এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনী।
পর্ব ১২। দুঃসংবাদ ও রহস্যজাল
বাসুদেব গুপ্ত
পরের পর এ আই নিয়ে তোলা ছবিগুলোর কথা জেনে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে অনির্বাণের। কোন ছবিতেই মানুষের সঙ্গে এআইএর সম্পর্কের ভবিষ্যৎ তেমন ভালো না। মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষকেই খোঁজে। শোনা যায় মারা যাবার আগে সিলিন্ডার থেকে সেই বিখ্যাত টেকনলজিশট এক মেসেজ পাঠিয়েছিলেন তাঁর জেড হ্যান্ডেলে। “মানুষ ছাড়া মানুষের কিছু নেই। এআই থেকে সাবধান।“ কিন্তু তিনি নানা সময় নানা লোকের সমর্থনে নানা কথা বলতেন। এই মেসেজটাও গুজব বলেই সব মাধ্যম সেটাকে ডিলিট করে দেয়।
হঠাত বিম লিংকে বিপ বিপ করে ওঠে। আর্জেন্ট কল। অনির্বাণ আড়ষ্ট হাতে কল সিলেক্টের বোতামটা টেপে। কি কল আসবে তা তার অবচেতন যেন আগে থেকেই জানে।
“সরি টু ইনফরম নির্মাণ গুপ্ত, ইয়োর ব্রাদার হ্যাস এক্সপায়ারড, আমরা ওকে রিভাইভ করতে পারি নি। ওর মস্তিষ্ক এনালিসিসের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর জিনিষপত্র চাইলে স্যানিটাইজ করে আপনাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।। কোন প্রশ্ন থাকলে ২২২৪৩০৪০ কোডে বিম ডায়াল করবেন। এই কোডটি এক মাস চালু থাকবে।“
“আপনার সোস্যাল ডাটাবেসে একটা লিঙ্ক আজ থেকে ডিএক্টিভেট করে হবে।“ আরো একটা মেসেজ টেক্সট। এআই এআই এআই। এআই কি মানুষকে বাঁচাতে পারে?
অনির্বাণের শেষ ফ্যামিলি লিঙ্কও মুছে যাবে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বাইরে সূর্য ঢলে যায়, কৃত্রিম সূর্যগুলো এখানে ওখানে জ্বলে ওঠে, বাইরে দেখা যায় ড্রোন ট্যাক্সির ওড়াউড়ি। শুধু পুলিসরাই ওগুলো ব্যবহার করে, এখনো পাবলিক সার্ভিস চালু হয় নি।
কতক্ষণ কেটে যায়, অনির্বাণ চুপ করে বসেই আছে। আবার বিম লিংকে বিপ বিপ করে ওঠে। হেলথ এলারম। এতক্ষণ সচল না থাকলেই এলারম বাজে। অনির্বাণ স্নুজ করে দেয়। আবার বাজে। আবার স্নুজ। আবার বাজে। এবারে আর বন্ধ করা যাবে না, তাহলে সোজা এমারজেন্সী সারভিসে খবর চলে যাবে আর ঐ ড্রোনগুলো এসে নামবে ওর বাড়ীর টেরাসে। অনির্বাণ এক ঝটকায় অ্যালার্ম থামিয়ে উঠে পড়ে। হেলথমেশিনে দাঁড়িয়ে সুইচ টেপে, ট্রেড মিল, অটো এক্সারসাইজার সব চালু হয়। অনির্বাণের চোখ করকর করে। কিছু বুঝতে পারে না কি করবে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
এখন অনেক রাত। অটো সূর্য গুলো, যার দশটাই সারা শহরকে আলো করে রাখে, তাদের রোজ কিছুক্ষণ নিভিয়ে দেওয়া হয়। এখন আকাশে অনেক তারা। তারার নদী বয়ে চলেছে, তাতে তারারা ডুবছে, ভাসছে, মিলিয়ে যাচ্ছে। ভ্যান গগের ছবির মত। তারা ভরা রাত। এক একটি তারা আমাদের গ্রহের থেকে বিলিয়ন গুণ বড়। কতটুকু একটা শরীর, আর ছোট্ট একটা মন, যা এখন সামান্য এআইএর সঙ্গে পেরে ওঠে না। কি এর মানে? কি এর মূল্য?
