মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১৮
তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত (শিক্ষক নেতৃত্ব, প্রবন্ধকার, লোক গবেষক, কোলাঘাট)
ভাস্করব্রত পতি
ঘাটালের দাসপুর থানার উদয়চক (বরুণা) গ্রামে আদি বাড়ি। ঠাকুরদা যোগেন্দ্রনাথ রাজপণ্ডিত এবং জ্যাঠামশাই রেবতীরঞ্জন রাজপণ্ডিত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁদের অনুপ্রেরণায় স্কুলের ছাত্রাবস্থাতেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কারাবরণ করেছিলেন জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ফের পড়াশোনা শুরু করেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। । সেইসাথে সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য চর্চার সাথেও যুক্ত করেন নিজেকে। জীবনের ৩২ টি বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র ইংরেজ বিরোধিতা এবং জনহিতকর কাজের মাধ্যমে। যোগেন্দ্রনাথ এবং মা নগেন্দ্রনন্দিনীর তিন সন্তান -- রেবতীরঞ্জন, জানকীরঞ্জন এবং কিশোরীরঞ্জন।
তাপসকান্তি রাজপণ্ডিতের হাতের লেখা
১৯৪৭ এর ১৭ ই অক্টোবর ছিল দুর্গাপূজার অষ্টমী। ক'দিন আগেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। চারিদিকে উৎসব। পুলশিটায় মামাবাড়িতে মা তারা রাজপণ্ডিতের কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করলেন তাপসকান্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বাড়িতে উদয় হল স্বাধীন দেশের প্রথম নাগরিক। সেখানে তাই বাড়তি উৎসব। জন্ম হয়েছে পরিবারের তৃতীয় সন্তানের। জানকীরঞ্জন এবং তারাদেবীর চার সন্তান তপনকান্তি, তপতী, তাপসকান্তি এবং মালবিকা। প্রত্যেকেই তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিরাজিত হয়েছেন।
একসময় দাদুর শহরের বাড়ি হুগলী জেলার কোন্নগরে কাটিয়েছেন। গ্রামের পরিবেশকে প্রাণ খুলে উপভোগ করেছেন। আসলে পারিবারিক গরিমার দিক থেকে তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত অত্যন্ত enriched ছিলেন। ছোট থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পরিবেশ, সমাজ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি, আন্দোলন সবকিছুই জীবনের সাথে লেপটে রাখতে পেরেছিলেন যথার্থ পারিবারিক শিক্ষার কারণে।
তাপসকান্তি রাজপণ্ডিতের সাথে
কবিরাজ অমরনাথ গোস্বামীর স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 'পুলশিটা কুসুমকুমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়'। তিনি ছিলেন তারা রাজপণ্ডিতের ঠাকুরদা। শিশু শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়াশোনা করার পর দেউলিয়া হীরারাম উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম হতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। ১৯৬২ তে কোলা ইউনিয়ন হাইস্কুলে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে। এখানে নবম শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
১৯৬৫ তে জুলজিতে অনার্স নিয়ে কলকাতায় সিটি কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৬৮ তে তা শেষ করেন। এরপরই যুক্ত হয়ে পড়েন শিক্ষকতায়। ১৯৬৯ সালেই নিজের পরিচিত কোলা ইউনিয়ন হাইস্কুলে বায়োলজির শিক্ষক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন। এর পাঁচ বছর পরে ১৯৭৪ সালে বি.এড. ডিগ্রি পেতে ভর্তি হন পাঁশকুড়া বনমালী কলেজে।
একসময় ইচ্ছে হল জুলজিতে এম এস সি পড়বেন। তখন ১৯৭০-১৯৭১ সাল। এই অভিপ্রায়ে সরকারি ইউনিভার্সিটির ডেমনস্ট্রেটর পদে চাকুরির পরীক্ষায় প্যানেলের প্রথমে নাম থাকলেও, তৎকালীন রাজ্য সরকারের বদান্যতায় প্যানেলটি খারিজ হয়ে যায়। সেই সময়ে ফিশারি অফিসারের চাকুরির পরীক্ষায় প্যানেলভুক্ত হলেও একইভাবে সেটিও বাতিল হয়ে যায়। এরপর আরও অনেক পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যালয়ের কর্মজীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন কর্মপাগল মানুষ। অত্যন্ত অমায়িক, বন্ধুবৎসল এবং হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল এক নেতৃত্ব। তাই অবসরের পরেও তাঁর কাজ থেমে থাকেনি।
