জ্বলদর্চি

পাঁচটি কবিতা/ কমলিকা ভট্টাচার্য

 পাঁচটি কবিতা 
কমলিকা ভট্টাচার্য



ধ্বংসের আগে  

ধ্বংসের পথে সভ্যতা হাঁটে,  
নগরের আলো নিভে যায় রাতে।  
আকাশে মেঘের রঙ হারায়,  
কালো ধোঁয়ায় সব ঢেকে যায়।  

নদীর স্রোতে বিষাক্ত জল,  
পাহাড়ের চূড়ায় বরফ গলগল।  
ধসছে মাটি, ভাসছে গ্রাম,  
তবু চলেছে ধ্বংসের নির্মাণ।  

ধ্বংসের পায়ের ছাপ পড়েছে সমাজে,  
আওয়াজ শুনেও সব চুপ আছে।  
স্বার্থটুকুনি মারা পড়ার ভয়,  
আপনি বাঁচলে বাপের নাম অক্ষয়।  

যে আঙুল গড়ার ছিল কলমের ধার,  
বাহুল্যতার শানে হয়েছে তলোয়ার।  
পড়েছে কড়া, গিট বাঁধা বারুদের গন্ধ,  
ঝাঁঝরা বুক ভরেছে নিকোটিন রন্ধ্র রন্ধ্র।  

জন্ম হারিয়েছে পরিচয়,  
বেঁচে খালি বেপরোয়া সময়।  
শিকেয় তুলে বিনম্রতা,  
প্রচার খালি আধুনিকতা।  

আর কতদিন আঙুল তুলে বাঁচা,  
বাকি তিন আঙুলের লক্ষ্যে ফিরে দেখা।  
একবার না হয় আগে সব ধ্বংসের,  
দেখে নেওয়া অন্তর আজও কতটা আটপৌরে।


অন্যায়ের অন্ধকারে


অন্ধকারে যখন ন্যায়বোধের পতন,  
বেঁচে থাকে কেবল নির্দোষ প্রাণের ক্রন্দন।  
ছাই থেকে উঠে আসে স্মৃতিরা তীব্র,  
পুনরাবৃত্তির ভয়ে, সমাজ হয় কেবলি নির্বোধের দেশ।

না,  
এ কোনও বিপ্লবের জাগরণ নয়।  
এ কেবল এক সহজ, সাদাসিধে আত্মার কান্না,  
যে ভয়ে হারিয়েছে তার ইচ্ছার অধিকার,  
আর চিকিৎসকের মরদেহে লুটিয়ে পড়েছে হিংসার অভিশাপ।

ভয়, একটানা ভয়ের শ্বাসে বাঁচতে হয়,  
যেখানে টিকে থাকা প্রাণই  যথেষ্ট প্রাপ্তি
 শব্দ, বাক্য, প্রতিটি বর্ণমালা  
একটি বিস্ময়বিহীন জ্বালাময় দৃশ্য হয়ে দূরে মিলিয়ে যায়।

অতঃপর,  
প্রতিবাদের আবরণ যদি ভাঙে,  
প্রকৃত অন্যায়ের মুখোমুখি হতে হয়,  
যেখানে শত শত মিথ্যার তদারকি
ভেঙে দেয় বিশ্বাসের দেয়াল।

তবু,  
অন্ধকারে একটি হেমলক পাত্র এসে  
জ্বেলে যায় আলোর শিখা,  
একটি মৃদু আশা নিয়ে,  
যদি কোনদিন শেষ হয় এই অন্যায়ের ছায়া...


 সীমারেখা

কিছু সত্যি কথা গোপনে  
সুন্দর লাগে ভারি  
তাকেই বোধয় লজ্জা বলে  

কিছু কথা না বলে  
আচরণে প্রকাশ পেলে  
তাকে সম্মান বলে  

ভাষা যেখানে মর্যাদার  
গণ্ডী পেরোয়  
তাকে আস্ফালন বলে  

সব কিছুর স্বাধীনতা চাওয়াকে  
বোধয় উচ্ছৃংখলতা বলে  

যে প্রশ্রয় সমাজকে
 নষ্ট করে  
তাকে কুশিক্ষা বলে  

চ্যাট জিপিটি কিম্বা মেটা AI কে বললেও  
সেও কবিতা লেখে  
জানিনা তাকে কি বলে...


চিরন্তন চক্র


জন্ম হতে জন্মান্তরে,
আবারও ফিরে আসি আমি,
চক্রাকারে বাঁধা এই পথ,
নিরন্তর চলা জীবনের গান।

প্রথম আলোতে চোখ মেলে,
নতুন পথের সূচনা হয়,
স্মৃতির পাতায় লিখে যাই,
আমার অস্তিত্বের অমলিন গল্প।

রূপ বদলায়, নাম বদলায়,
বদলায় শুধু সময়ের স্রোত,
তবু আত্মার সেই চিরন্তন সুর,
অবিচল থেকে যায় হৃদয়ে।

জীবনের ভারে নুয়ে পড়ে মাথা,
ক্লান্তির ছায়া ঢেকে দেয় দৃষ্টি,
তবু হৃদয়ের গভীরে, শিশু আমি,
অজানা স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যাই।

অতল গভীরের আলোর ছায়া,
অমলিন, অক্ষয়, চিরন্তন,
জন্ম থেকে জন্মান্তরে,
আমার সঙ্গী হয়ে রয়।

 নবজাগরণ

জীবনের প্রতিটি ফোঁটা,  
সম্ভাবনার এক অদৃশ্য স্রোত—  
পুরনো কাঠের গভীরে জমে থাকা  
নতুনের প্রথম স্পর্শ,  
আনন্দিত করে তোলে জেগে ওঠার গান।  
শান্তির অবিরত ধারায়,  
শুধু আশার মিছিল।

অজুহাতের গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে আসা,  
আশা আর সাহসের সূক্ষ্ম কারুকাজ,  
শুধু ডিগ্রির খাঁচায় নয়—  
মুক্তির অগ্নিস্ফুলিঙ্গে জ্বলে ওঠা,  
যে ছাইয়ের নিচে লুকানো  
প্রাণের অব্যক্ত স্পন্দন।

কর্মের অভাব কি?  
তবুও বেঁচে থাকে কর্মের প্রত্যাশা,  
একটি স্বচ্ছ স্বপ্ন—  
যে স্বপ্নে জন্ম নেয় জীবনের নতুন অধ্যায়।  
প্রজন্মগুলো একে একে দাঁড়ায়,  
হাতে হাত রেখে গড়ে তোলে  
এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি।

দমিয়ে রাখা নয়,  
জাগিয়ে তোলা শক্তির উদ্দীপনা;  
হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা স্বর—  
মুষ্টিবদ্ধ হাতের উত্তোলন নয়,  
বরং প্রতিটি আঙুলে  
নবজীবনের আলোর উজ্জ্বলতা।

Post a Comment

0 Comments