শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬২ / সালেহা খাতুন
নিজের ব্যথা, নিজের অপ্রাপ্তি, অপরের দেওয়া আঘাতের মালা গাঁথবো এমন কথা তো ছিল না। কিন্তু কে যে সব বলিয়ে নিচ্ছে, আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। সত্যিই "ছুটলে কথা থামায় কে? আজকে ঠেকায় আমায় কে?” আসলে তুফানের সঙ্গে তরঙ্গ উঠে বলেই তো বেঁচে আছি। তরঙ্গ থেমে গেলো মানে তো জীবন শেষ। এ বাণী জীবনে সত্য বলে মানি।
কানোরিয়া জুটমিলে এসে জীবনের সব পাপ যেন ধুয়ে গেলো। চেঙ্গাইলের ল্যাডলো জুটমিলে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি থাকাকালীন যে যুবক সিনিয়র কলিগদের অনুরোধে পাত্রীরূপে আমার মতো রাজকন্যাকে খুঁজে পেয়েছিলেন এবার তিনি স্পিনিং অ্যাসিসটেন্ট রূপে রাজত্ব করতে ফিরলেন ফুলেশ্বরের কানোরিয়া জুটমিলে। একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো যেন।
মিলের ভেতরটার আবহাওয়া একেবারে পারিবারিক। ওখানে আমার নকাকা, সেজোকাকা, মেজোমেসো, পিসতুতো দাদা, জ্যেঠতুতো দুলাভাই এছাড়া আরো অনেক চেনামানুষ কাজ করতেন বিভিন্ন বিভাগে। স্থানীয় হওয়ায় তাঁরা নিজেদের বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতেন। আমরা উঠলাম কোয়ার্টারে। তবে সবাই কোয়ার্টার পেতেনও না। পদাধিকার বলে এ সুযোগ ঘটে।
কানোরিয়া জুটমিলে একেবারে গঙ্গার ধারে বিশাল এক তিনতলা কোয়ার্টারের একেবারে ওপরতলায় একটি কোয়ার্টারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। বিরাট কাঁচের জানালা খুলে দিলেই দুচোখ জুড়ে উন্মুক্ত গঙ্গা। ঘরে বসেই প্রত্যেকদিন সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ। বড়ো বড়ো জাহাজ দর্শন। কতকগুলো নাম এখনো মনে আছে – এম ভি হর্ষবর্ধন, এম ভি আকবর আরো কত কী! বিভিন্ন দেশের জাহাজ আসছে আর তার ঢেউয়ে গঙ্গার সে কী তোলপাড়! চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।
কোয়ার্টারের সাথেই একটি অব্যবহৃত শক্তপোক্ত জেটি ছিল। কত সকাল সন্ধে সেখানে বসে কাটিয়েছি আর প্রার্থনা করেছি স্বাবলম্বনের। গতিময় নদীর কাছে যে প্রার্থনা করা হয়, শুনেছি তা নাকি পূরণ হবেই। মা শিখিয়েছিলেন একটি দোওয়া। যেটি নদীর ধারে বসে চার হাজার চারশো তেত্রিশবার পড়লে চাকরি অবশ্যম্ভাবী। মনে পড়ে গেল অক্ষয়কুমার দত্তের
সেই সূত্র : পরিশ্রম = শস্য
পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য
অতএব, প্রার্থনা = শূন্য।
গঙ্গার দিকে মুখ করে ঘরে বসে দিনরাত এক করে বাংলা সাহিত্য গুলে খেতে থাকলাম। কেননা তখন কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউয়ের জন্য ফর্ম ফিলআপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কোয়ার্টারে এসো জন বসো জনের সংখ্যা বাড়তে থাকলে বাড়ি থেকে বাবা তাঁর অসন্তোষ ব্যক্ত করতে থাকেন। নদীর ধারে সন্ধেবেলা মনোরম আবহাওয়া উপভোগ করার জন্য পরিচিতরা আমার কাছে আসার দোঁহাই দিয়ে গেটপাস নিত। কেননা কোয়ার্টার এরিয়া প্রোটেকটেড এরিয়া, সেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। আত্মীয়তার সূত্রে তারা আসতো। আর আমার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতো। বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না।
