শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৫ / সালেহা খাতুন
প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে এপ্রিল-মে-জুন-জুলাই আবার পড়ানোর সুযোগ পেলাম। আর নিত্যদিন যাতায়াত চললো ভবানী দত্ত লেনের সেই অফিসে। কিছু বলতাম না শুধু সেক্রেটারির ঘরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম, কেননা তাঁকে আমার সমস্যার কথা আগেই জানিয়েছি। একমাথা সাদা চুলওয়ালা মানুষটি সত্যিকারের ভদ্রলোক । আমাকে বলতেন, “চিন্তা করো না, তুমি তো ড্রাইভারের সীটে বসে আছো। যেদিকে গাড়ি ঘোরাবে সেদিকেই যাবে। পরের লট যখন ছাড়া হবে তুমি যেখানে চাইবে সেখানেই তোমাকে দেওয়া হবে। হাওড়া জেলার আমতা এবং শ্যামপুরে দুটি কলেজে বাংলার একটি করে পোস্ট ফাঁকা আছে। তোমাকে ওখানে দেওয়ারই চেষ্টা করছি”। যেহেতু আমি হাওড়া জেলার মেয়ে তাই এবার আমাকে হাওড়া জেলার মধ্যেই দেওয়া হবে বলে প্রবোধ দিলেন। মোহ ভঙ্গ হয়েছে আমার। আর যেখানে সেখানে চাই না। খুব চাইছিলাম যেন উলুবেড়িয়া কলেজে পাই। তাহলে কানোরিয়া থেকে হেঁটেই কলেজে চলে যেতে পারবো।
কী রকম উৎকন্ঠায় যে তখনকার দিনগুলি কেটেছিল! মাঝে এপ্রিলের কুড়ি তারিখ পি এস সির ইন্টারভিউ দিলাম। সেদিন অয়ন্তিকাও ইন্টারভিউ দিয়েছিল। উজ্জ্বলবাবুর কথা তো আগেই বলেছি। তিনি পরামর্শ দিলেন “সি এস সির প্যানেলে যখন তোমার নাম আছে, তোমাকে যত ভুলভাল জায়গাতেই ওরা পাঠাক তুমি হাল ছেড়ো না; তোমাকে চাকরি দিতে ওরা বাধ্য। তুমি রোজ অফিসে গিয়ে ওদের রিমাইন্ডার দাও”। ইন্টারভিউ-এ আর একজন এক্সপার্ট ছিলেন তিনি বললেন, “তোমার প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের স্নেহার্দ্রি স্যারকে বলো এ ব্যাপারে তোমাকে যেন সাহায্য করেন”। আমি তো তাঁকে চিনি না। কলেজে এসে ইতিহাসের অধ্যাপক আমার মাস্টারমশাই স্নেহার্দ্রিবাবুকে বললাম সে কথা। তিনি বললেন, “তুই তাঁর নামটা বলতে পারবি?” আমি চেহারার বর্ণনা দিলাম কিন্তু নাম তো জানি না। তিনি বর্ণনা থেকে মোটামুটি বুঝলেন যে ইনি তাঁর লাডলীদা। অর্থাৎ অধ্যাপক লাডলী মোহন রায়চৌধুরী।
প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের সমস্ত অধ্যাপক তাঁদের ছাত্রীরূপে আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। ফুলটাইম ইউ জি সি অধ্যাপকরা নিজেদের উদ্যোগেই পার্টটাইম লেকচারারদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আন্দোলনও করতেন। ফলে আমার এহেন বিপদে তাঁরা বিভিন্নভাবে পাশে দাঁড়ালেন। অঙ্কের অধ্যাপক নিশীরবাবু, আমার স্যার শ্যামল সেনগুপ্ত, অর্থনীতির অধ্যাপক সুশান্তবাবু সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
🍂
আরও পড়ুন 👇
একনাগাড়ে প্রায় তিনমাস রোজ ভবানী দত্ত লেনের ঐ অফিসে গিয়ে আমার কাতর আবেদন জানানোর পর সুফল ফললো। সেক্রেটারি একদিন বললেন, "অনেক চেষ্টা করেও তোমাকে হাওড়া জেলার কোনো কলেজে দিতে পারলাম না। মেম্বাররা বাধা দিলেন। একবার যখন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজে তোমাকে পাঠানো হয়েছে তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজেই তোমাকে পাঠানো হবে এই তাঁদের মত।তবে তোমাকে ভালো কলেজে দেওয়া হয়েছে। মেদিনীপুর কলেজে।”
