পর্ব-২৮
স্বপন কুমার দে
আধুনিক ধনতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজ জীবনেও বড় রকমের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। শহরের চাকচিক্যময় আধুনিক জীবন এখন আরও বেশি আকর্ষণীয়, বেশি গ্রহণযোগ্য। গ্রাম ছেড়ে মানুষ ক্রমশ শহরমুখী হচ্ছে। চাকরিজীবি বা ব্যবসায়ীরা তাদের সঞ্চিত অর্থের বেশ কিছুটা অংশ ব্যয় করে শহরে বাড়ি করে অথবা ফ্ল্যাট কিনে শহরে বসবাস করতে আরম্ভ করেছে। দাম বাড়ছে শহরের জায়গার, পরিধি বাড়ছে শহরের। বর্ধিত এলাকাতে নতুন নতুন পাড়া গড়ে উঠছে। শুকিয়ে যাচ্ছে গ্রাম, গ্রামের অর্থনীতি। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে শহরকেন্দ্রিক কিছু ব্যবসায়ীর হাতে। জমি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে প্রোমোটারি রাজত্ব। মানুষের হাতে পয়সা আসছে। এক শ্রেণির মানুষ ফুলে ফেঁপে বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভালো, মন্দ, দুইই আছে। এখানেও তাই। বদলে যাচ্ছে শহরের চরিত্র। কলকাতার ছোঁয়া লাগছে জেলা শহরগুলোতে। তৈরি হচ্ছে বিরাট বিরাট বহুতল। বিকিয়ে যাচ্ছে পুরাতন বাড়ি,ভেঙে ফেলে তৈরি হচ্ছে আধুনিক ঝাঁ চকচকে মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিংস। বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে পুকুর, জলা জায়গাও। প্রোমোটারদের নজর পড়ছে গরিব মানুষের কাঁচা বাড়ি। ঐ সব গরিব অসহায় মানুষদের ওখান থেকে উচ্ছেদ করতে নরমে গরমে রাজি করাতে আসরে নেমে পড়ে বড় বড় প্রোমোটারদের চ্যালা চামুন্ডরা। তাদের বস্তি থেকে সরিয়ে অনেকটা দূরে মাঠের মাঝে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার কথা বলা হয়। এছাড়া থাকে অর্থের প্রলোভন। প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় দেড় দুলাখ টাকা। এত টাকা তারা জীবনে কখনও দেখেনি। তাই হাতে চাঁদ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।
সুজনের দৃষ্টি পড়ল জোড়াদিঘি বস্তিতে। এখানে তার এমনিতেই অন্য একটা আকর্ষণ আছে, তার ওপর এই নতুন প্রস্তাবে ঘন ঘন এ পাড়ায় আসা যাওয়া করতে লাগল। ক্লাবে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে আসে সুজন। এলেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ক্লাবের ছেলেদের মনোরঞ্জন করতে অতিরিক্ত কিছু ব্যবস্থাও থাকে। ক্লাবের ছেলেরাও খুব খুশি হয়। সুজনদার মত মানুষ হয় না। অতো বড়লোক, তার ওপর নেতা বাবার একমাত্র আদরের দুলাল, তার মনে কোনও অহংকার নেই। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত মিশে যায়। সবার খোঁজ নেয়। ক্লাবে ব্যবহারের জন্য এটা ওটা কিনে দেয়। কাজেই সবাই তাকে খুব মানে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
সুজনের অন্তর্দৃষ্টি অন্য কিছু বলে, অন্য কিছু খোঁজে। ব্যবসাটা সে ভালোই বোঝে। ব্যবসা, অর্থ, নারী-- কোনোটাতেই সে হারতে রাজি নয়। ইনভেস্ট করলে প্রফিট থাকে, রিটার্ন অনেক বেশি, সেই ক্যালকুলেশন ওর মজ্জাগত। আগে দৃষ্টি ছিল মল্লিকার উপর, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরো বস্তি এলাকাটা। অনেকটা জায়গা, প্রায় বিঘা চারেক হবে, একবার গোছাতে পারলে অনেক লাভ। তিন চারখানা বড় মাল্টিপ্লেক্স বিল্ডিং উঠবে। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। উপচে পড়বে তার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। সেই সঙ্গে আরও একটা লাভ হতে পারে। অবশ্য সেটা অতটা সহজ নয়, অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে। মনে মনে পরিকল্পনা করে। এতগুলো বিল্ডিং সে একা করতে পারবে না। আর এক দুজন প্রোমোটারের সঙ্গে পার্টনারশিপ ব্যবসায় নামতে হবে। কিন্তু মুনাফার বেশিরভাগটা যাতে তার দিকেই যায়, তা দেখতে হবে। তার বাবা আছে বলেই ব্যাপারটা সহজ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার লভ্যাংশ কিছু বেশি হবে। সবকিছুই তার পরিকল্পনার মধ্যে আছে।কয়েকদিনের মধ্যে জোড়াদিঘিতে ঢেউ উঠল। পাড়াতে নতুন নতুন লোকের আনাগোনা বেড়ে চলল।তারা সুজনের বন্ধু বা কাজের লোক। অন্তত ক্লাবের ছেলেরা তাই জানে। তারা আসে, পাড়ায় একটু ঘোরাঘুরি করে আর ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে এক আধ ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে আবার বেরিয়ে যায়। কখনও বাইকে, কখনও চার চাকা দাঁড় করিয়ে ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুর মত মেশে, ক্যারম খেলে। মাঝেমাঝে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার দেওয়া দামী খাবার খেয়ে এ পাড়ার ছেলেরা সুজনকে ধন্য ধন্য করে।
