ধরণের ভ্রাম্যমাণ সার্কাস, সামার ক্যাফে ইত্যাদি কাজ করে। ভোলগা নদীর দক্ষিণ তীর বরাবর অবস্থিত প্রশস্ত রাস্তা শহরবাসীদের প্রিয় জায়গার একটা।
এই বাঁধের মূল আকর্ষণ ১৯৫৮ সালে ভাস্কর আলেশিন ও স্থপতি শালাশভের তৈরি ফোয়ারা গণ মৈত্রী, যদিও বর্তমানে সেটা ইস্কুস্তভা বা আর্ট নামেই বেশি পরিচিত। লোকজ পোশাক পরিহিত নৃত্যরত তিন মহিলার আকারে এই ফোয়ারা থেকেই শুরু হয় সবুজ গলি। এখানে রয়েছে বেশ কিছু মনুমেন্ট। স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক বৈমানিক ভিক্তর খলজুনভের মনুমেন্ট ১৯৪০ সালে এখানে স্থাপিত হয়। এছাড়াও আছে ভোলগার সাহসী নাবিকদের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত রণতরী গাসিতেলের মনুমেন্ট। বিংশ শতকের শুরুতে তৈরি এই রণতরী দুটি যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৪২ সালে একে ডুবিয়ে দেয়া হয়। তবে এক বছর পরে তুলে মেরামত করা হয়। গাসিতেল আরও ২০ বছর কর্মরত ছিল। ১৯৭৭ সালে এটা মনুমেন্ট হিসেবে স্থাপন করা হয়। এছাড়াও এখানে রয়েছে যারা ভোলগা ফ্লটে কাজ করত সেই নাবিকদের সাথে প্রথম পিওতরের মনুমেন্ট। নতুন করে গড়া ভোলগা তীরের মূল স্থাপত্য হল কেন্দ্রীয় সিঁড়ি। ৪০ মিটার প্রশস্ত ১০০ সোপানের এই সিঁড়িতে রয়েছে আটটি ধাপ।
যখন সেখানে পৌঁছুই দুপুর পেরিয়ে গেছে। খাওয়া দরকার। এতদিন আমরা বিভিন্ন ধরণের পিজা খেয়ে দুপুর পার করলেও এবার ঠিক হল কোন এক ভালো রেস্টুরেন্টে যাব। আবার শুরু হল ভেজ সমস্যা – অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট ঘুরে এক জায়গায় নিরামিষের দেখা মিলল। আমিই দিলীপকে বললাম মাছ অর্ডার দিতে। আমি অবশ্য তার ধারে কাছেও গেলাম না। না না, ভোলগার মাছ নয়, সামুদ্রিক মাছ। যত আগ্রহ নিয়ে দিলীপ মাছ অর্ডার দিয়েছিল তত আগ্রহ নিয়ে সেটা খেতে দেখলাম না।
ভোলগা ক্রুইজ
এরপর আমরা গেলাম ভোলগার তীরে হাঁটতে। ভোলগার তীরটি এখানে দেখার মত। প্রচণ্ড ব্যস্ত এক জায়গা। তবে হেঁটে হেঁটে সময় কাটানোর জন্যও বেশ সুন্দর জায়গা। উপরের স্কয়ার থেকে নদী তীর পর্যন্ত নেমে গেছে বিশাল সিঁড়ি। হয়তো ততটা উঁচু নয়, তারপরেও এই সিঁড়ি আমাকে ওদেসার পাতমকিন সিঁড়ির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে ফেরি ঘাঁট। আমরা সেদিকেই হাঁটতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য লঞ্চে করে ভোলগায় ঘোরা। পথে চোখে পড়ল এক শিল্পীর মূর্তি। সামনে ইজেল নিয়ে বসে আছেন। যেন ভোলগার ছবি আঁকছেন। ব্রোঞ্জের তৈরি এই ভাস্কর্য দেখে বুঝলাম কী শহরবাসী, কী বেড়াতে আসা অতিথি কেউ ওর নাক না মলে এখান থেকে যায় না। ফলে শুধু এই নাকটাই