সাতটা দিন কেটে গেছে। কি করে সময় গেল অনির্বাণ নিজেও জানে না। একটা ব্ল্যাক হোলের মধ্যে যেন ওকে কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সময়, স্পেস সব যেখানে বেঁকে চুরে একটা টানেলের মত, যার ভিতর দিয়ে ও চলেছে, শরীর নেই, মন নেই, শুধু অস্তিত্ব আছে। নির্মাণকে দেখতে চেয়েছিল, দেখা হয় নি। ওর বডিপারটস সব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এনালিসিসের জন্য, ওরা নাকি তদন্ত করে বার করবে লিঙ্ক ফেলিওর কেন হয়েছিল, আর এতে নির্মাণের শরীরে কোথায় কি পরিবর্তন হয়েছিল। অনির্বাণ বোঝে, ওরা কভার আপ করছে। এটাই এখন স্বাভাবিক রীতি। সব কিছুই ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের ষড়ভুজের মত দুর্গে ঢুকে যায়, তারপর আর কিছু জানা যায় না। ওরা শুধু নির্মাণের চশমা আর একটা রুবিক্স কিউব যেটা ওকে ব্রেনের ব্যায়াম করার জন্য খেলতে দেওয়া হত, সেই দুটো পাঠিয়ে দিয়েছে স্যুভেনির হিসেবে। সেগুলো টেবিলে রাখা। পাশে একটা ইলেক্ট্রনিক ক্যান্ডেল জ্বলছে। তিন দিন একে ভাবে কাজ করে গেল অনির্বাণ । ভিঞ্চিকে মাঝে মাঝে অরডার করেছে, বেশিরভাগই কফি আর স্যান্ডউইচ। ক্রমাগত সার্চ করে গেছে আর শ্রী গুরুজীর হাতে তুলে দিয়েছে, সামারি করে ডেটা বেসে তুলে রাখার জন্য।
জানা গেছে অনেক চমকপ্রদ তথ্য।
২০২৮ সালে ৩০শে নভেম্বর সুনামি এসে ময়না দ্বীপ ধ্বংস হয়। গোপীনাথ দত্ত অদৃশ্য হন একই দিনে। আর ১লা ডিসেম্বর পৃথিবীর সব মিডিয়াতে খবর আসে ক্যাটজিপিটির পরে সব চেয়ে চমকপ্রদ এআইএর, যার নাম AXE. পৃথিবীর সব মিডিয়াতে এর খবর বেরোয়, জানা যায় এর আবিষ্কর্তার নাম গোপন থাকবে, সিকিউরিটির জন্য তা কোনদিন প্রকাশ করা হবে না।
অনেকগুলো খটকা। AXE কেন? পুরোন X যার পূর্বপুরুষ ছিল টুইটার, তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে? আর আবিষ্কর্তার নাম গোপন কেন? সবাই তো নিজের নামকে প্রচার ক্রতেই ভাল বাসে। যত প্রচার তত নাম, তত রুপি। নির্মাণের মনে হয় একবার খ্যাপা বিশুকে জানানো দরকার। পুরনো খবর, তখনকার অভিবাস্তব দাদুর থেকে কে ভালো জানবে। একটা মেসেজ পাঠায় বাবল চ্যানেলে। এই চ্যানেল আধ ঘণ্টা মাত্র চালু থাকবে, এর এনক্রিপশান কোয়ান্টাম কম্পিউটারও এই লেখার গোপনীয়তা এক লক্ষ বছরেও ভাঙ্গতে পারবে না। তাই টপ সিক্রেট মেসেজের জন্য সবাই এখন এটাই ব্যবহার করে।
উত্তর এলো দশ মিনিটেই,
