৪৬তম পর্ব
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
গ্রীষ্মকালে নাগেশ্বরের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি অতিক্রম করে যায় বলে এই সময়ে এখানে যাওয়া খুব কষ্টকর। নাগেশ্বর মহাদেব দর্শনের আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত। মন্দির দর্শনের সময় সকাল ছটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা এবং বিকেল পাঁচটা থেকে রাত্রি সাড়ে নটা। প্রাতঃকালে মঙ্গল আরতি হয় ভোর সাড়ে পাঁচটাতে। মধ্যাহ্ন আরতি হয় দুপুর বারোটাতে এবং বৈকালিক শৃঙ্গার হয় বিকেল পাঁচটায়। মন্দির খোলা হয় ভোর সাড়ে চারটায় এবং বন্ধ হয় রাত্রি দশটায়। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় উৎসবের দিনগুলিতে। এখানের প্রধান উৎসব মহা শিবরাত্রি, নবরাত্রি, দীপাবলী এবং হোলি। এছাড়াও শ্রাবণ মাসে শিবের জন্ম মাস বলে বহু দূরদূরান্ত থেকে ভক্তেরা জল নিয়ে এসে জ্যোতির্লিঙ্গের জলাভিষেক করেন। গর্ভগৃহে যেতে গেলে পুরুষদের ধুতি ও গেঞ্জি পরে যেতে হয়, কিন্তু মহিলাদের পোশাকের কোনরূপ বাধা নিষেধ নেই।
এখানে পুজো ও দর্শন হয়ে যাবার পরে আমরা গোপীতালাও গেলাম। নাগেশ্বর থেকে পাঁচ কিলোমিটার যাবার পরে রাস্তার ডানদিকে সমলসার নামে গ্রামে এই গোপীতালাও। এটি একটি পুষ্করিনী বা কুণ্ড। প্রবাদ শ্রীকৃষ্ণ যখন বৃন্দাবন থেকে চিরদিনের মত দ্বারকাতে চলে এসেছিলেন তখন বৃন্দাবনের গোপিনীরা শ্রীকৃষ্ণকে কিছুতেই ছাড়তে চাই ছিলেন না এবং তাঁর বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারেননি। শ্রীকৃষ্ণ এখানে আসার পরে গোপিনীরা একবার এসে শ্রীকৃষ্ণের সাথে শরৎ পূর্ণিমার রাত্রিতে মিলিত হয়ে শেষবারের মতন রাসলীলা অনুষ্ঠান করেছিলেন। রাসলীলার পরে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাতে চলে গেলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে চিরকালীন বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে গোপিনীরা এই স্থানে তাঁদের তাঁদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন এবং মোক্ষপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁদের প্রান বিসর্জনের পরে পুষ্করিনীর তলদেশের মাটির রঙ পরিবর্তিত হয়ে শ্রীরাধার অধরের রঙের মতো সোনালী বা গৈরিক বর্ণ হয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গোপিনীদের ভগবত প্রেমের স্বীকৃতি স্বরূপ কৃষ্ণভক্তেরা এখান থেকে এই পুষ্করিনীর মাটি যা গোপীচন্দন নামে পরিচিত, নিয়ে যান এবং তাঁদের অঙ্গে ধারণ করে তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের নামগান ও পুজো করেন। পুষ্করিনীতে নামার জন্য বাঁধানো ঘাট আছে। আমরা সিড়ির ধাপ দিয়ে ঘাটে নেমে জল এবং মৃত্তিকা স্পর্শ করলাম। এই গোপী তালাওয়ের পাশে শ্রী গোপীনাথ মন্দির। এই মন্দিরটি শ্রীকৃষ্ণের এবং গোপিনীদের সময়কালের অর্থাৎ পাঁচ হাজার বৎসরের প্রাচীন। আমরা গোপীনাথ মন্দিরে যেয়ে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে প্রণাম করে এখান থেকে বেটদ্বারকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
🍂
আরও পড়ুন 👇
গোপীতালাও থেকে ওখা দশ কিলোমিটার দূরে। ওখা একটি বন্দর শহর। ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি বড় কার্যালয় এখানে আছে। এছাড়াও টাটা কোম্পানির লবণ তৈরির কারখানা রাস্তার ধারে। চারিদিকে শুকনো মাছের গন্ধ। শুকনো মাছের অনেক ফার্ম আছে এখানে। আমাদের গাড়ি যেয়ে বোটজেটির নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখান থেকে আমরা যন্ত্রচালিত বোটে করে আরবসাগরের বুকে ভেসে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বেটদ্বারকাতে পৌঁছাবার জন্য মাথাপিছু কুড়ি টাকা ভাড়া দিয়ে পৌছালাম। এক একটি নৌকাতে প্রায় ২০-২৫ জন করে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে অনেকেই দেখছি মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন। এই বোটগুলিতে প্রতিদিন কয়েক হাজার দর্শনার্থী ওখা থেকে বেটদ্বারকায় যান আবার সেখান থেকে ওখায় ফিরে আসেন। বোটের চালকেরা শতকরা ৯০ ভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ওখার বোটজেটি থেকে বেটদ্বারকা যেতে মিনিট ২০-২৫ সময় লাগলো। আরবসাগরের নীল জলরাশির উপর দিয়ে আমাদের নৌকো ধীরলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নৌকার পাশাপাশি অজস্র ‘সীগাল’ পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। যাত্রীরা কেউ জলে মুড়ি বা আটার ছোট-ছোট গুলি দিচ্ছেন এবং দুধ সাদা পাখীগুলি ছোঁ মেরে হাত থেকে নিয়ে যাচ্ছে অথবা সমুদ্রের জলের থেকে কুড়িয়ে খেয়ে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে সত্যিই এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
