জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক কুমারেশ ঘোষ/নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক কুমারেশ ঘোষ
নির্মল বর্মন 

বিশিষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক কুমারেশ ঘোষ। "যষ্টিমধু''নামক  পত্রিকার সম্পাদক ও কথাসাহিত্যের স্বনামধন্য লেখক কুমারেশ ঘোষ শুধু ঔপন্যাসিক নন, বিশিষ্ট কবিও বটে। কুমারেশ ঘোষ ''যষ্টিমধু'' পত্রিকার প্রায় তেতাল্লিশ বছর একক সম্পাদক ছিলেন।  তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ''উত্তর-ভারতী'', ''ত্রিপর্ণা'' এবং ''সম্মার্জনী'' পত্রিকাগুলোর সম্পাদক হিসেবে সুবিদিত । এমনকি নানাবিধ  ছদ্মনামে  লিখেছিলেন । শিশু সাহিত্যে বিরাট সাফল্য স্বরূপ ১৯৯০ এ "শিশুসাহিত্যে জাতীয় পুরস্কার"লাভ করেছিলেন । কুমারেশ বাবু বহু গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন ও  সংস্কৃত সাহিত্যের "মনুসংহিতা"বাংলায় অনুবাদ করে সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
কবি কুমারেশ ঘোষ বিরচিত জনপ্রিয় গ্রন্থগুলো - "এক বর অনেক কনে'', ''কখনো মেঘ কখনো তারা'', ''কাঠের ঘোড়া'', ''বিনোদিনী বোর্ডিং হাউস'', ''দখিন দুয়ার খোলা'', ''হায় কলকাতা'', ''ফলন্ত ফুটপাথ'', ''নতুন মিছিল'' ইত্যাদি।
🍂
                        সাহিত্যিক সুশীল রায়  "সতীদাহ" প্রথা নিয়ে যেমন  সৃষ্টি করেছিলেন ''অনল-আয়তি'' ঠিক তেমনি  ঔপন্যাসিক কুমারেশ ঘোষ সমকালীন সমাজ ও সময়ের 'বহুবিবাহ প্রথা ' নিয়ে লিখে ফেললেন ''এক বর অনেক কনে'' (১৯৭২) বিখ্যাত উপন্যাস।  আসলে বিষয়বস্তু ভাবনা সেকালের হলেও বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে আধুনিক জীবন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিফলিত। সাহিত্যে জীবনবোধের প্রেক্ষিতে ঔপন্যাসিক সমকাল চেতনার ভাস্বরতায় অস্থির বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়িত দিকটি'র উপর বিশেষ আলোকপাত করে উপন্যাস লিখেফেললেন। সারা বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় প্রবল প্রতিপত্তিশালী ইংরেজ আগমনের ফলশ্রুতিতে পুরোনো রীতি নৈতিকতার সঙ্গে নতুনের কালজয়ী দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল , লেখক সুকৌশলে সেই যুগ সন্ধিক্ষণের বিরাট রূপ-কে তাঁর উপন্যাসের  কায়ারূপ দান করার চেষ্টা করেছেন। উপন্যাসটির "একদিকে বহুবিবাহ, সতীদাহ, কৌলীন্য প্রথা অন্যদিকে বাবুসমাজের লাম্পট্য, ব্যভিচার এবং সমাজ সংস্কারের হিতৈষণা"- রূপটি উপন্যাসের পাতায় সুবিন্যস্ত ।
                কথাসাহিত্যিক কুমারেশ ঘোষ তাঁর "এক বর অনেক কনে' উপন্যাসের পাতায় "সমকালীন ইতিহাস";এর   ছক ও ছবিটা  তুলে ধরেছেন । কিন্তু সেই ছবিটা  কোনো বিখ্যাত চরিত্রের মাধ্যমে নয়" বরং অসহায় অখ্যাত মানুষের জীবনবোধের স্পন্দনের ছবি ব্যঞ্জিত। "এক বর অনেক কনে" উপন্যাসে সাধারণত ''মানিকপুর'', "বল্লভপুর'',ও " ফুলপুর" তিনটি গ্রাম ও মহানগরী কলকাতা পটভূমি রূপকে  ব্যবহৃত করে উপন্যাস সৃষ্টি। মূলতঃ তিনটি বৃত্তের মধ্যে ভাবনার কাহিনি বিন্যাস্ত। 
বস্তুতঃ তিনটি বৃত্ত পরস্পর সংলগ্ন । 
১ম  বৃত্তে "বেণীমাধবের সংসার জীবন", ও 'স্ত্রী বাসনাময়ীর অপহরণ'ও , 'গানাবাবু মানিক মুখুজ্জে' দের লাম্পট্য চিত্র প্রকাশিত। 
২য় বৃত্তে মূলতঃ "লোহারামের সংসার", "স্বর্ণমঞ্জরীর বিয়ে" ও "বৈধব্য" এবং "সতীনাথের আশ্রয়লাভ"। 
৩য় বৃত্তে -- "লোহারামের কন্যা বিন্দুবাসিনীর ছদ্মবেশে স্বামীসন্ধানে যাত্রা"!  অবশেষে স্বামী মানিক মুখুজ্জে' র সঙ্গে দেখা ও  মিলন। 
সুতরাং এই উপন্যাসে নির্দিষ্ট কোনো নায়ক না থাকলেও  সময়ই মূল নায়ক।  বিভিন্ন পরিবেশে নর-নারীর মনস্তাত্ত্বিক রূপায়নের জ্বলন্ত চিত্রণ লেখক অঙ্কনকরেছেন। সাহিত্যের তীক্ষ্ণ বাস্তববোধ ও সমাজমনস্কতার গভীর পরিচয় উপলব্ধি করা যায়।
ফলতঃ নির্দিষ্ট সময়েই  সমগ্র সময়ের বৈশিষ্ট্যগুলো ও বিশেষ সমস্যার মাধ্যমে সারা জীবনকে অঙ্কনের প্রয়াসে কবি কুমারেশের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব পরিচয় পাওয়া যায়।               
তাসত্ত্বেও কালের অমোঘ আকর্ষণে ও মোবাইল কম্পিউটার এর বাড়াবাড়ি ফলে মানুষের সত্তা স্মৃতি স্মার্ট থেকে ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার জন্য " বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক কুমারেশ ঘোষ" এ পরিণত হয়েছেন।

Post a Comment

1 Comments