বাংলাদেশ ভ্রমণ
পর্ব ৬
রোশেনারা খান
লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে দেখলাম বড় বড় তিনতলা লঞ্চ জলে ভাসছে। এখানে হুমায়ুন কবির আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের কেবিন তিন তলার অপর। লিফটে করে ওপরে উঠছিলাম।ভুল বসত আমরা দো তলায় লিফট থেকে বেরিয়ে পড়ি। তারপর কী যে হল, লিফট আর চালু হলনা। এবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু লাগেজ নিয়ে কী করে উঠব? একটা বছর ১৫ র ছেলে বলল, ম্যাডাম আমি তুলে দেব’। ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে কেবিন খুঁজতে লাগলাম। একটা কেবিনে দুজন থাকা যাবে, আমার সহবস্থান করবেন সরস্বতীদি। কেবিনে দুদিকে দুটি সিংগল খাট-বিছানা। আখানে প্রায় সব জায়গাতেই দেখছি একটা করে লেপ রাখা আছে। এই গরমে লেপ দেখলে মেজাজও গরম হয়ে যায়।
অনুষ্ঠান থেকে সোজা চলে আসেছি। ড্রেস চেঞ্চ করা হয়নি। সরস্বতীদি টু-পিস পরলেন, আমি একখানা নরম সূতির শারি পরে কেবিন লক করে বেরিয়ে দেখি গৌতম বাবু কেবিনে ধুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আর খুলতে পারছেন না।বাইরে থেকে সাকিল ও আরও ২/৩জন বোঝানর চেষ্টা করছেন, কিন্তু অনার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। পাশে জানালা খোলা ছিল, সেখান দিয়ে মাথা গলিয়ে বললাম,কোন টা ধরে টান দিলে ছিটকিনি খুলবে। ডিনারের জন্য হুমায়ুন সাহেব বাড়ি থেকে খাবার এনে ছিলেন। ডিনারের পর আমরা ডেকে গিয়ে নদী আর চাঁদের প্রেমালাপ দেখতে দেখতে গল্প জোকস এসব চলছিল। মনটা হঠাৎ কেমন যেন হয়ে উঠল। ভাল লাগছিল না ওঁদের, হাসি, কথাবার্তা।আসতে করে উঠে গিয়ে একেবারে সাইডে যে চেয়ার পাতা আছে, সেখানে বসলাম। মনের ভিতরটা হু হু করে উঠল। চোখের পাতা ভিজে কপোল বেয়ে জল পড়তে লাগল।এখন আমি ওদের থেকে কত দূরে, তা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না।বুড়ি গঙ্গার বু্কে লঞ্চ ভাসছে
সেরিনা কাছে এসে বলল, দিদি আখানে একা বসে আছেন কেন? চলুন, সবাই মিলে চা খেতে যাব।ওর ডাকে উঠে পড়লাম। একেবারে নিচের তলায়, মানে গ্রাউন্দ ফ্লোরে চায়ের দোকান। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এক অন্য পৃথিবী দেখতে পেলাম। মস্ত মেঝের মাঝখান জুড়ে অসংখ্য মানুষ, যার মধ্যে ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে ৩/৪ মাসের শিশুও রয়েছে।জায়গাটা বেশ তাতেই তাতেই কেউ ঘুমিয়ে আছে কেউ জেগে আছে।আকটি ৩/৪ মাসের বাচ্চা কেঁদেই চলেছে, মা কিছুতেই ভোলাতে পারছে না। ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালাম। মাঝখানে মানুষজন মেঝেতে শুয়ে আছে।সাইডগুলোতে রাখা আছে ফারনিচার, বস্তায় ভরা নানারকম মালপত্র, আর রয়েছে প্রচুর বাইক।এরই একপাশে চায়ের দোকান। এখানে হাত বাড়ালে জল ছোঁয়া যাবে। কিন্তু মোটা শিকল দিয়ে ঘেরা আছে। চা খেয়ে আমরা আবার ডেকে এসে বসলাম। সরস্বতীদি গান ধরলেন। আমি, শাহাদাতদা ও সেরিনা শুধুই শ্রোতা।অন্যরা সবাই সরস্বতীদির সঙ্গে গলা মেলালেন। আমি গানের গ’ও জানিনা। তাছাড়া আমার এসব ভালও লাগছিল না। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। ফোনটা হারিয়ে গেল। একটা ফোন কিনতে চাইছি, সেটাও হচ্ছে না। সময় পাচ্ছে না সাকিল। আমার খুব রাগ হচ্ছে।সব কাজে সময় দেওয়া যাচ্ছে, শুধু আমার ফোন কেনার সময় হচ্ছে না!