সুজনের বাবাও ইতিমধ্যে দু-তিনবার পাড়ায় ঘুরে গেছেন। পার্টির নির্দেশে তিনি যে গরিব মানুষদের নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছেন একথা ছড়িয়ে পড়ল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার কী অসুবিধা বা অভাব অভিযোগ শুনছেন, সমাধান করার আশ্বাস দিচ্ছেন। পাড়ার মেয়েদের কীভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা যায়, তার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন, সরকারি স্কিম পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন এবং এ বছর পুজোয় মা বোনেদের শাড়ি কাপড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সত্যি, এতদিন পর পাড়ার পুরুষ ও মহিলারা খুব খুশি হয়। অন্যেরা যে তাদের কথা ভাবছে, এটাই তাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
মল্লিকার কেমন যেন একটা সন্দেহ হয়। তার ভাবনা ছিল সুজনের কু-মতলব নিয়ে। সে জানত, সুজনের এ পাড়ায় ঘোরাঘুরির আসল কারণ সে। কিন্তু এখন এতজনের উপস্থিতির উদ্দেশ্য, তাকে ভাবিয়ে তুলল। সুজনের বাবার এ পাড়াতে আসার কারণ অবশ্য অন্য। ভোট এলে নেতারা অতি সক্রিয় হয়ে যান, সেটাই তাদের কাজ। কিন্তু সুজনের সঙ্গে যারা আসে তারা কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী? মনের মধ্যে অনেক জিজ্ঞাসা।
পাশাপাশি বাড়ি যাদের, সেই কাকিমা জেঠিমাদের কাছে প্রশ্নটা করেছিল মল্লিকা,সেখান থেকেই জানতে পেরেছে," ওরা সব সুজনের বন্ধু। খুব ভালো মানুষ। আমরা যে কতটা অসুবিধার মধ্যে আছি সেসব দেখতে এসেছে। আমাদের অসুবিধার কথা উপরে জানাবে, তাই ওদের আসা যাওয়া। আমরা এতদিন এতবার আবেদন করেও যা পারিনি, তা যদি ওরা করতে পারে তাহলে খুব উপকার হয়।"
তবুও খটকা রয়ে যায়।
একদিন রাতে ক্লাবের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় ফিস্ট হচ্ছিল, দেশি মুরগি, ভাত,ডাল তরকারি। সুজনের বন্ধু বান্ধব, ক্লাবের ছেলেরা ছাড়াও বয়স্ক পুরুষদের নেমন্তন্ন ছিল। সেখানেই কথাটা প্রথম উঠল। ক্লাবের জনৈক মেম্বারের মুখ থেকে শোনা গেল," শুনুন সবাই, একটা দারুণ সুখবর আছে। আগে কেউ কোনোদিন এমন সুখবর শোনেননি। সুজনদা আমাদের দুঃখ দুর্দশার কথা ভেবেছেন। আমরা যে ভাঙাচোরা বাড়িতে বাস করি এটাতে দাদা খুব কষ্ট পায়। তাই আমাদের প্রতি পরিবারকে একটি করে নতুন বাড়ি করে দিতে চায়। এতে কারোর কোনও আপত্তি আছে?"
সবাই এ কথায় হৈ হৈ করে উঠল," আপত্তি, আপত্তি আবার কিসের? যার আপত্তি, তার ঘর হবে না।"
" না, সুজনদার একটা শর্ত আছে, একজনও যদি আপত্তি করে তাহলে কারোরই বাড়ি হবে না।"
সবাই গর্জন করে উঠল," যার আপত্তি থাকবে, তাকে এ পাড়া থেকে উঠে যেতে হবে। আমরা তাকে পাড়া ছাড়া করে ছাড়ব।"
এরপর সুজন বলতে শুরু করল," তাহলে কথা হয়ে গেল। ছ'মাসের মধ্যে তোমরা নতুন ঘর পেয়ে যাবে। আর এই বাড়ি ছেড়ে দেবে।"
পুরো ব্যাপারটা আর বোঝার দরকার নেই, সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বৃদ্ধ জ্যোতি সামুই উঠে দাঁড়াল," সুজনবাবু, বলছি আমার ঘরটাতো একেবারেই ভেঙে গেছে। তাই আমি বলছিলাম, আমার ঘরটা যদি আগে করা হয়, তাহলে ভালো হত। এই ক'টা দিন নাহয়, ব্রিজের তলাতেই আমরা কাটিয়ে দেবো।"
সুজন হেসে উত্তর দিল," আরে না, না। তোমাদের কাউকেই ব্রিজের তলায় থাকতে হবে না। তোমাদের একসঙ্গেই বাড়ি তৈরি হবে। পুবদিকের ক্যানালপাড়ে, তিন বিঘে জমির ওপর। তোমাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্য এই ব্যবস্থা। আর এই জায়গাটার জন্য আমি আলাদা খদ্দের দেখেছি। এটার ওরা যে দাম দিয়েছে তাতে তোমরা বাড়ি পিছু দু'লাখ টাকা পাবে। কি খুশি তো?" সবাই একবাক্যে হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠল।
জ্যোতি সামুইয়ের খটকা লাগল আরও কারও কারও হয়তো লেগেছে। কিন্তু আনন্দের প্রচণ্ড গর্জনে সব ঢাকা পড়ে গেল।
0 Comments