জ্বলদর্চি

রাজা যাদবরাম রায় (জমিদার, মাজনামুঠা পরগনা, কাঁথি)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২১
রাজা যাদবরাম রায় (জমিদার, মাজনামুঠা পরগনা, কাঁথি) 

ভাস্করব্রত পতি

কোনও এক সময় মাজনামুঠা স্টেটের মালিক রাজা যাদবরাম চৌধুরী খুবই প্রজাবৎসল, বৈষ্ণব ভাবাপন্ন, ধার্মিক ছিলেন বলে কথিত আছে। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য ছদ্মবেশ ধরে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। পরগনার রাজধানী মানে পরগনায় অবস্থিত জমিদারি সেরেস্তায় ফেরার উপায়ন্তর না দেখে কাছাকাছি এক প্রজার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। বাড়ির মালিককে আহার ও রাত্রি যাপনের জন্য বললেন নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে। অতিথিবৎসল বাড়ির মালিক অতিথিকে সাদরে গ্রহণ করলেন। কিন্তু বাড়ির হাঁড়ির খবর তাঁর জানা ছিলনা। তাই খুবই বিপদে পড়লেন। 
যাদবরাম রায় প্রতিষ্ঠিত কিশোরনগর রাজবাড়ির দুর্গাপূজা

সে যুগে মানুষ অতিথিকে মুনি ঋষি জ্ঞানে ভক্তি করত। তাই অতিথিকে আপ্যায়নের দায় বাড়ির মালিককে ভীষণভাবে পীড়ন করেছিল তখন। অনন্যোপায় হয়ে গৃহকর্তা ও গৃহকর্তী মিলে মাঠের দূর্ব্বা ঘাসের কচি কচি কলি তুলে যত্ন সহকারে রান্না করেছিল। রাত্রিতে আহারের সময় অতিথিকে সেটাই পরিবেশন করেছিল। ছদ্মবেশী রাজা যাদবরাম রায় এই আতিথেয়তায় খুবই তৃপ্ত হন। তারপর ভােরে সেরেস্তায় ফিরে যান। 
রাজার কুলদেবতার মন্দির

পরে একদিন পাইক পাঠিয়ে ওই প্রজাকে সেরেস্তায় তলব করেন। প্রজা পাইক মারফত রাজার তলবে সাংঘাতিক কোনাে অপরাধ হয়েছে এই আশঙ্কায় ভীত হয়ে কোনওরকমে সাহস সঞ্চয় করে কাছারি বাড়িতে উপস্থিত হয়। উক্ত প্রজা কাছারি বাড়িতে এলে তিনি প্রজাকে অতীতের ওই রাত্রিতে আতিথেয়তার কথা মনে করিয়ে দেন ও রান্না সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তখন সেই প্রজা সে রাতে বাড়িতে চাউল না থাকায় মাঠের কচি কচি দূর্ব্বা ঘাসের কলি তুলে যত্ন সহকারে রান্না করে অতিথিকে পরিবেশন করেছিল, তা অকপটে স্বীকার করে নেন। প্রজার এই অসহায় অবস্থার কথা ও সত্যবাদিতায় সন্তুষ্ট হয়ে রাজা কিছু ভূমি দান করেছিলেন। অতি সাধারণ দূর্ব্বা ঘাসের তরকারিতে অতিথিসেবার ঘটনার স্মরণে দান করা সেই জমি সংলগ্ন এলাকার নামকরণ হয় 'দূর্ব্বাবেড়্যা'। যা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটাতে অবস্থিত। 
এখানেই রাজা যাদবরাম রায়ের প্রতিষ্ঠিত দুর্গাপূজা হয়

মেদিনীপুরের বুকে যাদবরামের খ্যাতি ছিল বেশ। মূলতঃ তাঁর দানশীলতা ও বদান্যতার দরুন তিনি প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। যাদবরাম রায় সহ মেদিনীপুরের আরও কয়েকজন জমিদারদের নিয়ে একটি ছড়া শোনা যায় মেদিনীপুরের মানুষজনের মুখে --
"দানে চনু, অন্নে মানু, রঙ্গে রাজনারায়ণ
 বিত্তে ছকু, কীর্তে নরু, রাজা যাদবরাম"। 
এই ছয়জনের মধ্যে 'চনু' হলেন রাজবল্লভ গ্রামের চন্দ্রশেখর ঘোষ, পুঁয়াপাটের 'মানু' হলেন মানগোবিন্দ ভঞ্জ, 'ছকু' হলেন মলিঘাটির ছকুরাম, 'নরু' অর্থাৎ এগরার নরনারায়ণ চৌধুরী, জকপুরের মহাশয় রাজবংশেরশেষ কানুনগো রাজনারায়ণ রায় এবং কিশোরনগর রাজবংশের রাজা যাদবরাম রায়। 
কাঁথির কিশোরনগর রাজবাড়ির বিভিন্ন ছবি

