জ্বলদর্চি

মেঘের কেক /কমলিকা ভট্টাচার্য

মেঘের কেক  
কমলিকা ভট্টাচার্য


আকাশের মাঠে চলছে মেঘেদের ফুটবল খেলা। সাদা কালো চাঁদ আজ মেঘেদের পায়ে পায়ে ঘুরছে। নিচে সমুদ্র আজ দর্শক, অবিরত উচ্ছ্বাসের কলরব উঠছে ঢেউয়ে। মাঠে মতেয়ান পুলিশের দল বেসামাল ঢেউগুলোকে হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীরে। ততক্ষণে তৈরি হচ্ছে আরও কিছু অবাধ্য দর্শক ঢেউ, ছুটে ঢুকে পড়ছে মাঠে। ফিরে যাওয়ার আগে বালুতটে ছড়িয়ে যাচ্ছে সাদা মুক্তোর মালা, সিক্ত বালুকণার গাল লজ্জায় চিক চিক করছে।

সুধা সুজয়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে। সমুদ্রের জল হালকা করে পা ধুয়ে যাচ্ছে। সুধার মনেও আজ বেহিসাবি চিন্তার ঢেউ, অগোছালো নানা ভাবনার ঢেউ তার মনতটে আছড়ে পড়ছে। শক্ত করে জড়ানো দুহাত মুঠি নিজের মুখের কাছে টেনে চুমু দিয়ে সুজয় বলে, "কি এত ভাবছো?" তারপর মুঠো ছাড়িয়ে সুধাকে হাতের বাঁধনে বাঁধে।

সুধা বলে, "কিছু ভাবছি না, শুধু ঐ আকাশের দিকে মেঘেদের নিয়ে নানা ছবি আঁকছি।" সুধা এবার সোজা হয়ে বসে। বলে, "দেখ, ঐ যে মেঘটা , ঠিক যেন নর্তক-নর্তকী এক ঘনিষ্ঠ নৃত্য ভঙ্গিমায় রত, আর ঐ দূরেরটা মনে হচ্ছে ঘাসের উপর শুয়ে মুখোমুখি দুই প্রেমিক-প্রেমিকা গভীর প্রেমালাপে ব্যস্ত। আর ঐ যে..."

সুধাকে থামিয়ে সুজয় বলে, "আমি আমার কাছের চাঁদের চাঁদপনা মুখ দেখছি। তুমি যে না সেজেও কত সুন্দর! আজ সকালে টুপি মাথায় তোমায় দারুণ লাগছিল, আর ঐ বেটা ড্রাইভার বারবার এই জন্য বলছিল, 'ম্যাডাম, আপনি এদিকে দাঁড়ান, ওদিকে দাঁড়ান, আপনার ছবি তুলে দিচ্ছি।'"

সুধা বলে, "এই তোমার যত বাজে কথা, পুরো মুডটা অফ করে দিলে। চল, এবার হোটেলে ফিরে যাই, বীচটাও খালি হয়ে এসেছে।"

সুজয় বলে, "হোটেলে ফিরে এসি চালিয়ে ঘুমোনো ছাড়া তো আর কোনো কাজ নেই। আরো একটু বসি।"

হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে, বছর আট-দশ হবে, এক গুচ্ছ বেলুন নিয়ে এসে হাজির। "আণ্টি, এক বেলুন লে লো।"

সুধা বলে, "আরে, আমি বেলুন নিয়ে কি করব?"

বাচ্চাটা বলে সন্ধ্যে থেকে একটাও বিক্রি হয়নি তার, "এক লে লো, আন্টি।"

সুধা বলে, "কত দাম?"