এটাই আমার সাকিলের অপর রাগের কারণ। পাশাপাশি আরও লঞ্চ ভেসে চলেছে।আমাদের থেকে অনেকদুরে একটা লঞ্চ ভেসে যাচ্ছিল। এখন সেটা অনেক কাছে এসে গেছে। মানে আমাদের লঞ্চ অনেক স্পিডে চলছে। হুমায়ুন সাহেব একটা বিষয় জানালেন, জা আমাদের কারুর জানা ছিল না। এই যে লঞ্চগুলি, এরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন লেন ধরে যাচ্ছে। জলের তলদেশে প্রয়োজন মত গভীরতায় লেন গুলি তৈরি করা হয়েছে। কারণ নদীর গভীরতা সব জায়গায় সমান নয়। কম গভীরতায় লঞ্চ আটকে যেতে পারে। কোন নদীর অপর দিয়ে ভেসে চলেছি, তার নামটায় বলা হয়নি। আমরা বুড়ি গঙ্গার ওপর থেকে রওনা হয়েছি, পরে মেঘনা, পদ্মা যমুনা এই স্রোতে মিশেছে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
একসময় আমরা সবাই যে যার কেবিনে চলে এলাম।সরস্বতীদি আমি কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছি।ঘুম ভাঙল গৌতমদা দরজায় নক করাতে।আমরা বরিশাল পৌঁছে গিয়েছি। কিছুক্ষণ পরেই নামতে হবে। সবই তো গুছনো আছে।ব্রাস করে এলোমেলো চুলটা ঠিক করে নিলাম। মাটিতে পা রেখে বুকের মধ্যে যে একটা চাপা ভয় কাজ করছিল, তা থেকে মুক্তি পেলাম। এখানে রাত্রি বাসের ব্যবস্থা করেছেন, হুমায়ুন সাহেব নিজে। গেস্ট হাউসের রুম, বেড, ওয়াসরুম সবই বেশ বড়,পরিচ্ছন্ন ও বড়। আমি সরস্বতীদি একটা রুমে থাকব ঠিক করেছিলাম, ছিলামও তাই।লঞ্চের ডেক আমরা সবাই
এখন সকাল, হুমায়ুন কবির আমাদের ব্রেকফাস্ট করাতে নিয়ে বের হলেন। সবার সম্মতি ক্রমে ঠিক হয়েছে সবাই চিঁরেদই খাব। হুমায়ুন আমাদের ওনার পরিচিত ও বহু পুরনো একটি দোকানে নিয়ে গেলেন। কাঁসার পাত্রে আমাদের খেতে দেওয়া হল। চিড়ে দইয়ের সঙ্গে খই, মাখন আরও কি সব ছিল। খেতে ভালই লাগল। এখান থেকে বের হয়ে গ্রুপ ছবি তোলা হল। তারপর আমরা রওনা দিলাম জীবনানন্দ দাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে। একটা বহু প্রাচীন বাড়ির ভগ্নস্তূপ দেখিয়ে হুমায়ুন বললেন, এটা জীবনানন্দ দাশের স্কুল ছিল। জীবনানন্দের বাড়ি দেখতে গিয়ে হতাশ হলাম। গেটের পাশে লেখা আছে, ধানসিঁড়ি, পশ্চিম বগুড়া রোড, বরিশাল। এইটুকুই, ভেতরে ঢুকে কিছুই খুঁজে পেলাম না। সব নতুন বাড়ি। শুনলাম কবির জ্ঞাতিরা সব বিক্রি করে ভারতে চলে গেছেন।জীবনানন্দের বাবা সর্বানন্দ দাসগুপ্ত তার ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এইখানে ছয়বিঘা জমির ওপর বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করেন.১৯০৭ এ ছেলেরা বাবার নামানুসারে বাড়িটির নাম দেন ‘সর্বানন্দভবন’.১৯৬০ সালে এই বাড়িটি বিক্রি হয়ে যায়। আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ভদ্রলোক বাড়িটি কিনে নেন।পরে কোনো এক সময় কবির সম্মানার্থে এই বাড়ির নামকরণ হয় ‘ধানসিঁড়ি’। স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার আব্দুর রাজ্জাকের বংশধরদের থেকে কিছু জমি অধিগ্রহণ করে ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পাঠাগার’ তৈরি করে।জীবনানন্দের স্মৃতি বলতে এটুকুই।যে বাড়িতে সর্বানন্দের পরিবার বাস করতেন, তা আর নেই। সেখানে নতুন বাড়ি গড়ে উঠেছে। মনে অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম আমার প্রিয় কবির বাড়ি দেখব বলে। আমার দুর্ভাগ্য, কিছুই দেখতে পেলাম না। কিছু নেই তো দেখব কী করে?
ক্রমশ
প্রকাশিতব্য...
0 Comments