প্রাচীন জনপদ বেটদ্বারকা। পূর্বেই উল্লেখ করেছি শ্রীকৃষ্ণের সাথে সুদামার মিলনের পরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে প্রভূত ধনরত্ন দান করেছিলেন এবং যে প্রাসাদে বসে সুদামার কাছ থেকে চালের পুঁটুলি 'ভেট' হিসেবে পেয়েছিলেন সেই রাজপ্রাসাদসহ সমগ্র স্থানটিকে সুদামাকে দান করেছিলেন, যা আজকের ভেট দ্বারকা নামে পরিচিত। ভূমিকম্পে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এই দ্বীপের। তবে এখানেই যে শ্রীকৃষ্ণের বাসভূমি ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না, কারণ জলোচ্ছ্বাসে প্রাচীনকালের সেই দ্বীপ হয়তো পুরোপুরি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীকালে বেটদ্বারকা নামে এই অঞ্চলে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির গড়ে ওঠে।যদিও এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা ছিল কিনা সে বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কিন্তু আমার মনে হয় এখানে সন্দেহ করাটা অমূলক। কারণ শ্রীকৃষ্ণের স্বর্ণদ্বারকা স্থূলভাবে কোথায় ছিল সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো যেখানে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর রানীদের নিত্যপূজা হচ্ছে, যেখানে ভক্তেরা দিনরাত ব্যাকুল হয়ে ভগবানের নামকীর্তন করছেন, সেখানেই তো দ্বারকাধীশ রণছোড়জীর অবস্থান। আর যেখানে তিনি অবস্থান করছেন সেটাই তো সূক্ষ্মদৃষ্টিতে দ্বারকা। তাই মূল দ্বারকা কোথায় ছিল কিংবা ভেট দ্বারকার যথার্থতা নিয়ে তর্ক করা শুধুমাত্র সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয় বলে আমার মনে হয়।
জেটি থেকে খানিকটা হেঁটে যেতে হয় তারপরে মন্দির চত্বর। রাস্তার দুপাশে তীর্থযাত্রীদের প্রয়োজনীয় এবং হস্তশিল্পের বিভিন্ন দোকান আছে। সামান্য পথ যাবার পরেই চোখে পড়ল মন্দির তোরণ। তোরণের গায়ে লেখা আছে শ্রীদ্বারকাধীশজীকা মুখ্যমন্দির, ভেট শঙ্খদ্বার। এখান থেকেই মন্দির এলাকা শুরু হলো। বাইরের তোরণদ্বার পেরিয়ে একটু এগোবার পরেই ডান দিকে রয়েছে আরেকটি তোরণ - দুদিকে নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন রয়েছে। মোবাইল, ক্যামেরা ক্লোক রুমে জমা রেখে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। আমরা যে সময় পৌঁছেছিলাম সেই সময়ে বেটদ্বারকার শ্রী দ্বারকাধীশের মন্দির বন্ধ ছিল। মিনিট পনেরো পরেই খুলল। ভিতরে পরপর রয়েছে বেশ কিছু মন্দির। প্রথমেই ডানদিকে পড়ল আদিনারায়ণের মন্দির - একটি প্রাচীন এবং অন্যটি নতুন। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক বলেন এটি নাকি একটি প্রাচীন বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের মতকে সমর্থন করে বলা যায় বৌদ্ধধর্মের প্রচলন এখানে যে ছিল তা প্রমাণিত সত্য। পরবর্তীকালে এই দ্বীপে খননকার্য চালিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অনেক বৌদ্ধমূর্তি উদ্ধার করেছেন। আদিনারায়ণ মন্দিরের পাশে গোপালকৃষ্ণের সুদৃশ্য মন্দির। ভেতরে গোপালকৃষ্ণের অপূর্ব মুখশ্রীযুক্ত বিগ্রহ। এরপরে লক্ষীনারায়ণ মন্দির। মন্দিরের ভিতরে লক্ষ্মীনারায়ণের সুপ্রাচীন বিগ্রহ। যদিও কালের প্রভাবে মূর্তির অনেকাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও লক্ষীনারায়ণের মুখশ্রী এবং নারায়ণের হাতে শোভিত শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম পরিষ্কার দেখা যায়। প্রচলিত ধারণা পুরাতত্ত্ববিদেরা এখানকার খননকার্য থেকে এই মূর্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন।
পরবর্তী অংশ ৪৭তম পর্বে
0 Comments