মাজনামুঠা রাজবংশের আদিপুরুষ ছিলেন ঈশ্বরী পট্টনায়েক। তিনি ছিলেন মধ্যশ্রেণীর কায়স্থ পরিবারের সন্তান। তিনি একসময় কাঁথি শহরের বুকে কিশোরনগর গ্রামে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। ১৬১৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে জগমোহন পট্টনায়েক নবাব সরকার থেকে 'চৌধুরী' উপাধি লাভ করেছিলেন। জগমোহনের মোট দুই স্ত্রী এবং চার পুত্র ছিল। অবশেষে জগমোহনেরও মৃত্যু হয় ১৬৪৩ সালে। এরপর জমিদার হন দ্বারিকানাথ চৌধুরী। কিন্তু তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই রায়কিশোর ভাইপোকে ছলনা করে জমিদারী অধিকার করেন। রাইকিশোরের মৃত্যু হয় ১৬৯৩ সালে। এরপর জমিদার হন তাঁর ছেলে ভূপতিচরণ। কিন্তু ১৭৪৫ এ ভূপতিচরণের মৃত্যু হয় অপুত্রক অবস্থায়। ফলে কৃপানিধির পুত্র যাদবরাম জমিদার হন তখন।

যাদবরাম রায়ের জন্ম হয় ১৭০০ সালে। তিনি যখন নাবালক ছিলেন, তখন তাঁর পিতা কৃপানিধির মৃত্যু হয়। এই বংশের একজন ভূপতিচরণ যাদবরামকে তাঁর বিষয় সম্পত্তি থেকে বাদ দিয়ে নিজেই সব ভোগ করছিলেন। পরিণত বয়সে যাদবরাম যখন জানতে পারলেন, তখন তিনি গেলেন আলীবর্দী খাঁর কাছে। আলিবর্দী খাঁ তখন বাংলার নবাব পদে আসীন। যুবক যাদবরাম মুর্শিদাবাদে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলেন। সম্পত্তি গত সমস্যার কথা তুলে ধরলেন নবাবের কাছে। নবাব আলীবর্দী খাঁ যাদবরামের কথাবার্তা বিগলিত হলেন। তাঁর ব্যবহারে প্রীত হয়ে তাঁকে 'রাজা' উপাধি দান করলেন এবং বললেন, 'আজ থেকে তুমি মাজনামুঠার রাজা। প্রজাদের পাশে থেকো'। নবাবের সহায়তায় যাদবরাম দখল নিলেন মাজনামুঠার সম্পত্তির। সেইসাথে হিজলীর লবণ কারবারের ইজারাও পেলেন!

চারিদিকে ব্যবসা বাণিজ্য আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে প্রচুর আয় করতে লাগলেন যাদবরাম। কিন্তু অর্থে বলীয়ান যাদবরাম লোভী হয়ে গেলেন না। তিনি মানতেন যে, দানের মত দ্বিতীয় কোনো পুণ্য নেই। তাই তিনি প্রতিদিন কিছু না কিছু দান করেই জলস্পর্শ করতেন। সেজন্যই যাদবরামকে সবাই বলে, 'এ যুগের দাতাকর্ণ -  যাদবরাম'। 

যাদবরামের দানের খ্যাতি দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। কাশী, নবদ্বীপ, পুরী, গঞ্জাম, ভাটপাড়ার বহু ব্রাহ্মণ নিষ্কর সম্পত্তি লাভ করলেন তাঁর কাছ থেকে। কিন্তু রাজা যাদবরামের এই দান ধ্যান সহ্য করতে পারলেন না বিভূতিচরণ। তিনি তখনকার নবাব মীরজাফরের কাছে অভিযোগ করলেন, এভাবে নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি দান খয়রাতি করতে থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। অভিযোগ পেয়েই মীরজাফর যাদবরামকে ডেকে পাঠালেন। যাদবরাম নবাবের সঙ্গে দেখা করলেন। নবাব তাঁকে এভাবে দান করতে বারণ করলেন। সেইসাথে যাবতীয় দান করা জমি ফিরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু রাজা যাদবরাম রাজি হলেন না নবাবের কথায়। তিনি বললেন, 'আপনার এই আদেশ আমি পালন করতে অপারগ। যে জমি দান করেছি, তা আবার ফিরিয়ে নেওয়ার মতো মহাপাপ করতে আমি পারিনা'। 

এতে নবাব রেগে নির্দেশ দিলেন, যাদবরামকে শাস্তি দেওয়া হোক। তখন একটা খোলা মাঠে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হল যাদবরামকে। যাঁর মাথাটা শুধু বাইরে। মাথার ওপর গনগনে রোদ। অসহায় যাদবরাম তখন তাঁর ইষ্টদেবতা কিশোরজিউকে ডাকতে লাগলেন। এদিকে সারাদিন উপবাসে আছেন যাদবরাম, যতক্ষণ কাউকে কিছু দান না করবেন, ততক্ষণ কিছু খাবেন না। এসময় একজন ব্রাহ্মণ এসে বললেন, রাজন, আপনি আমাকে কিছু দান করে উপবাস ভঙ্গ করুন। তখন যাদবরাম ব্রাহ্মণকে আঙুলের হীরের আংটি দান করে তাঁর পা ধোওয়া জল খেলেন। আবার পরের দিন একই অবস্থা। সকাল পেরিয়ে দুপুর, অবশেষে বিকেল হল। কিন্তু যাদবরাম জলস্পর্শ করেননি। একনাগাড়ে করে চলেছেন ইষ্টদেবতার নাম। জনগণ রুষ্ট, কিন্তু প্রত্যেকেই নবাবের ভয়ে ভীত। হঠাৎ সন্ধ্যের মুখে এক ব্রাহ্মণ যাদবরামের সামনে এসে বললেন, রাজা আমি শ্রীক্ষেত্রের ব্রাহ্মণ। কন্যাদায়গ্রস্থ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে চাই। তাই আপনার শরণাগত হয়েছি। 