প্রাচীন মুদ্রা নিয়ে কাজ করছেন তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত
দুই শিক্ষক শশধর গিরি এবং জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিতের শ্রেণিকক্ষের পাঠদানই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে। শিশু বয়স থেকে নিয়মিত পড়তেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার, লীলা মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুখলতা রাও, সুকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বইপত্র। এগুলো উপহার পেতেন। আর তৎক্ষণাৎ গলাধঃকরণ করতেন।
খুব ছোটোবেলায় 'যুগান্তর' পত্রিকার 'স্বপনবুড়ো'র 'ছোটোদের পাততাড়ি'র সাথে যুক্ত ছিলেন। সেইসাথে জলপাইগুড়ির 'রত্নাকর' পরিচালিত 'ডানপিটেদের আসর' সংগঠনের সাথেও নিজেকে একাত্মিভূত করে রেখেছিলেন নিজের সাহিত্যপ্রবণ মন ও মানসিকতার লালন পালনের জন্য। যোগেন্দ্রনাথ রাজপণ্ডিতের আলমারি ভরা ছিল আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত বইতে। এছাড়াও ছিল 'ভারতবর্ষ' আর 'প্রবাসী' পত্রিকা। বাবার কাছে পেতেন 'শিশুসাথী' পত্রিকা। বাড়িতে আসতো সাপ্তাহিক আর মাসিক 'বসুমতী' পত্রিকা। এছাড়াও স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা নানারকম বই সহ পার্শ্ববর্তী 'পুলশিটা বিদ্যাসাগর পাঠাগার', 'কোলাঘাট দেশপ্রাণ পাঠাগার' এর বইগুলি ছিল তাঁর মনের খিদে মেটানোর অন্যতম উপকরণ। ধীরে ধীরে সাহিত্য সংস্কৃতিতে মন মজিয়ে তোলেন। নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে শুরু করেন আবৃত্তি, নাটক, বক্তৃতা, বির্তক সভা, ম্যাগাজিন প্রকাশ এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সাথে।
একান্ত আলাপচারিতায় কালীপদ চৌধুরী ও তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত
রাজনৈতিকভাবে আদ্যন্ত বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী এই মানুষ রতনটি চাকরির সূচনা পর্ব থেকেই এবিটিএ' র সদস্য ছিলেন। সংগঠনের মহকুমা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে সমিতির প্রকাশিত সপ্তম শ্রেণির জীবনবিজ্ঞান বইটি রচনা করেছিলেন একসময়। যা বেশ কয়েক বছর ছাত্রদের মধ্যে দারুনভাবে সাড়া ফেলে। ২০০২ এর ১০ ই মার্চ সাংগঠনিকভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির প্রথম সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। পরবর্তীতে হন জেলা সভাপতি। সর্ব ভারতীয় শিক্ষা আন্দোলনের যৌথমঞ্চ স্কুল টিচার্স ফেডারেশন অফ ইণ্ডিয়া (STFI)-র কর্মী হিসাবে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছেন। ডান বাম সহ সকল শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে তাঁর নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। সকলের সাথে মিশতেন। সকলের কথা শুনতেন। সব মিলিয়ে ১৪ বছর জেলা নেতৃত্বের দায়িত্ব সামলেছেন।
তিনি শিক্ষক নেতার পাশাপাশি প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন আদ্যপান্ত সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন মানুষ। ১৯৭৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কোলাঘাট 'রক্তিম' শাখার সংগে যুক্ত হন। ১৯৯৭ সালে শাখা সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০০২ সালে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা গণনাট্য সংঘের সহঃ সভাপতি হন। ১৯৮২ সালে অবিভক্ত জেলার গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের প্রস্তুতি কমিটির সদস্য হিসেবে বৈরাগ্য চক্রবর্তী ও তাপসকান্তি রাজপণ্ডিতের নাম নথিভুক্ত হওয়ার পর ১৯৮৩ র প্রথম জেলা সম্মেলনে তাঁরা দুজনেই জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত রক্তিম শাখার 'শিশু সম্মিলন'- এ অন্যতম সংগঠক হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯৮৮ তে কিশোর বাহিনী 'কোরক' শাখার সংগঠক হিসাবে যুক্ত ছিলেন।