🍂
আরও পড়ুন 👇
প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে তখনও পড়াচ্ছি। সেসময় তিনশোর জায়গায় বেতন বেড়ে হাজার টাকা হয়েছে। তবুও কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে গভর্মেন্ট কলেজে কনট্র্যাক্ট বেসিসে লেকচারার পদে পড়ানোর জন্য আবেদন করলাম। দু'হাজার সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই অবশ্য এ আবেদন করতে হয়েছিল। সল্টলেকে ডিপিআই অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। এবারও সঙ্গে ভাই-ই গেল। ইন্টারভিউ যাঁরা নিচ্ছিলেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র অধ্যাপক বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়কেই চিনতে পারলাম। আরো অনেকে ছিলেন কিন্তু তাঁদের চিনিনা। এম.এ. এবং এম. ফিল. পড়ার সময় সামনাসামনি বসে বিমলবাবুর ক্লাস করেছি। তবে ঐ ক্লাসরুমেই যা লেকচার শুনেছি। আলাদা কোনো বিশেষ পরিচিতি ছিল না। কখনো নামও জানতে চাননি। আমি র্যানডম একজন শিক্ষার্থী মাত্র।
গভর্মেন্ট কলেজে কনট্র্যাক্ট বেসিসে লেকচারার পদে আবেদন করি কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে
কিন্তু ঐ ইন্টারভিউয়ে একজন মুসলিম শিক্ষার্থী কীভাবে পড়াশোনা করে এতোদূর এলো জানতে কৌতূহলী হলেন। ইন্টারভিউ বোর্ডে যাঁরা ছিলেন, প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে এই আলোচনা করতে লাগলেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা কী করেন?” উত্তরে যখন জানালাম বাবা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন, তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে প্রশংসাসূচকভাবে বলাবলি করলেন যে, “আচ্ছা শিক্ষক বলেই কন্যাসন্তানকে এতোদূর এগিয়ে এনেছেন”। বাবাকে এ কথা যখন শোনাই, বাবা খুব খুশি হন। আমাকে ইন্টারভিউয়ে আলোচনা করতে দেওয়া হয়েছিল সুবোধ ঘোষের ‘মা হিংসীঃ’ গল্পটি নিয়ে। যথারীতি সে ইন্টারভিউয়ে উত্তীর্ণ হইনি। আর ঐ লেকচারার পদের চাকরিটিও আমার হয় নি। কিন্তু একটা অভিজ্ঞতা তো হলো। জীবনের কোনো ধনই ফেলা যায় না।
দু'হাজার সালের শেষের দিকে কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউয়ের ডেট এসো গেলো। এবারও ভাই সঙ্গে গেল। ইন্টারভিউয়ের আগে ফর্ম ফিলআপ থেকে শুরু করে নানান খবরাখবর জানার জন্য ভবানীদত্ত লেনের সেই অফিসে কত কত বার গেছি গুনে শেষ করতে পারবো না। কলেজ সার্ভিস কমিশনের ফর্ম ফিলআপের পর শ্বশুরমশাই বললেন, “তোমার বসিরহাট কলেজে চাকরি হলে খুব ভালো হবে। বাড়ি থেকে তোমাকে আমার স্কুটারের পেছনে বসিয়ে কলেজে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা করবো। সালাউদ্দিন চাকরি করতে বাইরে চলে যাক”। ভাবলাম এইরে এবার আমার সত্যিই মরণদশা শুরু হবে।
এই কয়েক বছরে বেশ পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ মানুষ তো হয়ে উঠেছি। তার উপর বোন বললো, “দিদি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাইলে দুই বাড়ি থেকেই দূরে চলে যা”। খুব চেয়েছিলাম দার্জিলিং জলপাইগুড়ির কোনো কলেজে চাকরি হবে। অপরিণত মস্তিষ্ক আর কাকে বলে?
( ক্রমশ )
0 Comments