সোনার মত জ্বলজ্বল করছে রোদের আলোয়। পাশেই বসে আছে একটি বাচ্ছা ছেলে। ব্রোঞ্জের নয়, রক্ত মাংসের – জ্যান্ত। এই স্ট্যাচু দেখে আমার বার বার আন্দ্রেই মিরনভের কথা মনে হচ্ছিল। আন্দ্রেই মিরনভ জনপ্রিয় অভিনেতা। মনে হয়েছিল তার তৈরি কোন এক সিনেমার নায়কের আদলে করা। পরে জেনেছি এটা আসলে ভোলগাগ্রাদের বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার ভিক্তর লোসেভের। ৫০০ কেজি ওজনের ব্রোঞ্জের এই মূর্তির ভাস্কর সেরগেই শেরবাকভ। একটু দূরে বেশ কিছু সত্যিকারের শিল্পীর দেখা মিলল। ওরা সেখানে দাঁড়িয়ে ভোলগাগ্রাদের ছবি আঁকছিল। আমি দূর থেকে ওদের ছবি তুললাম, আর ওদের পাশে গিয়ে ওরা যে দৃশ্য আঁকছিল তার গোটা দুয়েক ছবি নিলাম। মনে পড়ল বছর কুড়ি আগের এক জনপ্রিয় চুটকি
বাচ্চা মেয়ে ঘুরতে গেছে বাবার সাথে পার্কে। বাবা নবি রুস্কি মানে উঠতি বড়লোক। হঠাৎ এক শিল্পীকে ছবি আঁকতে দেখে মেয়ে জিজ্ঞেস করল
- পাপা, এই ভদ্রলোক কী করছেন?
বাবা সদ্য কেনা দামী ডিজিটাল ক্যামেরা নাড়তে নাড়তে মেয়েকে বলল
- বুঝলি, আঙ্কেলের ডিজিটাল ক্যামেরা কেনার পয়সা নেই। তাই কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে এই দৃশ্যের ছবি তোলার চেষ্টা করে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে।
যেহেতু আমি ঘুরতে গিয়ে অনেক কিছুই ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারের ভেতর দিয়ে দেখি তাই সাথে সাথেই মনে হল এখানে খুব ভালো কিছু ফটোসেশন করা যায়। এদিক সেদিক ঘুরে আরও কিছু ছবি নিয়ে আমরা গেলাম ফেরি ঘাঁটে। খবর নিয়ে জানলাম আধা ঘন্টা পরে ক্রুইজ শুরু হবে। লঞ্চ যাবে মামায়েভ কুরগানের দিকে। ভোলগার বুক থেকে সেসব ছবি তোলার একটা সুযোগ এসে যাবে। দেমিদ আগেই বলেছিল ও আমাদের সাথে যাবে না। তাই আমি আর দিলীপ গেলাম টিকেট কিনতে। কী কারণে এখন ঠিক মনে নেই, শেষ পর্যন্ত আমরা আর রিভার ক্রুইজে যাইনি। আমি আসলে লঞ্চে কখনোই খুব একটা কমফোর্ট ফিল করি না, কোন কারণে দিলীপ একটু গড়িমসি করতেই আমি বললাম বাদ দিতে।
ইতিমধ্যে আমাদের বাড়িওয়ালা ফোন করলেন। বাসায় গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে গেলাম রাতের খাবার কিনতে। খুব একটা দূরে নয়, তবে গাড়ি নিয়ে অনেকটাই ঘুরে যেতে হয়। পরে বুঝলাম চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে হাঁটলে দোকানটি বাসা থেকে ১০০ গজের মধ্যেই। সেই রাস্তায় আমরা গেছিলাম – এমনিতেই, কৌতুহলবশত।
ভোলগাগ্রাদের ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=QZDUvUSbRkk&t=28s
ভোলগাগ্রাদের ছবি
http://bijansaha.ru/album.php?tag=261
0 Comments