“ওরে বোকা, পরশু ভ্যালি মনে আছে? আজ কাল পরশু নয়, পরশু মানে কুঠার। অ্যাক্স মানেও কুঠার। যে পরশু সেই অ্যাক্স বুঝলি? আর আবিষ্কর্তার নাম গোপন রাখা নতুন কিছু নয়। বিট কয়েন কে আবিষ্কার করেছিল জানিস? টুগ্লকে জিজ্ঞেস কর, বলবে, সাতোশি নাকামোতো। তিনিই প্রথম ক্রিপ্টো কারেন্সির আবিষ্কার করেন, আর তার জন্য বানান ব্লক চেন দিয়ে তৈরি এক ডাটা বেস। কে এই নাকামোতো? কেউ জানে না। আসলে এরকম কোন লোকই নেই। তেমনি কুঠার বা এক্স কার সেটাও গোপন রাখা হয়েছিল। তুই দেখ দুই আর দুইএ চার করতে পারিস না।
শেষকালে লেখা, নির্মাণ ইস এট পিস। তুই ওর জন্য কাঁদিস না।“
অ্যাক্স মানে কুঠার। পরশু মানে আজ কাল পরশু না, অ্যাক্স। আর গোপীনাথ? তিনিই কি এই রহস্যের নাকামোতো? সার্চ চালিয়ে যায়। দাদুর শেষ লাইনটা বুকের মধ্যে হজম করে নেয়। সার্চ শুরু করে গোপীনাথ দত্তের। মারভিন অনেক দিন পরে কাজ পেয়ে খুশি। চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ, মাথায় আলো ঘুরতে থাকে বনবন করে। তারপর গোলাপী আলো জ্বলে উঠলেই সে বলতে শুরু করে…
“গোপীনাথ দত্ত ছিলেন ভারতভূমির সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডিফলটার। নিয়মমত তাঁর জেলে থাকার কথা বা অন্তত তাঁর সব ব্যাঙ্ক একাউন্ট সিজ বা ফ্রিজ হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি আইন থেকে স্লিপ করে বেরিয়ে যেতে জানতেন। তাঁর একাউন্ট হয়ত ফ্রিজ হয়েছিল, কিন্তু তিনি সেটাকে পালটে দিয়েছিলেন ব্যাঙ্কের এআইএর ট্রেনিংয় গোলমাল করে। সেটা একটা বিরাট গল্প। জানতে চান?”
অনির্বাণ সম্মতি জানাবার জন্য বাঁ চোখ টেপে, সেটা মাউসের বাঁ বোতামের মত কাজ করে। মারভিন বুঝে নিয়ে বলতে থাকে,
“তাঁর একটা এআই স্টারটআপ দশ বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল । আসলে একটি আইটি সেল বললেই ঠিক বলা হবে। কখনো ভোটের জন্য কনটেন্ট বানিয়ে, কখনও তাঁর বিরোধী দলের সোসাল মিডিয়া স্ক্রেপ বা খোঁড়াখুঁড়ি করে। তিনি যে কখন এআইতে ঢুকে গেছেন সেটা গোপনই ছিল। প্রথমেই তিনি ব্যাংকের এআই চ্যাটবটের একটা বড় অর্ডার পান। অবশ্যই তিনি অফিস খুলে বসে সেটা ডেভলপ করতে বসে যান নি। কারণ ভারতভূমিতে ডেভলপ করার ইচ্ছে কারো কোন দিন হয় না। ভারতভূমি এক বিশাল কুলি উৎপাদক দেশ ও দু বিলিয়ন মানুষের কেনাকাটার জন্য এক বিশাল দোকান। গোপীনাথ ইস্রায়েলের এক কম্পানির সংগে চুক্তি করেন ডাটা সায়েন্টিস্ট সাপ্লাই দেবার জন্য। এই তথাকথিত তথ্যবিজ্ঞানীদের কাজ নেট থেকে বিভিন্ন ডাটা জোগাড় করে, সেগুলো ঝাড়াই বাছাই করে এআই নামক জন্তুটির মুখগহ্বরে ঢেলে যাওয়া। বডি শপিং তো নতুন কিছু নয়। আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজে যেমন কুলীরা যেত কাজ করতে, তেমনি সিলিকন ভ্যালী সাক্ষী আছে অসংখ্য ভারতীয় কম্পিউটার কুলির ফসিলের। দি গ্রেট কোডিং মেল্টডাউন শুরু হয় ক্যাটজিপিটি আবির্ভাবের সংগে সংগে। হাজার হাজার লোক লেঅফ হয়, হোমলেস হয়, সুইসাইড করে। প্যালেস্টাইন দেশটা পুরোপুরি ক্লীন আপ করে নতুন শহর বানাবার জন্য বিরাট যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে কয়েক লক্ষ বিহার ইউপির চাষা বডি হয়ে যায়। তারা ফেরে নি কেউ। এখন সেই ফাঁকা জায়গায় এআই ডাটা ফারম গড়ে উঠেছে, যেখানে কোটি কোটি সিপিইউ জিপিইউ এনপিইউ এআই নামক এক দ্বিতীয় ঈশ্বরের রাজ্য গড়ে তুলতে ব্যস্ত।
গোপীনাথ দত্ত আসলে সেখানে পাঠাতেন এআই কুলি। এদের কাজ তথ্য খোঁড়া, ঝাড়াই বাছাই করে ইঞ্জিনে ডাটা ঢালা। কয়লা ইঞ্জিনে ঢালার থেকে খুব আলাদা নয়। এর বদলে তিনি পেয়েছিলেন সারা ভারতভূমিতে চ্যাটবট বিক্রি করার একচ্ছত্র এজেন্সী।
ভারতভূমিতে করিৎকর্মা লোকের কোনদিন অভাব হয় না। এজেন্সী চালাতে চালাতে তাঁর হাতে চলে আসে ব্যাংকের বিভিন্ন ডাটা বেস একাউন্টের যাবতীয় ফাইলে পড়া ও পাল্টাবার চাবিকাঠি। তিনি চ্যাটবট বসাতে গিয়ে ব্যাঙ্কের এআই নতুন করে ট্রেন করার দায়িত্ব পান। সেখানেই হয় বাজিমাত। ফলে একদিন তাঁর পুরনো যাবতীয় লোনের রেকর্ড উধাও হয়ে যায় ব্যাঙ্ক থেকে। আর ব্যাঙ্কের এআইএর নিয়ম পালটে দেবার জন্য তিনি যখন তখন যে কোন মূল্যের টাকা যে কোন ব্যাংক থেকে তুলতে পারতেন। ফেরত দেবার কোন দায় ছিল না। এআই সব ব্যবস্থা করে দিত।"
কিন্তু মজার কথা হল কেউই জানতো না যে ময়নাদ্বীপ বলে আসলে কোনদিনই কিছু ছিল না। দ্বীপের পুরো খবরটা একেবারেই ভূয়ো। ভারতভূমি ততদিনে সম্পূর্ণ ডিজিটাল হয়ে গেছে। যেহেতু মিডিয়ার সব কিছুই ডিজিটাল হয়ে গেছে তাই সবাই এ দ্বীপ ডিজিটাল ডিভাইসেই দেখেন ও বিনিয়োগ করেন। সন্দেহ করার কোন ব্যাপার নেই। তাহলে ব্যাঙ্ক একাউন্ট সন্দেহ করতে হয়, ইভনিং নিউজ অবিশ্বাস করতে হয়, কে আর ঘুরে ঘুরে দেখে সার্টিফিকেট নেয়। কে ওয়াই সি বলে একটা ব্যাপার ততদিন চালু। তার সংগে ডিজিটাল আইডেন্টিটি। সবকিছুর একটা নম্বর। নম্বরটা যে কোন ব্রাউজারে ফেললেই তার ভূতবর্তমানভবিষ্যৎ সব জানা যাবে। তেমনি ছিল এই দ্বীপ। দ্বীপের একটা কে ওয়াই সি ছিল, সবাই সেটা চেক করে নিয়েছে। কিন্তু কেউ জানতো না এটা ছিল আসলে ভারচুয়াল এআই দিয়ে বানানো এক দ্বীপ। আর এর পিছনে মাথা পুরোটাই গোপীনাথ দত্তর। সবাই জানত ময়না দ্বীপ এক সত্যিকারের দ্বীপ। শুধু ডেভিড ছাড়া। ডেভিডের পুরো নাম ডেভিড লাখমান।
0 Comments