জ্বলদর্চি

বাংলাদেশ ভ্রমণ—পর্ব ৭/রোশেনারা খান

লালনেল সমাধি প্রাঙ্গনের গেট।

বাংলাদেশ ভ্রমণ
পর্ব ৭

রোশেনারা খান


ভাঙ্গা মন নিয়ে আমরা আবার সবাই কাশীপুর চললাম চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত ‘কালী বাড়ি’ দেখতে।বেশ কিছুটা হেঁটে কালীবাড়ির সামনে উপস্থিত হলাম।মস্ত গেটে চারণকবি মুকুন্দ দাসের গানের কয়েকটি পংতি লেখা রয়েছে,-  ‘বান এসেছে মরা গাঙে খুলতে হবে নাও/তোমরা এখনো ঘুমাও? এখনো ঘুমাও’!আমরা সাইডের ছোট গেট দিয়ে ভিতরে গেলাম।মন্দিরের চত্তরটি বেশ বাঁধানো ও পরিচ্ছন। কয়েকটা আমাগাছ রয়েছে। মনে হতেই পারে, দুদণ্ড বসে জিরিয়েনি। কালী মন্দিরের একপাশের বারান্দায় আমরা ২/৩জন বসে পড়লাম।ওরা ছবি তুলল, আমার ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও পারলাম না। গেটের সামনে শাকিল ছবি তুলে দিল।

       বরিশালে আসার প্রধান উদ্দেশ্য হল সরস্বতীদির জন্মস্থান দেখতে যাওয়া। কাউখালি থানার  এক গ্রামে হালদার পরিবারে ওনার জন্ম। শৈশবের কথা  কিছু কিছু মনে আছে।আমরা দুখানা টোটো ভাড়া করে চললাম কাউখালির উদ্দেশ্যে।আমরা সামনের টোটোতে ছিলাম। পিছনেরটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। একসময় আমরা সন্ধ্যা নদীর ধারে পৌঁছে গেলাম, কিনতু পিছনের টোটো আসেনি।  জানা গেল ওরা হুমায়ুন সাহেবের সঙ্গে থানায় গেছেন। আমাদের ওখানেই যেতে বললেন।অগত্যা আমরাও গেলাম। হুমায়ুন সাহেব ওসির সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদেরকে ফল ও মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন।থানার দুজন স্টাফকে সঙ্গে দিলেন।

      সন্ধ্যা নদীর ওপারে নৌকো চড়ে যেতে হবে।আমি প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, যাবনা। নদীর এপারে অপেক্ষা করব। থানা থেকে রওনা হওয়ার সময় আমি পিছনের টোটোতে ছিলাম, নদীঘাটে পৌঁছাতে আমাদের মিনিট পাঁচ দেরি হল।পৌঁছে শুনি সরস্বতীদির সঙ্গে  সাকিল, হুমায়ুন সাহেব ও থানার দুজন স্তাফ ছাড়া আর কেউ যাচ্ছেন না। কারণ নদী পার হলেই হবে না,ঘাটে পৌঁছে বাইক ভাড়া পাওয়া যায়,বাইকে চড়ে সরস্বতীদির  গ্রাম হরিণদাঁড়ির ভিতরে যেতে হবে। তাই কেউ  যাচ্ছেন না। নদীর জলের ওপর বাঁশের বেড়া, আর টিনের ছাউনি দেওয়া প্রতিক্ষালয়ে আমরা ক’জন বসে গল্প করতে লাগলাম। সেরিনার হাতে চিপ্সের প্যাকেট ছিল, আমিই প্রায় সবটা শেষ করে দিলাম। জেনে বুঝে নয়, অন্যমনস্ক হয়ে খেয়ে ফেলেছি। একমুখ হাসি নিয়ে সরস্বতীদি ফিরে এলেন। গ্রামে একটিই হালদার পরিবার রয়েছে। সেটিই নাকি সরস্বতীদির পৈতৃক ভিটা। ওখানে   একটি বাড়ি রয়েছে। বাড়িতে এক বৃদ্ধা তাঁর ছেলেদের নিয়ে বাস করেন। তিনি সম্পর্কে সরস্বতীদির কাকিমা। তাঁর ছেলেরা গাছ থেকে ডাব পেড়ে সবাইকে খাইয়েছেন। গাছের আম পেড়ে ্দিয়েছেন। এসব গল্পই শুনছিলাম। তবে মায়াদি  বিশ্বাস করছেন না।

     যাইহোক আমরা লাঞ্চ করে গেস্ট হাউসে ফিরে আর একবর স্নান করে বিছানায় গেলাম। আজ রাতে এস পি সাহেব আমাদের ডিনারে আমন্ত্রন করেছেন। সন্ধ্যায় গাড়ি আমাদের নিতে এলে সাকিল আমি গৌতমবাবু প্রথমে এলাম। গাড়ি আবার ওদের নিতে গেল। আমাদের ডিনারের আয়োজন করা হয়ে ছিল। ‘ওয়াচ টাওয়ার’এর ওপরে। গাড়ি থেকে নেমে কোনদিকে না তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।বিশাল এক নদী, সেই নদীতে পূর্ণ চাঁদের দীর্ঘ ছায়া   এক স্বপ্নিল পরিবেশের অবতারণা করেছে। সাকিলের ফোন নিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। মনে পড়ে গেল নিজেরি লেখা কবিতার লাইন-‘ মেঘের বুকে চাঁদও ছিল নদীর বুকে ছায়া / তবু কেন হয়নি আমার তোমায় কাছে পাওয়া’।

