জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে / ৪৫তম পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে  
৪৫তম পর্ব   

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী       

তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব               
        
দু রাত্রি দ্বারকাতে অতিবাহিত করার পরে তৃতীয় দিন সকালে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে একজন ট্যাক্সিচালকের সাথে কথা বললাম যে আমাদের নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, গোপী তালাও, ওখা, বেট দ্বারকা দেখিয়ে ফেরার সময়ে রুক্মিনী মন্দির দর্শন করিয়ে রাত্রি সাড়ে সাতটার মধ্যে পৌঁছে দিবে। আমরা তার কথা অনূযায়ী দুপুর একটার মধ্যে তৈরি হয়ে হোটেলের নিচে নেমে এলাম। ট্যাক্সি চালক নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের নিয়ে দ্বারকা-ওখা রাজ্য সড়ক ধরে প্রথমে নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ অভিমুখে রওনা হল। দ্বারকার পরে রাস্তার দুপাশে কাঁটা গাছের সারি। লবণাক্ত মৃত্তিকা এবং স্বল্প বৃষ্টিপাত অঞ্চল হওয়ার জন্য এখানে সেরকম বড় গাছ দেখতে পাইনি। আধ ঘন্টার মধ্যে আমরা নাগেশ্বর গিয়ে পৌঁছালাম। বহুদূর থেকে মন্দিরের বাইরে ৮০ফুট উচ্চতার ভগবান মহাদেবের পদ্মাসনে আসীন চতুর্ভুজ মূর্তি দেখা যায়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গলদেশে এবং দুই বাহুতে নাগরাজ বেষ্টিত, মস্তকে অর্ধচন্দ্র, উপরের দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল, নিচের হস্তে বরাভয় মুদ্রা। বাম দিকের উপরের হস্তে ডমরু এবং নিচের হস্ত জানুর উপরে স্থাপিত। নাগেশ্বর মহাদেবের নবনির্মিত মন্দির ও মন্দির সম্মুখস্থ মহাদেবের মূর্তি নির্মাণ করেছেন মুম্বাইয়ের অডিও ও ক্যাসেট নির্মাতা বিশিষ্ট শিল্পপতি গুলশন কুমার। একবার দ্বারকাধাম দর্শন করতে এসে তিনি নাগেশ্বর মন্দিরে এসেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর জরাজীর্ণ মন্দিরটি দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। মন্দির কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে তিনি এই মন্দিরের সংস্কার সাধন করে নতুন ভাবে নির্মাণ করে দেন। মুম্বাইয়ের বাস্তুশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ শ্রী সুভাষ ভোইতের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে বাস্তুশাস্ত্রের শয়নতত্ত্ব অনুযায়ী মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। পশ্চিমমুখী মন্দিরদ্বারে প্রবেশ করার পরে দু ফুট উচ্চতায় নাটমন্দির। নাটমন্দির দৈর্ঘ্যে ৮৪ ফুট, প্রস্থে ৭৬ফুট এবং উচ্চতায় কুড়ি ফুট। নাটমন্দিরের প্রবেশদ্বারের ডানদিকে শনি দেবতার মন্দির। শনি দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে আমরা নাটমন্দিরে প্রবেশ করলাম। নাটমন্দিরের প্রবেশদ্বারে গণেশ ও হনুমানজীর মূর্তি। নাটমন্দিরটি আয়তনে বিশাল, একসাথে প্রায় সাড়ে বারোশ দর্শনার্থীর বসার ব্যবস্থা আছে। নাটমন্দিরের শিখরদেশ অনেকটা বৌদ্ধ প্যাগোডার ন্যায় ধাপে ধাপে ক্রমশ সরু হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। শিখর দেশে কলস বসানো এবং তার উপরে স্বস্তিক চিহ্ন। নাটমন্দিরে প্রবেশ করে আমরা ফুল, বেলপাতা, শুকনো নৈবিদ্য, (কাজুবাদাম, কিসমিশ ও চিনির নকুল দানা) দুধ কিনে গর্ভগৃহে যাবার পরে পূজারী আমাদের পুজো নিবেদন করলেন। তীর্থযাত্রীর সংখ্যা অন্যান্য জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের তুলনায় কম। আসলে সেই সময় সবেমাত্র মন্দির খুলেছে। সকলেই ধীরভাবে লাইন দিয়ে গর্ভগৃহে যেয়ে প্রবেশ করে দর্শন ও পুজো দিচ্ছেন। নাটমন্দির থেকে চার ফুট নিচে গর্ভগৃহ যেখানে মহাদেবের জ্যোতির্লিঙ্গ পুজিত হচ্ছেন। গর্ভগৃহটি দৈর্ঘ্যে ১৬ ফুট এবং প্রস্থে ১৬ ফুট বিশিষ্ট একটি বর্গাকার ক্ষেত্র। জ্যোতির্লিঙ্গ পূর্বমুখী এবং গর্ভগৃহে প্রবেশের দ্বার দক্ষিণমুখী। এখানকার পূজারীর মুখে এই দক্ষিণমুখী দ্বার সম্বন্ধে একটি অলৌকিক ঘটনা আমরা জানতে পারি। একবার নামদেব নামে এক সাধক এখানে এসে গর্ভগৃহের সম্মুখে বসে মহাদেবের ভজন গান গাইছিলেন। অন্যান্য তীর্থযাত্রীদের প্রবেশে তাদের অসুবিধা হতে তারা নামদেবকে দ্বার ছেড়ে দূরে বসতে বলার পরে তিনি তাদেরকে তার বসার জন্য নির্দ্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে দিতে বলেন যেখানে বসে তিনি পুনরায় নিবিষ্টমনে ভজনগান গাইতে পারেন। তীর্থযাত্রীরা তাঁকে গর্ভগৃহের দক্ষিণ দিকে সরে বসতে বললেন। আশ্চর্যের ব্যাপার তিনি দক্ষিণ দিকে সরে যাবার পরে সকলে লক্ষ্য করলেন পশ্চিমমুখী গর্ভগৃহের দ্বার রুদ্ধ হয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে গেল। সেই থেকে গর্ভগৃহের দ্বার এই দক্ষিণ দিকেই আছে, এর আর কোনো পরিবর্তন হয়নি।