ভ্যাবলে গিয়ে বললাম, মেদিনীপুর কলেজ? সে আবার কোথায়? কীভাবে যেতে হবে? তখন অখণ্ড মেদিনীপুর। শুভাকাঙ্ক্ষীরা বললেন রূপনারায়ণ পেরোলেই তো মেদিনীপুর। বাড়ি থেকে একশো কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব। ফিলোজফির অধ্যাপক নিমাইবাবু আশিস জানিয়ে লিখলেন “কলেজ মেদিনীপুর সে আর কতদুর”। আবার জুনমাসে কলেজ সার্ভিস কমিশনের নতুন রেকমেণ্ডেশন লেটার নিয়ে বাবার সঙ্গে মেদিনীপুর কলেজে এলাম। তৎকালীন অধ্যক্ষের কথা আগেই বলেছি। আমার ছোটোখাটো চেহারা নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। সেটা ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য না হয় না করলাম কিন্তু তিনি সরাসরি বলে দিলেন এখন সামার রিসেস চলছে, ক্লাস বন্ধ; তোমাকে এখন নেওয়া যাবে না। জয়েন করালেন না। ফিরিয়ে দিলেন। বাড়ি ফিরে মানে কানোরিযায় ফিরে পরে পাবলিক বুথ থেকে বার বার কলেজে ফোন করি। ফোন আর কেউ ধরেন না। নিজের কোনো টেলিফোন কানেকশন সে সময় ছিল না। সতীশঙ্করদা তখন প্রিন্সিপালের আর্দালি ছিলেন। তিনি মাঝে সাঝে দু’একবার ফোন ধরে বলেছেন, “না ম্যাডাম আপনার জয়েনিং নিয়ে কলেজে কোনো আলোচনা হয় নি”।
আবার ভবানীদত্ত লেনে যাতায়াত শুরু করলাম। অফিসে লিখিতভাবে জানালাম মেদিনীপুর কলেজের মাননীয় অধ্যক্ষ আমাকে কলেজে জয়েন করাচ্ছেন না। নানান কারণ দেখিয়ে টালবাহানা করছেন। অফিসের বড়োবাবু চিঠিটি রিসিভ করলেন। কলেজ সার্ভিস কমিশনের প্রথম চিঠি হাতে পাওয়া থেকে শুরু করে পাঁচ মাস হয়ে গেল চাকরিতে জয়েন করতে পারছি না। এর ফলে সিনিয়রিটি নষ্ট, আর্থিক ক্ষতি অপরিমেয়, মানসিক ক্ষতের নিরাময় হাতের বাইরে চলে গেল। অবশেষে প্রিন্সিপাল লবিতে জানানোর চেষ্টা করা হলো। ড. পরিতোষ সরকার যিনি বাংলা অনার্স পড়ার শুরুতেই বলেছিলেন বাংলা পড়েও কিছু করে খাওয়া যায় তিনি এর সমাধান করলেন আমার স্যারের অনুরোধে। পরিতোষবাবু তখন অন্য একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, সরাসরি মুকুলবাবুর সঙ্গে কথা বলেন।
জুলাইয়ের উনিশ তারিখ মেদিনীপুর কলেজে ফোন করতেই মাননীয় অধ্যক্ষ নিজেই ফোন ধরে বললেন, “ কালই চলে এসো। ফার্স্ট হাফে এগারোটার মধ্যে কলেজে জয়েন করো”। অবশেষে দু’হাজার একের কুড়ি জুলাই মেদিনীপুর কলেজে জয়েন করলাম তৎকালীন মর্নিং ইনচার্জ অধ্যাপক পিনাকী রঞ্জন দাস মহাশয়ের উপস্থিতি এবং যত্নে।
ভবানী দত্ত লেনের এই অফিসে কত কত বার যে যেতে হয়েছে
এবার মুকুলবাবুর যে আন্তরিক স্নেহ ও অভিভাবকসুলভ আচরণ দেখলাম তাতে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। মুকুলবাবুর স্ত্রী প্রতিমা দেবী তখন মেদিনীপুর কলেজের সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ হতে তিনি বললেন আমার বোন নীলিমা তো তোর কলেজেরই অঙ্কের অধ্যাপক। একটা পারিবারিক সম্পর্ক বা বলা যেতে পারে আত্মীয়তার সম্পর্ক নির্মিত হয়ে গেল আমার প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের অধ্যাপক নীলিমাদির সূত্রে। আমি মুকুলবাবুকে অধ্যক্ষরূপে পেয়েছিলাম মাত্র এগারোদিন। তিনি একত্রিশে জুলাই দু’হাজার একে রিটায়ার করেন। কিন্তু আমার থাকার ব্যবস্থা, স্যালারি অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া সমস্ত কিছু কাজ ঐ কদিনের মধ্যেই সম্পন্ন করে দেন। মেদিনীপুর মিউনিসিপাল এরিয়াতে আমাকে থাকতে হবে এবং আরো নানান শর্ত আরোপ করা ছিল আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে।
মেদিনীপুর শহরে নতুন এসেছি। তিনিই বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে আমার থাকার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু তাঁর এবং আমার দুজনেরই নতুন অভিজ্ঞতা হলো। সব কিছু ঠিকঠাক করে যখন আমার নাম জানানো হলো কেউ আর বাড়ি ভাড়া দিতে চাইলেন না। শেষমেশ তিনি কলেজের গার্লস হোস্টেলে একটি ঘরে তিনটি সীটের রেন্ট দেওয়ার শর্তে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
0 Comments