      কিছুক্ষণের পরে হুমায়ুন সাহেব বাকি সবাইকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।  ওরাও চাঁদ ও নদীর এমন মধুর মিলন দেখে ওখানেই বসে পড়লেন। আমাদের জন্য চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছিল। ওহ, নদীর নামটাই তো বলা হয় নি!দিগন্ত বিস্তৃত এই নদীটির নান ‘কীর্তনখোলা’।এমন নামের কারণ বুঝলাম না। অবশ্য  নামে কিছু এসে যায় না।নদীর তীর বরাবর রাস্তায় অনেকেই সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছেন। একদল যুবক গাছের ছায়ার আধো অন্ধকারে বসে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। এরমধ্যে এস পি মোল্লা আজাদ হোসেন এলেন ক্যাজুয়্যাল ড্রেস, মানে পাজামা- পাঞ্জাবি পরে। আমাদের নিয়ে গেলেন ওয়াচ টাওয়ারের ওপর। এখানেই  আমাদের সুন্দর বসার ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের ডিনার পরিবেসন করা হল।পরটা, দেশি মুরগির মাংসকষা, ডিম দই মিষ্টি আরও অনেক কিছু।  
🍂
       ডিনারের পর শুরু হল আড্ডা। এস পি সাহেব রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনালেন, সরস্বতীদি ও গান শোনালেন। অনেকে কবিতা শোনালেন। বিতর্ক আমার পিছু ছাড়ে না।এই পর্যন্ত এখানকার মুসলিমদের যেটুকু চেনা সম্ভব হয়েছে,তাতে আমার মনে হয়েছে, পসচিম বঙ্গের মুসলিমদের থেকে বাংলাদেশের মুসলিমরা অনেক বেশি বাঙ্গালি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ভাবনায়, চেতনাই আজও    মুসলিম হয়েই রয়েগেছে, বাঙালি হয়ে উঠতে পারেননি। কথাগুলো আমি দুইদেশের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছি।আমরা ওপারের মুসলিম বাঙ্গালিরা বাংলা সংস্কৃতিকে এখানের মত ধারণ ও বহন করতে পারিনা। সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব সঙ্কটের ভয় একটা কারণ হতে পারে।সাহিত্যচর্চা অনেকেই করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ২/১ জন আমলা, আধিকারিকও রয়েছেন।কিন্তু নাটক, সিনেমা, সঙ্গীতে বাঙালি মুসলিমদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এখন এই আড্ডায় এস পি সাহেব কী সুন্দর গান গেয়ে শনালেন, কক্সবাজারে কবি কামরুল হাসান যে পাঞ্জাবিটি পরে ছিলেন তাতে মানুষের ছবি আঁকা রয়েছে। এইধরনের মানুষ বা পশুপাখির ছবি আঁকা সাড়ি ও  অন্যান্য পোশাক পরা ইসলামে নিষিদ্ধ। বিশেষ করে কোনও ধর্মীয় ও  শুভ কাজে একেবারেই নিষিদ্ধ। সেই কারণেই হয়ত এইরকম পাঞ্জাবি,টিশার্ট, পরতে দেখেছি বলে মনে হয় না। আমরাও স্বস্তিক চিনহ বা প্রতিমা, বা মন্দির, মানুষ আঁকা শাড়ি এড়িয়ে চলি।কাউখালি থানা

এসব কথা অবশ্য বলা হয়ে ওঠেনি। কারণ আমার কথাটা ওনারা বোঝার চেষ্টাই করলেন না। ওনারা ধরে বসলেন আমার সেই কথাটি, ‘আমরা আমার দেশে আমার বাংলায় যে অধিকাংশ লোকের কাছে, মুসলিম হয়ে রয়ে গেছি,বাঙ্গালি হয়ে উঠতে পারিনি’।তাঁদের বক্তব্য, তাঁরা এমনটা বলেন না।কীর্তনখোলা নদীর বুকে চাঁদের ছায়া।

     বেশ রাত হল গেস্ট হাউসে ফিরতে। আগামীকাল কুষ্টিয়া যাওয়া হবে।প্রথম থেকেই রুট চার্ট এরকম থাকলেও পরে ঠিক হয়ে ছিল আমরা যশোর যাব। ওখান থেকে নাকি বর্ডার কাছে।কিন্তু দুপুরে সাকিল, গৌতম বাবু, হুমায়ুন সাহেব টিকিট কাটতে গিয়ে কুষ্টিয়ার টিকিট করে এনেছেন।গরমে অতিরিক্ত কষ্টের জন্য কুষ্টিয়া যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম।যাক, ভালই হল শিলাইদহ বেড়িয়ে আসা যাবে। গেস্ট হাউসে ফিরে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।

 (ক্রমশ)   
২২ শে শ্রাবণ 👇
                                          

Post a Comment

0 Comments