🍂
নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ সম্বন্ধে শিব পুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতায় বলা হয়েছে পশ্চিমদেশে সমুদ্রের তীরে এক গভীর বন ছিল যা সর্বরূপে সমৃদ্ধপূর্ণ। সেখানে দারুকা নামে এক রাক্ষসী ছিল যে পার্বতীর বরে সর্বদা অহঙ্কারে পূর্ণ হয়ে থাকতো এবং তার স্বামী সেই অহঙ্কারে সেখানকার ব্রাহ্মণদের যাগযজ্ঞ বিনষ্ট এবং ধর্মনাশ করে বিচরণ করত। দারুক রাক্ষসের ভয়ে সেই অঞ্চলের প্রজারা মহর্ষি ঔর্বের কাছে গিয়ে তাদের দুঃখের কথা বলতে মহর্ষি ঔর্ব শরণাগতদের রক্ষার জন্য রাক্ষসদের অভিশাপ দিয়ে বললেন 'তা'রা এই বনাঞ্চলে প্রাণীদের হিংসা বা মুণি-ঋষিদের যাগযজ্ঞ নষ্ট করলে তাদেরকে প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে হবে'। মহর্ষি ঔর্বের অভিশাপের কথা শুনে রাক্ষসী দারুকা তখন মা পার্বতীর আশীর্বাদে সমগ্র বনাঞ্চলটিকে সেস্থান থেকে সমুদ্রের মধ্যে নিয়ে গেল এবং পূর্বের ন্যায় সেখানেও প্রাণীদের হত্যা করতে লাগলো। একবার সমুদ্রের তীর ধরে সুপ্রিয় নামে এক বৈশ্য বানিজ্যতরী নিয়ে যাচ্ছিল। রাক্ষসেরা সেই বাণিজ্যতরী ধ্বংস করে সকলকে কারারুদ্ধ করে অত্যাচার করতে লাগলো। বৈশ্য সুপ্রিয় ভগবান মহাদেবের পরম ভক্ত এবং শিবের পূজা না করে জলস্পর্শ করতেন না। কারারুদ্ধ হয়ে সুপ্রিয় এবং তার সাথীরা একান্ত মনে 'ওঁ নমঃ শিবায়' মন্ত্র জপ করতে লাগলেন এবং ভগবান মহাদেবের ধ্যান করতে লাগলেন। তাদের এই ধ্যান এবং মন্ত্র উচ্চারণ শুনে দারুক রাক্ষস ভয় পেয়ে তাদেরকে সেই মন্ত্রোচ্চারন বন্ধ করতে আদেশ দিল। এমতাবস্থায় বৈশ্য সুপ্রিয় মহাদেবকে একান্ত মনে বলল 'প্রভু আপনি আমাদের জীবন ও প্রাণ রক্ষা করুন'। তার কাতর প্রার্থনায় ভগবান শঙ্কর সেই বনাঞ্চলের একটি গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন এবং তার সঙ্গে চার দরজাযুক্ত একটি মন্দিরও সেখানে প্রকটিত হয়। মন্দিরের মধ্যভাগে ত্রিমুখী এক জ্যোতির্লিঙ্গ প্রকাশিত হয়ে তাদের দর্শন দিলেন। বৈশ্য সুপ্রিয় মহাদেবকে দর্শন করে প্রণাম ও পূজো করলেন। তার পূজাতে ভগবান সন্তুষ্ট হয়ে নিজে পাশুপত অস্ত্র ধারণ করে সমস্ত রাক্ষসদের নিহত করলেন এবং ভক্ত সুপ্রিয় ও তার সঙ্গীদের জীবন রক্ষা করলেন। ভগবান শঙ্কর এই বলে ভক্ত সুপ্রিয়কে আশীর্বাদ করলেন 'সেই বনে মুণি-ঋষি, শিবের উপাসকেরা এবং সাধারণ মানুষজন, জীবজন্তু নির্ভয়ে বসবাস করতে পারবে এবং সেই বনে তমোগুনী রাক্ষসসেরা কখনোই আসতে পারবে না। ভক্ত সুপ্রিয় মহাদেবকে কাতর প্রার্থনা করে বললেন 'প্রভু, আপনি যদি এইখানে স্থিত হয়ে সকলের মঙ্গল করেন তাহলে সমস্ত জগৎবাসী উপকৃত হবে'। নাগেশ্বর মহাদেব সেই থেকে এখানে ভক্তের প্রার্থনায় চিরকাল বিরাজিত আছেন। নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন ও পূজো করলে সর্পভয় দূর হয়। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে এসে নাগেশ্বর মহাদেবের রুদ্রাভিষেক করেছিলেন। এছাড়াও আদিগুরু শঙ্করাচার্য এখানে কালিকাপীঠ স্থাপন করেছিলেন। স্কন্দপুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী কুশস্থলীর রাজা রৈবত তক্ষক নাগের অবতার ছিলেন বলে দ্বারকার আর এক নাম কুশস্থলী।             (পরবর্তী অংশ ৪৬তম পর্বে)
প্রকাশিতব্য...

Post a Comment

0 Comments