যাদবরাম ব্রাহ্মণকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন। তিনি বললেন, 'আমার হাতে একখানা শুকনো পাতা আর একগাছি তৃণ এনে দিন। আপনার আশা আমি পূরণ করবো'। ব্রাহ্মণ্রাহ্মণ তখন একখানা পাতা আর একগাছি তৃণ এনে রাজার হাতে দিলেন। রাজা দাঁত দিয়ে নিজের জিভ কেটে রক্ত বের করে সেই রক্তে শুকনো পাতায় লিখলেন, 'বাস্তুদান', অর্থাৎ কন্যাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণকে দেওয়া হল ২৪০ বিঘা জমি সহ রাজবাটী। চমকে গেলেন ব্রাম্ভণ। সবাই ধন্য ধন্য করে উঠলো রাজা যাদবরাম রায়ের। 

ইতিমধ্যে ঘটনার খবর পৌঁছে গেল নবাবের কানে। স্বয়ং নবাবও অবাক! এভাবেও দান করা যায়। যাদবরামের মহত্ত্বের কাছে তিনি নিজের ঔদ্ধত্য সংবরণ করলেন। মাথা নত করলেন। চলে এলেন যাদবরামের কাছে। করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন। মুক্তি দিলেন রাজাকে। অবশেষে রাজা যাদবরাম রায় ফিরে এলেন কিশোরনগর গড়ে।

কিন্তু ঐ ব্রাহ্মণ রাজার কাছ থেকে অন্য ধরনের দানসামগ্রী নিলেন। এবং বললেন, 'এই মূল্যবান রাজবাড়ি আপনাকেই দিয়ে দিলাম। এজন্য আপনি আমাকে বাৎসরিক এক টাকা করে খাজনা দেবেন। যাদবরাম সম্মত হলেন প্রস্তাবে। যাদবরাম রায় তাঁর রাজত্বকালে কিছু সময় হিজলীর লবন মহালের ইজারাদারও ছিলেন।

বর্তমানে কিশোরনগর রাজবাড়ির দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন এই রাজা যাদবরাম রায়। সালটা ছিল ১৭২০। স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুরু করেন পূজা। শাক্তমতে এখানে প্রতি পদ থেকে দশমী পর্যন্ত পূজা হয়। প্রথামাফিক এখানে ধীবর নরোত্তম বরের বংশধরেদের সংকীর্তনের মাধ্যমে শুরু হয় পূজা। যা পরিচিত 'গড়ের পূজা' নামে। এখানে হোমাগ্নি হয় আতস কাঁচে সূর্যের আলো ফেলে। পশ্চিমমুখী ঘটেই দেবীর আবাহন হয়। 

যাদবরামের মৃত্যু হয় ১৭৮০ সালে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কিছুদিন পরেই তাঁর একমাত্র পুত্র কুমার নারায়ণ (১৭৮২) ও পৌত্র জয়নারায়ণের (১৭৮৪) মৃত্যু হয়। ফলে মূল বংশধারাও হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। এসময় জয়নারায়ণের স্ত্রী পোষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন সুন্দরনারায়ণকে। কিন্তু জয়নারায়ণের বিমাতা তথা রাণী সুগন্ধা জমিদারী কেড়ে নিয়েছিলেন। সুগন্ধা প্রতিষ্ঠিত 'সাঁউতানীর পুকুর' (সামন্ত রাজার পত্নী অর্থে 'সাঁউতানী' কথাটি ব্যবহৃত হয়) এখনও আছে। 

সেসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল চলছিল। মেদিনীপুরের কাঁথি এবং কাঁথির সংলগ্ন সমুদ্র তটভূমি ছিল লবণ উৎপাদন ও ব্যবসা কেন্দ্রের পীঠস্থান। সালটা ১৭৬৮। হিজলীর সল্ট এজেন্ট হন এন ডাবলু হিউয়েট। তিনি ১৭৮৮ সালে এই কিশোরনগর গড়ের রাজা যাদবরাম রায়ের উত্তরাধিকারিণী সুগন্ধা দেবীর কাছ থেকে একটি জমি পাট্টা নেন। পরবর্তীতে সেই জমির ওপর তিনতলা প্রাসাদ তৈরি করে বসবাস এবং প্রশাসনের কাজ দুটোই করতে থাকেন। যা এখনও আছে। তবে তা ভাঙাচোরা, পরিত্যক্ত। এটিই কাঁথির 'নিমকমহাল' নামে পরিচিত।

🍂

Post a Comment

0 Comments