আমার সংগ্রহ করা বই ও সামগ্রী দেখছেন তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত
লেখালেখি ভালোবাসতেন। সাধারণ শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের কথা তিনি লিখতে চাইতেন। মানুষের কথা, জীবনের কথা, ইতিহাসের কথা তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ফুটে বেরোতো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। দৈনিক 'গণশক্তি' পত্রিকাতে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত জেলার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে 'প্রবীণ দর্পণ' নামে একটি সংবাদধর্মী প্রতিবেদন বিষয়ক পত্রিকা পূর্ণচন্দ্র গিরি ও তিনি যৌথভাবে সম্পাদনা শুরু করেন।
তীব্র আকর্ষণ ছিল পুরাতত্ত্ব সম্পর্কেও। আর এর বীজ বপন হয়েছিল প্রখ্যাত পুরাতত্ববিদ তারাপদ সাঁতরার হাত ধরে। ১৯৭১ এ আনন্দনিকেতন কীর্তিশালায় পুরাকীর্তি ও মন্দির স্থাপত্য গবেষক তারাপদ সাঁতরার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ভালোবেসে ফেলেন মানুষটিকে। প্রতি সপ্তাহে নবাসনে কীর্তিশালায় ছুটতেন তাঁর কথা শোনার জন্য। কখনো কখনো বেরিয়ে পড়তেন তারাপদ সাঁতরার সফরসঙ্গী হয়ে। ১৯৭২ এ স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী বর্ষে কোলাঘাট স্কুলে তাপসকান্তি রাজপণ্ডিতের দায়িত্বে 'নবজীবনের পথে' শীর্ষক প্রাচীরপত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি তারাপদ সাঁতরার সহযোগিতায় 'পাঁশকুড়া থানার মন্দির স্থাপত্য' বিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং আনন্দনিকেতন কীর্তিশালা থেকে নিয়ে আসা পুরাবস্তু সামগ্রীর 'আমাদের সংস্কৃতি' শীর্ষক প্রদর্শনী করা হয়। পুরাকীর্তি সম্পর্কে আরও অনুসন্ধিৎসা জাগরিত হতে থাকে তাঁর। ২০০১ সালে 'কোলাঘাট লোকসংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা' গড়ে তোলেন ড. শ্যামল বেরার বাসাবাড়িতে।
১৪০১ বঙ্গাব্দে পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট থেকে প্রথম প্রকাশ ঘটে 'লোকায়ত' পত্রিকার। লোকসংস্কৃতি বিষয়ক এই পত্রিকাটি তাপসকান্তি রাজপন্ডিত, ড. শ্যামল বেরা এবং শংকর মহাপাত্রদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতি সংখ্যায় ক্ষেত্রসমীক্ষালন্ধ এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও নিবন্ধ নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। 'আমাদের ইতিহাস সংস্কৃতির সত্যরূপ অন্বেষণ করা এবং তুলে ধরা' - এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করাই লক্ষ্য ছিল পত্রিকার। 'লোকায়ত' মনে করে ইতিহাসকে গল্পে পরিণত করলে, তার পরিণতি দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। এই বিপদের হাত থেকে দেশ ও দেশের ইতিহাসকে বাঁচানােই আমাদের দেশপ্রেমের পরিচায়ক হয়ে উঠুক। এখানে লিখেছেন তারাপদ সাঁতরা, ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক, মােহিনীমােহন গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর মহাপাত্র, শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, তপনকুমার দাস, অজিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত গবেষকগণ।
বাল্যবন্ধু মেঘনাদ দের সাথে তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত
সবধরণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজে, ধর্মীয় মৌলবাদের এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে প্রচার, বিজ্ঞান মনস্কতা, পরমত সহিষ্ণুতা, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, যুক্তিবাদী মানসিকতা, মুক্ত মনন, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ, নান্দনিকতা, মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সঞ্চারের কাজে অংহগ্রহণ করতেন এই মানুষটি। আজকের এই উথালপাথাল পরিবেশে তাঁর মতো মুক্তমনা মানুষের খুব প্রয়োজন। ২০২৩ এর ৯ ই জুলাই এই সদাহাস্যময় মানুষটির মহাপ্রয়াণ ঘটে।
🍂
0 Comments