ছেলেটি বলে, "২০ রুপিয়া।" সুধা বলে, "ঠিক আছে, বেলুনটা বরং তুই রেখে নে।" ছেলেটি বুঝতে পারে না, সে ভাবে সুধা বেলুন নেবে না।

ছেলেটি বলতে থাকে, "আন্টি, প্লিজ লে লো, মুঝে ভুখ লাগা হ্যায়।"

🍂
সুজয় হেসে বলে, "কি রকম শেখানো সব বলছে, দেখছো একদম পাক্কা…"

সুজয়কে থামিয়ে সুধা বলে, "তুই কি খেতে চাস? চল, আমার সাথে দোকানে, তোকে কিনে দিচ্ছি।"

ছেলেটির মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠে বলে, "তুম মুঝে এক বড়াওলা কেক দিলওয়া দো।"

সুধা হেসে বলে, "কেন রে, কেক কেন? তোর কি কেক খেতে খুব ভালো লাগে?"

ছেলেটি বলে, তার দুদিন আগে জন্মদিন ছিল, সে সিনেমাতে বাচ্চাদের জন্মদিনে কেক কাটতে দেখেছে।

সুজয় বলে, "তেরা নাম ক্যা হ্যায়?"

ছেলেটি বলে, "প্রশান্ত।"

সুধা বলে, "তুই সারাদিন বেলুন বেচিস, স্কুল যাস না?"

ছেলেটি বলে, আগে যখন সে গ্রামে ছিল, তখন স্কুলে যেত। গ্রাম থেকে চলে আসার পর স্কুলে যাওয়া হয় না।

সুধা জানতে চায় তার গ্রাম কোথায়। ছেলেটি বলে, সে মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ থেকে এসেছে।

সুধা আর সুজয় দুজনেই অবাক হয়। তারা বুঝতে পারে ছেলেটা মিথ্যে কথা বলছে না। কারণ সুদূর ওড়িশার পুরীতে একটা বেলুন বেচা ছেলে মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ শহরের কথা জানতে পারে না।

সুধা বলে, "চলো আমরা এবার ফিরি আর যাবার সময় ওকে কেক কিনে দিই।"

বালির উপর দিয়ে চলার সময় ছোট্ট ছেলেটি সুধার হাত ধরে নিয়ে চলে, বলে, সাবধানে চলতে, বালিতে কাঁচে পা কেটে যেতে পারে। একবার তারও পা কেটেছিল, অনেক অনেক রক্ত বের হয়েছিল। 
সুধা জানতে চায় ওর বাবা কি করে।
প্রশান্ত বলে, তার বাবা চোখে রাত্রে  দেখে না, দিনের বেলায় বাবা বেলুন বিক্রি করে....
 প্রশান্ত বলে চলে ...বাড়িতে কেক নিয়ে গেলে তার ভাইবোন খুব খুশি হবে। সে আরো বলে, সুধা  যেন তাকে একটা গোলাপী রঙের কেক কিনে দেয়। তার ছোট বোন একদিন খেতে চেয়ে ছিল।

সুজয় দোকানের ভিতর থেকে প্রশান্তকে নিয়ে বাইরে আসে, প্রশান্তের হাতে একটা বড় কেকের বাক্স। 
সুধা দোকানের বাইরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, সুধার হাতে ধরা ছিল বেলুনের গুচ্ছ। ছুটে এসে প্রশান্ত সুধার সামনে দাঁড়ায়,খুশীতে ওর হাতপা কাঁপছে, ওর চোখদুটো না বলেও অনেক  কথা বলছিল।
সুধা বেলুনের গুচ্ছটা ওর হাতে দিয়ে বলে, "হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।"

রাতে সমুদ্রের তট ধরে হোটেলে ফেরার পথে, সুধা আকাশের দিকে তাকিয়ে সুজয়কে বলে, "কি ভাবছো?"

সুজয় বলে, "ঐ যে মেঘটা, ঠিক যেন কেকের মতো।"

সুধা আলতো করে সুজয়ের হাতটা ধরে আর বলে, "আর ঐ দেখ! ঐ মেঘগুলো সব সব যেন না না রঙে সাজানো বেলুন.... ঠিক তাইনা..."

Post a Comment

0 Comments